"বান্দেরা! বান্দেরা! ওয়ান ফর থ্রি; টু ফর ফাইভ।" গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল ফর্টি সেকেন্ড দিয়ে পার্ক এভিনিউয়ের দিকে বেরোতেই রবিবারের এই সাত সকালেই সচকিত হলাম। গন্তব্য ফিফ্থ এভিনিউ আর ফরটিথ স্ট্রিটের মিড-ম্যানহাট্ন লাইব্রেরি। কাজের চাপে আর আবহাওয়ার দুরন্তপনায় এখনও 'সামার' ব্যাপারটা আমার রাডারে ধরা পড়েনি। কিন্তু তাই বলে বাকিরা আমার মতো যান্ত্রিক হবে তা আশা করি না। গ্রীষ্ম হোক কি শীত; জীবন উদযাপনে যতি পড়বে না এই শহরবাসীর তা অবলীলায় বলে দেয়া যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু জাতের লোকের মিশেল এই নিউ ইয়র্ক। ম্যানহাট্নের অফিস পাড়া বা তার আশেপাশের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলিতে উইকডে-উইকেন্ড নির্বিশেষে ট্যুরিস্টদের দঙ্গল বাদ দিলে অবশ্য এই ডেমোগ্রাফিক ডাইভারসিটির স্কোপটা যেনো ঝপ করে সাদা চামড়া, ছোট চোখ চাইনিজ-জাপানিজ-কোরিয়ান, টুপিওয়ালা ইহুদি, আর কচিৎ এশিয়ান বাদামি, কালো চামড়াদের মধ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সীমাবদ্ধ বৈচিত্র্য একটু চাগিয়ে দিতেই যেনো হাজারো 'স্পেনিশ'দের ভীড় এ শহরে। এদের সম্পর্কে দু লাইনের বর্ণনা খুব কঠিন। এদেরকে বুঝতে হলে নিউ ইয়র্ক মাস ছয়েক কাটানোও যথেষ্ঠ নয়। বাড় বাড়ন্ত হিস্পানিক জনগোষ্ঠির উপস্থিতি নিউ ইয়র্কে এতটাই প্রবল যে এই শহর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হিস্পানিক শহর। আদমশুমারির হিসেব মতে শহরের মোট জনগোষ্ঠির শতকরা চল্লিশ ভাগের মতো হিস্পানিক। আদমশুমারিতে ধরা পড়া স্পেনিশদের সংখ্যা ২০১৫ এর হিসেব মতে প্রায় পয়ত্রিশ লক্ষ। যদি আনডকুমেন্টেডদের হিসেবে ধরা হতো তবে সংখ্যাটি আরও লাখ দুই বাড়তো। নিউ ইয়র্কের ব্রংক্স বরো/কাউন্টির অর্ধেকের বেশি তারাই। তাই নিউ ইয়র্কে থেকে এদের উপেক্ষা করার উপায় নেই। যে কারনে এত কিছু লিখছি তা হলো আজ নিউ ইয়র্কে 'ন্যাশনাল পুয়ের্টো রিকান ডে প্যারেড'। এই অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটাই বেমালুম ছিলাম গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে পৌঁছার আগ পর্যন্ত।
হিস্পানিকরা আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান ও ল্যাটিনে স্পেনিশ ঔপনিবেশিকতার ফলাফল। এই শংকর জাতে সাদা-কালো দুরংয়েরই দেখা মিলে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের থেকে কালো-বাদামি চামড়ার স্পেনিশদের চালানে নিউ ইয়র্কে পুয়ের্টো রিকানরাই সবচেয়ে এগিয়ে। এ শহরে মোট হিস্পানিকদের তিনজনে একজন পুয়ের্টো রিকান। তার মানে প্রতি দশ জনে গড়ে একজন পুয়ের্টো রিকান বসতি গড়েছে এই শহরে।
ফিরে আসি গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে। স্পেনিশে বান্দেরা মানে হলো পতাকা। পতাকা ফেরিওয়ালাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু তারপরও তাদের ব্যবসা আজ রমরমা। দেদারসে বিক্রি হচ্ছে পুয়ের্টো রিকান পতাকা। জানিয়ে রাখি পুয়ের্টো রিকো এখনও আনইনকর্পোরেটেড টেরিটরি অফ ইউনাইটেড স্টেটস। সোজা বাংলায় ইউনাইটেড স্টেটস ফেডারেল গভর্ন্মেন্টের নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক অঞ্চল। যার কারনে সংবিধিবদ্ধভাবে তারা আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করলেও এটা তাদের জন্মগত অধিকার নয়। যে কারনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে এদেরকে আমেরিকা ছাড়া করার হুন্কার দিয়েছেন এই তত্ত্ব বলে যে তারা 'মার্কিন জাতে'র মধ্যে পড়ে না। সে আরেক কাহিনি।
