মেমোরিয়াল ডে'র সুবাদে একদিনের বাড়তি ছুটির কারনে রবিবার সকালেও মনটা ফুরফুরে ছিল। তাই ভোর সকালে নাস্তা পেটে পড়ার আগেই গিন্নির বাজারে যাওয়ার প্রাথমিক তাগাদায় তেমন বিচলিত হলাম না। কেবল আইপিএলের ফাইনালে মুস্তাফিজদের খেলা ফসকে যাক তা চাচ্ছিলাম না কোনোভাবেই। আবার গিন্নির বিকেল বেলার কাজে যাবার ব্যাপারটা মাথায় রেখে জুহ্রের নামাজ শেষে 'মিশন কিচেন শপিং' দৈনিক কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলাম এই ভেবে যে ততক্ষনে আইপিএল ফাইনাল সাঙ্গ হবে।
মুস্তাফিজদের জেতার খুশিতে সময়মতো নামাজ শেষ করেই গিন্নিকে বগলদাবা করে রওয়ানা দিলাম 'ফুড টাউনে'র দিকে। ভাগ্য ভাল যে দেশের বাইরে থাকার কারনে বিভিন্ন সাইজের বাজারের ব্যাগ হাতে নিতে হয় না। সেই সুযোগে ব্যাগের বদলে গিন্নি জুটল আর আমারও নিজেকে আদর্শ স্বামী প্রমানের আরেকটা সহজ সুযোগ মিলল। বাসা থেকে হাটা দুরত্বের ফুড টাউনকে ঢাকার মীনাবাজারের সাথে তুলনা করা যায়। যাই হোক অর্গানিক অপরিশোধিত চিনি কিনতে গিয়ে চোখ পড়ল টিটুলিয়া [ teatulia - তেঁতুলিয়া ] চায়ের দিকে। আগেই বলে রাখি লেখাটি কোনো বিশেষ পণ্য পরিচিতি বা প্রমোশনের জন্য লিখিনি। তবে টিটুলিয়া চায়ের মোড়কটি না দেখলে এই লেখাটি লিখাই হত না।
অনেক বছর আগে সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত 'বাংলা বিয়ার' নামের ইংলিশ মদের ক্যানে সিলেটের মানচিত্র উপস্থাপনের ব্যাপারে চমৎকৃত হয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ প্রবাসে কাপড়চোপড় ছাড়া মানসম্মত বাংলাদেশি পণ্য 'বিদেশি দোকানে' খুব একটা চোখে পড়েনি। একসময় ছিল যখন বাংলাদেশি চা বড় বড় কাঠের চৌকা বাক্সে বিদেশে রপ্তানি হতো। সেই সোনালি সময়ে চিটাগাংয়ে রপ্তানিযোগ্য চায়ের নিলাম ডাকের হুলস্থুল কারবার এক আত্মীয়ের কাছে অনেক শুনতাম। চা ব্যবসায়ের ধসের কারনে একসময় সেই আত্মীয় তাঁর চা বাগানটি বিক্রি করে দেন। তাকে ধন্যবাদ দেই যে তখনকার অনেকের মতো অতি লাভের আশায় চা বাগানকে রাবার বাগানে রূপান্তর করেননি। বহুজাতিক ব্যবসার চটকদার মোড়কে মোড়ানো চায়ের বাজারজাত ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার পরের এক দশক যখনই সিলেট যেতাম দেখতে হতো চা বাগানগুলো কিভাবে ধীরে ধীরে রাবার বাগানে পরিনত হচ্ছে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ পীড়াদায়ক ছিলো।
