বাঙলার রাজনীতিতে অনেক মত, পথ ও ধারা এসেছে; কেউ এসেছে মুক্তির বুলি নিয়ে, কেউ বা এসেছে ক্ষমতার লোভে। কিন্তু যে মানুষটি একটা জাতিকে রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ১৯৭৫ সালে “বাকশাল” নামক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন, তখন সেটা নিয়ে যত না চিন্তা হলো, তারচেয়েও বেশি চালানো হলো অপপ্রচার।
বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, দীর্ঘ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের পর আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাকশালই ছিল বাঙলাদেশের জন্য উপযুক্ত রাষ্ট্রচিন্তা, যা বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আমি এই ব্যবস্থাকে “গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র” বলেই বিশ্বাস করি।
বাকশালের প্রেক্ষাপট:
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল গঠন করলেন, তখন বাঙলাদেশ সদ্য স্বাধীন, রক্তাক্ত, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর, প্রশাসনিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাঙলাদেশে আধিপত্য করছিলো দুর্নীতি প্রশাসন ছিলো দুর্বল, পেছনে টানছিলো পাকিস্তানি ধাঁচ খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি জনজীবন অসহনীয় করে তুলেছিলো।
বহুদলীয় নামধারী গণতন্ত্রে বিরাজ করছিলো সুবিধাবাদী, বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক দল ও চক্রান্ত। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর “বাকশাল” ছিল একটি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক নতুন পথচিন্তা।
বাকশালের কাঠামো ও দর্শন:
বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) ছিল একক রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামো, যা মূলত নিচের স্তম্ভগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল:
১. একদলীয় শাসন নয়;
-রাষ্ট্রীয় ঐক্যের সরকার যার সদস্য ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবীরা।
২. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন;
-কৃষক, শ্রমিক, খেটেখাওয়া মানুষকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে আনা।
৩. নতুন অর্থনৈতিক মডেল;
-সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প, কৃষি ও শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি।
৪. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা;
-প্রতিটি উপজেলাকে উন্নয়ন ইউনিট বানানোর পরিকল্পনা।
বাকশালকে ঘিরে অপপ্রচার ও বাস্তবতাঃ
-চরম অপপ্রচারের শিকারে পরিণত হয়েছিল বঙবন্ধু ও বাকশাল'কে নিয়ে যা এখনো চলমান আছে লুটেরা মানসিকতার রাজনীতিবিদ ও বঙ্গবন্ধু বিরোধী গুষ্ঠির মধ্যে। বলা হয়েছিল, বাকশালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু “গণতন্ত্র হত্যা” করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটি ক্ষুধার্ত, দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে পশ্চিমা ধাঁচের উদার গণতন্ত্র কি আদৌ কার্যকর হয়?- না। যা এখন আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও শৃঙ্খলা দিতে হয়, পরে গণতন্ত্র চর্চা করা যায়।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ছিলো “উন্নয়নমূলক গণতন্ত্র” (developmental democracy)'এর উদাহরণ, যা দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর বা চীনের মতো দেশে ফল দিয়েছে।
আজকের প্রেক্ষাপটে বাকশালের প্রয়োজনীয়তাঃ
-বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমরা যদি দেশের বাস্তবতা দেখি একদিকে চরম ধনী শ্রেণির দাপট অন্যদিকে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশ। প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক ও জনগণের অধিকারভিত্তিক চিন্তার অভাব। জনগণের সঙ্গে রাজনীতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির ঘাটতি।- এই প্রেক্ষিতে আজ বাকশালের মতো একটি জনগণমুখী শৃঙ্খলিত রাজনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত জরুরি। যেটা প্রতিষ্ঠা করবে একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ, উৎপাদনমুখী সমাজব্যবস্থা, কৃষক ও শ্রমিকের মর্যাদা, আর জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে তুলে ধরবে।
বাকশাল মানেই একনায়কতন্ত্র নয় ; বাকশাল কখনোই ব্যক্তিস্বার্থে গড়া একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না বরং এটা ছিল জনগণের দুঃখ লাঘবে, রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনে এবং শোষণমুক্ত বাঙলাদেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রদর্শন। যেটা ইতিহাসের বহু আগেই প্রয়োজনীয়তা চিনে ফেলেছিলো।
আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে নতুন করে বাকশাল'কে মূল্যায়ন করার, ভুল বোঝাবুঝির আবরণ সরিয়ে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নকশায় বঙ্গবন্ধুর এই চেতনাকে পুনরায় স্থান দেওয়ার। আমি চাইবো, এইবার আওয়ামী লীগ যদি ফিরে বাকশালি চিন্তা চেতনা এবং আদর্শ নিয়েই যেনো ফিরে তার জন্য যে কয় বছর লাগে লাগুক।
বাকশাল কায়েমই হোক বাঙলাদেশের নতুন শপথ।
জয় বাঙলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১০:৩১