মিড ম্যানহাট্ন লাইব্রেরিতে বসে যখন 'উইন্ডোজ সার্ভারে'র জটিল বিষয়গুলো সপ্তাহান্তের ক্লান্ত মস্তিস্ককে আরও ক্লান্ত করছে তখন বাইরে পচাশি ডিগ্রির রৌদ্র খরতাপের পারদ আরও উসকে দিচ্ছে উত্তাল পুয়ের্টো রিকান বাদ্য বাজনা। পাঁচ তলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার ল্যাবে বসে তাই মাইক্রোসফটের ট্রেইনারের দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষন করছে আমার স্পেনিশ সহকর্মী এবেল। কিন্তু চাকুরি টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে তো 'সার্টিফাইড' হতেই হবে। তার বিরস মুখ আর মোবাইলে গার্লফ্রেন্ডের মুহূর্মুহূ টেক্সট আমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো বারংবার। লাঞ্চ ব্রেকে তাই হামলে পড়লাম কি বোর্ডে। রোজা থাকায় না খাবার ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেলো।
আমেরিকা আসার আগে একটা ব্যাপারে আমার ধারনা ভুল ছিলো। আমি মনে করতাম আমেরিকান স্পেনিশ আর ইউরোপিয়ান স্পেনিশ একই রকম। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল এটা শুধু ডায়লেক্টের পার্থক্য হিসেবে থেমে থাকেনি বরং ভাষারীতিতে এসেছে ব্যাপক পার্থক্য - বিশেষ করে কথ্যরূপে। ইউরোপিয়ান স্পেনিশের মধ্যম পুরুষে বহুবচনের ব্যবহার আটলান্টিকের এ পাড়ে পৌছে কোথাও যেনো হারিয়ে গেছে। তাই মহাসাগরের দু'পাড়ে ভাষায় রাত দিন না হলেও সকাল-দুপুর পার্থক্য তৈরি হয়েছে গত চার শতকে।
এবার আসি প্যারেড প্রসঙ্গে। যদিও নানা প্যারেড থাকে বছর জুড়ে কিন্তু নিউ ইয়র্ক শহরে গ্রীষ্মের বিভিন্ন সময়ে সপ্তাহান্তের প্যারেডগুলো একটু যেনো বেশীই জমকালো। ব্যাপারটা আমাদের পহেলা বৈশাখের ঢাকা ইউনিভার্সিটির মঙ্গল শোভাযাত্রার মতোই। বাদ্য ছাড়াও আরও নানা উৎসব অনুসঙ্গ থাকে এসব বর্ণিল প্যারেডে। নাচের অংশে আমাদের বাঙালি মানসিকতা মুনাফিক হয়ে পড়ে। না পারি গিলতে না পারি উগরাতে ব্যাপারটা আমাদের চোরা মানসিকতা গিলতে চায় আয়োজনের সবকিছু সর্বভুকের মতো। প্যারেড দেখতে গেলে শরম লজ্জার বালাই থাকে না যখন হা করা মুখ নিয়ে স্বল্পবসনাদের শিল্প-কসরত উপভোগ করতে হয় বাই ডিফল্ট। আয়োজনের দিক দিয়ে 'ন্যাশনাল পুয়ের্টো রিকান ডে প্যারেড' এই শহরে সবচেয়ে বড়। স্বাভাবিকভাবেই এর আয়োজনও থাকে ব্যাপক। ম্যানহাট্নের বিভিন্ন ব্যস্ত সড়ক ছ'সাত ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্যান্য প্যারেডগুলির মধ্যে থ্যাংকসগিভিং ডে প্যারেড, সেইন্ট প্যাট্রিকস ডে প্যারেড, আর গে প্রাইড প্যারেড মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। পুয়ের্টো রিকান ডে প্যারেডের উদ্দেশ্য পুয়ের্টো রিকান সংস্কৃতি এবং আমেরিকা পুয়ের্টো রিকানদের অবদান বিষয়ে জাতীয় সচেতনতা তৈরি। রাজনীতি আর শোবিজে পুয়ের্টো রিকানদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। পপ গানের বিখ্যাত জেনিফার লোপেজ, রিকি মার্টিন, মার্ক এন্থনি বা অভিনেতা বেনিসিও দেল টোরো- এরা সবাই পুয়ের্টো রিকান বংশোদ্ভুত। এতটুকু লিখেই আমার লাঞ্চ ব্রেক খতম প্রায়। তাই আর লিখা না বাড়িয়ে পাঠকদের জন্য কিছু ছবি জুড়ে দিলাম। প্যারেডের রং আমার লেখাটায় একটু লাগুক না হয়। ছবিগুলো নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের লাইভ ফিড থেকে ধার করা।
ক্রিস্টোফার ডিয়াস নামের ছবির হাস্যজ্জ্বল ভদ্রলোক একজন নামকরা বক্সার যিনি এবছর নিউ ইয়র্ক এসেছেন প্যারেড উদযাপনে।
পুনশ্চ: অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডায় গত রাতের গে নাইট ক্লাবে গোলাগুলি এবং ব্যাপক প্রানহানির ঘটনা এ মাসের শেষ সপ্তাহের গে প্রাইড প্যারেডে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৬ রাত ১:০০