দুই ভিন্ন মহাদেশে যাপিত প্রবাস জীবনে যখনই চা বিষয়ক আলোচনা হতো বা এখনও হয় তখন নানা তথ্য উপাত্তে একটা ব্যাপারই বুঝতে পারি যে দুনিয়া জুড়ে দিন দিন পানীয় হিসেবে চায়ের ব্যবহার বাড়ছে। বলে নেয়া ভাল আমি চা খোর নই - বরং কফিই বেশি খাওয়া হয় আমার। তাই চা সংক্রান্ত আলোচনায় রসনার চেয়ে ব্যবসায় আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। সুস্বাস্থ্যে, স্বাস্থ্য রক্ষা ও অল্টারনেটিভ মেডিসিন হিসেবে চায়ের উপকারিতা এবং এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারনাই বিশ্বে উত্তরোত্তর চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। লিপটন কোম্পানির দৌরাত্ন্যে আটলান্টিকের দু'পাড়েই চা এবং চা কেন্দ্রিক অন্যান্য ব্যবসার (যেমন আইস্ড্ টি) ব্যাপক পসার। ইংল্যান্ডে আমাদের দেশের মতোই সকাল-বিকেলের নাশতার মূল হিসেবে গরম চা আদৃত হলেও মার্কিন মুল্লুকে আইস্ড্ টিই চা-খোরদের প্রথম পছন্দ (বাংলাদেশি বা ভারতীয় জনগোষ্ঠী ঘরে গরম চা-ই খেয়ে থাকেন)। দেশ ছাড়ার বছর দুই আগে জানলাম পঞ্চগড়ে নাকি সমতলে চা চাষ শুরু হয়েছে। তখনকার এক দৈনিকে কাজ করার সুবাদে ব্যাপারটা বেশ আগেভাগেই জেনেছিলাম কারন দৈনিকটির মালিক পক্ষ সেই চা বাগানের উদ্যোক্তা ছিলেন।
ফিরে আসি নিউইয়র্কের ফুড টাউনে। টিটুলিয়ার সাথে দেশের তেঁতুলিয়ার নামের সাদৃশ্যে মনের অজান্তেই এক প্যাকেট চা ট্রলিতে চালান করে দিলাম। অর্গানিক পণ্য এবং পরিবেশ বান্ধব মোড়কের জন্য প্রিমিয়াম মূল্যেই কিনতে হলো। বাসায় ফিরে যখন প্যাকেটটি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লাম তখন পণ্যটির উৎস আমার নিজের দেশ তা জেনে ভীষন ভাল লাগলো। টিটুলিয়া'র ওয়েবসাইটে গিয়ে বুঝলাম সেই সমতলে চা চাষের উৎকর্ষতাই এ পণ্য। আমাদের মীনাবাজারের মালিকদের আরেকটি উদ্যোগ কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের চা কলোরাডোর এক কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত হয়ে আজ এই বিদেশে আমার রান্নাঘরের তাকে তার উপস্থিতি জানাচ্ছে। আমি জানিনা আয় রোজগারের হিসেবে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট কতটা সফলতা পেয়েছে কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক, বাড়ন্ত মার্কিন চায়ের বাজারে তাদের ধারাবাহিক উপস্থিতি তাদের ভবিষ্যত সম্ভাবনার কথাই জানান দিচ্ছে।
বাংলাদেশে চা চাষের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা তারা চা রপ্তানি এবং বিদেশে তাদের পণ্য বাজারকরন বিষয়ে কি চিন্তা করছেন? কাজী এন্ড কাজীর শুরু ২০০০ সালের দিকে। এই ১৫/১৬ বছরে যদি তারা বিদেশে একটা অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয় তবে কেন দেড়শ' বছরেরও বেশী সময় ধরে অব্যাহত চা শিল্পের অন্যান্যরা কেন এত পিছিয়ে? গতানুগতিক চা চাষের বিপরীতে কিটনাশকমুক্ত অর্গানিক চা চাষে যদি সফলতা পাওয়া যায় তবে কেন চা চাষের জন্য আরও অনুকুল পাহাড়ী ঢালগুলোকে রাবার বন বানিয়ে পরিবেশ বিরূপ করছি?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৩৪