somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মাদ্রাসা জীবন-০২

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০০২ সালের কথা। দ্বিতীয়বারের মতো পঞ্চম শ্রেণিতে বসলাম। রোল নম্বর এক হওয়াতে সহপাঠিদের মূল্যায়ন এবং স্যারদের ভালোবাসা আমাকে আর স্টাডি গ্যাপের কথা মনে করতে দিলো না। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির সবচেয়ে ভয় ছিলো গনিত আর বিজ্ঞান স্যারকে নিয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে সেসময় আব্দুল মজিদ নামে এক স্যার ছিলেন। যিনি গনিত ও বিজ্ঞান পড়াতেন। মজিদ স্যার খুব ভালো পড়াতেন ঠিকই তবে পড়া না পারলে এমনভাবে মারতেন যেন গরু পিটাচ্ছেন! তার ক্লাশ যারা আগে করেছে তারা বলতো স্যারের ভয়েই নাকি পড়া গুলিয়ে ফেলতো অনেকে। শেষমেশ ভাগ্যে জুটতো পাকা বাঁশের শক্ত বেতের বারি। এমনকি মাঝে মাঝে এক-দুইটা বেতে হতো না। ভাগ্য ভালো, আমরা যখন পঞ্চম শ্রেণিতে উঠি সেই মজিদ স্যার তখন অন্য আরেকটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে যায়।

ক্লাসের সময়গুলো ভালোই যাচ্ছে। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাতে আমার ধারে কাছেও কেউ নেই। আরবী কিংবা গনিত সব বিষয়েই এগিয়ে থাকতাম। পয়ত্রিশ ছাত্রের মাঝে আমার প্রতিযোগিতা হতো দুই রোল নম্বরের সাথে। আমাদের দু'জনের মোট নাম্বারের ব্যবধান সবসময় ১০ -২০ থাকতো। লেখাপড়ার মাঝে এক ধরনের ফ্লো পাচ্ছিলাম। আনন্দেই কেটে যাচ্ছিলো সময়গুলো।

আমাদের সময় "হাতেরকাজ" দেবার প্রচলন ছিলো। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সবার কাছ থেকে বার্ষিক পরীক্ষার পর হাতেরকাজের নাম করে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিস নেয়া হতো। এখন নেয়া হয় কিনা জানিনা। এর জন্য আলাদা ২৫ নম্বর দেয়া হতো। হাতেরকাজের মানের উপর নম্বর কম বেশি হতো। শুধু যে মাদ্রাসাতেই এই নিয়ম প্রচলন ছিলো তা নয়। স্কুলগুলোতেও ছিলো একই অবস্থা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তু ১২০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে পরিমান হাতেরকাজ উঠতো তাতে করে স্যারদের সাড়া বছর ঘরের ওসব জিনিসপত্র কেনার দরকার হতো না। কোন কোন স্যার তাদের ভাগেরটা বিক্রিও করে দিতেন। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ক্লাশের সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার কেউ হাতের কাজ দেবো না। আমাদের যুক্তি ছিলো, আমরা নিজ হাতে যা বানাতে পারি সেটাই আমাদের হাতেরকাজ, কিনে এনে যদি কিছু দেয়াই হয় সেটা কি করে হাতেরকাজ থাকে? ছাত্রজীবনের প্রথম বিদ্রোহও বলতে পারেন। আমার সাথে প্রায় সবাই একই সিদ্ধান্ত নিলো। যার রোল নাম্বার দুই ছিলো সেও আমার প্রস্তাবে রাজি। তার নাম ছিলো আবু সাঈদ। মনে মনে খুশি লাগছে খুব। জীবনের প্রথম বিদ্রোহতেই জয়ী!

বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি.....। ক্লাস নেই, পড়া নেই শুধু খেলা আর খেলা। বিকেল বেলা সমবয়সীদের সাথে পাড়ার মাঠে এমন কোন খেলা নেই যে খেলিনি। বউছি, গোল্লা, দাড়িয়াবান্দা, কাবাডি, কপাল টোকা, লুকোচুরি .......... আরো যে কত! সন্ধ্যায় খেলা শেষে পুকুরে দলবেঁধে গোসলের কথা এখনো মনে পড়ে। কি সুন্দর আর নিষ্কলুষ ছিলো সময়টা!

ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে রেজাল্ট। পাঞ্জাবী-প‌্যান্ট পড়ে, টুপিটা পকেটে ভরে সকাল সকাল মাদ্রাসায় হাজির। মাদ্রাসায় যাবার পর যা শুনলাম তাতে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি যেন সরে গেলো! আমার রোল নম্বর নাকি দুই হয়েছে! যার দুই ছিলো তার এবার এক! যে খুশি নিয়ে মাদরাসায় রেজাল্টের জন্য এসেছিলাম সেই আনন্দের ঝিলিক মুখ থেকে বিদায় নিলো নিমিষেই। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো মাটি দু'ভাগ করে ভেতরে ঢুকে যাই! ফলাফল প্রকাশিত হবার আগে সংবাদটা দিয়েছে মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকা বড় ভাইয়েরা, যারা সেবছর দাখিল পরিক্ষার্থী ছিলো। আমার রোল নম্বর দুই হয়েছে শুনে যতটা না কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়ে কষ্ট পেলাম বড় ভাইদের দেয়া তথ্য থেকে। তারা আমাকে বললো, আমি হাতেরকাজ দেইনি বলে নাকি রোল নস্বর দুই হয়েছে। অবাক ব্যাপার! কেউই তো হাতেরকাজ দেয়নি। আবু সাঈদও না। তাহলে? তাহলে কি আবু সাঈদ আমার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে? বড় ভাইয়েরা আরো জানালো, আবু সাঈদ গোপনে এসে হাতের কাজ দিয়ে গেছে! আমার মাথায় হাত! মাত্র ত্রিশটা টাকার জন্য রোল এক থেকে বঞ্চিত হলাম! এ যেন আমার চোখে দেখা সাক্ষাত মীরজাফর!

আমার মুখের অবস্থা তখন প্রায় কেঁদে দেবার মতো। বড় ভাইয়েরা তখনো সামনে দাঁড়ানো। সবাই আমাকে আশ্বস্ত করলো। বললো, "হাবিব, চিন্তা করোনা, তোমার রোল নম্বর আমরা দুই হতে দেই নি। আমরা নিজেরাই একটা প্লাস্টিকের জগ কিনে তোমার নামে হাতেরকাজ দিয়েছে। ৪৫ টাকা খরচ হয়েছে মাত্র।" কথাটা শুনে তাদেরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আবেগে। এতক্ষণ শান্ত থাকলেও বড় ভাইদের কথা শুনে চোখের পানি একাই পরছিলো। মনে হলো একজন বন্ধু চিনলাম। আর একজন মীরজাফরকে........!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৭
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×