কাগজে খসখস করে দু’লাইন লিখতে গিয়ে মনে হলো আমি যেন কলম ভাঙ্গার আসরে নেশায় চূর- কলম ভাঙ্গাই সার কিন্তু আসর জমছে না। দোয়াতে শুকিয়ে যাওয়া কালির মতো মাথায় ঘুরপাক খাওয়া শব্দকল্পগুলো জমাট হয়ে আছে। আড়ষ্ঠভাব ঝেড়ে ফেলতে পারছি না কিছুতেই। কিন্তু তোমার মত এমন করে কেউ আমার লেখা চায়নি সে অনেকদিন হলো।
আমি কোনো কেউকেটা লেখক নই। একটি সাপ্তাহিকীতে কাজ করার সুবাদে লেখালেখির কাজে অভ্যস্ত হয়েছি অনেক পরে। কিন্তু আমার লেখায় অবলম্বন করে তোমার সাথে জড়াবো এমন আবদার ছিলো আমার নিয়তির চিন্তারও বাইরে। কি অদ্ভুত ভাবে তুমি স্বেচ্ছাবন্দী হলে আমার লেখার ঘেরাটোপে।
অনেকদিন পর তোমার চাপাচাপিতে লিখতে বসলাম। রেডিও বন্ড কাগজ, শিফারের নিবে পেলিক্যানের রয়েল ব্লু কালির সেই মসৃণ আঁক - আহ সেই আবেগ এখনো কত তাজা! টানা হাতের হেলে পড়া জড়ানো হাতের লেখা রয়ে গেছে অবিকল আগের মতো - বদলায়নি এতটুকুও। আমূল বদলে গেছে লেখার উপায়। কি বোর্ডের ঝকমারিতে কাগজে কলম পাতাই দুস্কর।
আমাদের সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ হতো না - দু‘জন থাকতাম ভিন্ন শহরে; বলা চলে দেশের দুই প্রান্তে। পারিবারিক কারনেই আমাদের এই যোগাযোগ-সম্পর্ক অপ্রকাশিত রাখাটা ছিল জরুরী। আমাদের পরিচয়ের শুরুটা ছিলো দৈবাৎ - আমাদের উভয়ের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দূর্ঘটনার কল্যাণে। সময়ের গ্রাফে আমাদের সম্পর্কের পরিপক্কতা ছিলো দ্রুততার সাথে কেবল উর্ধ্বমুখী। তার চেয়েও আশ্চর্যের ছিলো একজন আরেকজনকে কাছে পাবার খোলামেলা রাখঢাকহীন আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা। এখনও ভাবতে অবাক লাগে যে কি দুঃসাহসই না দেখিয়ে ছিলে তোমার তরফ থেকে আগ বাড়িয়ে যোগাযোগের ইচ্ছা জানিয়ে। আমাদের মাঝে কোনো বাক্যবিনিময় হয়নি প্রথম দেখায়। কিন্তু তুমিই কিনা চিরকূটে জানালে আমাকে তোমার উদ্দেশ্যে নিয়মিত লিখতে হবে। তুমি নিশ্চিত ছিলে যে আমি তোমাকে লিখবই। যে সম্পর্কের শুরুই হয়েছিলো তোমার লেখা প্রত্যাশী অভিলাষে তার জের ধরে আমার কাছে তুমি প্রথাগত চিঠির চেয়েও বেশী কিছু আশা করবে তাইতো স্বাভাবিক! আমিও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতাম যেন ফরমায়েশি পান্ডুলিপি লেখার দায় সারতে! তোমার গুছিয়ে কথা বলতে না পারার অজুহাত কিংবা দূরালাপনী ব্যবহারের সুযোগ-সম্ভাব্যতার অভাবের মাঝে পত্রালাপই আমাদের মিতালি পাতালো।
সময়ের হিসেব রাখতে আজকাল তালগোল পাকিয়ে ফেলি তবু চল্লিশ বছর তো হবেই তুমি আর আমাকে লিখতে বলো নি! যখন সবকিছুর শুরু আমাদের দু‘জনের বয়স তখন বিশের কোটা পেরিয়ে গেছে। তাই বয়োঃসন্ধি বা কৈশোরের ভাবাবেগের অপরিমিত চপলতায় রাশ চেপেছিলো সতর্ক সংকল্প। এই মাঝরাতে তোমার উপস্থিতি যেন সব নতুন করে সাজানোর প্রতিজ্ঞা। আমাদের সম্পর্কের মতোই অতিমাত্রায় বাস্তব আর সত্য ছিলো তোমার না ফেরা। তোমার চলে যাবার এতো সুদীর্ঘ সময় পেরোলেও কোনোদিন আমার স্বপ্নে ভীড়নি তুমি। সব উল্টে পাল্টে আজ হঠাৎ কেন জাগালে আমায়? নতুন লিখা সৃষ্টির তোমার সেই আকুল করা অনুরোধের ঘোর যেন কাটছে না। লিখতে পারার শক্তির বিনিময়ে হলেও স্বপ্নে তোমার সঙ্গ অথবা বাস্তবে ঘটে চলা ঘুম ভাঙ্গা ঘোর চিরস্থায়ী হোক। আমি যে এখনো তোমার স্বপ্নে বিলীন।