২০০২ সালের কথা। দ্বিতীয়বারের মতো পঞ্চম শ্রেণিতে বসলাম। রোল নম্বর এক হওয়াতে সহপাঠিদের মূল্যায়ন এবং স্যারদের ভালোবাসা আমাকে আর স্টাডি গ্যাপের কথা মনে করতে দিলো না। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির সবচেয়ে ভয় ছিলো গনিত আর বিজ্ঞান স্যারকে নিয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে সেসময় আব্দুল মজিদ নামে এক স্যার ছিলেন। যিনি গনিত ও বিজ্ঞান পড়াতেন। মজিদ স্যার খুব ভালো পড়াতেন ঠিকই তবে পড়া না পারলে এমনভাবে মারতেন যেন গরু পিটাচ্ছেন! তার ক্লাশ যারা আগে করেছে তারা বলতো স্যারের ভয়েই নাকি পড়া গুলিয়ে ফেলতো অনেকে। শেষমেশ ভাগ্যে জুটতো পাকা বাঁশের শক্ত বেতের বারি। এমনকি মাঝে মাঝে এক-দুইটা বেতে হতো না। ভাগ্য ভালো, আমরা যখন পঞ্চম শ্রেণিতে উঠি সেই মজিদ স্যার তখন অন্য আরেকটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে যায়।
ক্লাসের সময়গুলো ভালোই যাচ্ছে। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাতে আমার ধারে কাছেও কেউ নেই। আরবী কিংবা গনিত সব বিষয়েই এগিয়ে থাকতাম। পয়ত্রিশ ছাত্রের মাঝে আমার প্রতিযোগিতা হতো দুই রোল নম্বরের সাথে। আমাদের দু'জনের মোট নাম্বারের ব্যবধান সবসময় ১০ -২০ থাকতো। লেখাপড়ার মাঝে এক ধরনের ফ্লো পাচ্ছিলাম। আনন্দেই কেটে যাচ্ছিলো সময়গুলো।
আমাদের সময় "হাতেরকাজ" দেবার প্রচলন ছিলো। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সবার কাছ থেকে বার্ষিক পরীক্ষার পর হাতেরকাজের নাম করে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিস নেয়া হতো। এখন নেয়া হয় কিনা জানিনা। এর জন্য আলাদা ২৫ নম্বর দেয়া হতো। হাতেরকাজের মানের উপর নম্বর কম বেশি হতো। শুধু যে মাদ্রাসাতেই এই নিয়ম প্রচলন ছিলো তা নয়। স্কুলগুলোতেও ছিলো একই অবস্থা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তু ১২০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে পরিমান হাতেরকাজ উঠতো তাতে করে স্যারদের সাড়া বছর ঘরের ওসব জিনিসপত্র কেনার দরকার হতো না। কোন কোন স্যার তাদের ভাগেরটা বিক্রিও করে দিতেন। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ক্লাশের সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার কেউ হাতের কাজ দেবো না। আমাদের যুক্তি ছিলো, আমরা নিজ হাতে যা বানাতে পারি সেটাই আমাদের হাতেরকাজ, কিনে এনে যদি কিছু দেয়াই হয় সেটা কি করে হাতেরকাজ থাকে? ছাত্রজীবনের প্রথম বিদ্রোহও বলতে পারেন। আমার সাথে প্রায় সবাই একই সিদ্ধান্ত নিলো। যার রোল নাম্বার দুই ছিলো সেও আমার প্রস্তাবে রাজি। তার নাম ছিলো আবু সাঈদ। মনে মনে খুশি লাগছে খুব। জীবনের প্রথম বিদ্রোহতেই জয়ী!
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি.....। ক্লাস নেই, পড়া নেই শুধু খেলা আর খেলা। বিকেল বেলা সমবয়সীদের সাথে পাড়ার মাঠে এমন কোন খেলা নেই যে খেলিনি। বউছি, গোল্লা, দাড়িয়াবান্দা, কাবাডি, কপাল টোকা, লুকোচুরি .......... আরো যে কত! সন্ধ্যায় খেলা শেষে পুকুরে দলবেঁধে গোসলের কথা এখনো মনে পড়ে। কি সুন্দর আর নিষ্কলুষ ছিলো সময়টা!
ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে রেজাল্ট। পাঞ্জাবী-প্যান্ট পড়ে, টুপিটা পকেটে ভরে সকাল সকাল মাদ্রাসায় হাজির। মাদ্রাসায় যাবার পর যা শুনলাম তাতে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি যেন সরে গেলো! আমার রোল নম্বর নাকি দুই হয়েছে! যার দুই ছিলো তার এবার এক! যে খুশি নিয়ে মাদরাসায় রেজাল্টের জন্য এসেছিলাম সেই আনন্দের ঝিলিক মুখ থেকে বিদায় নিলো নিমিষেই। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো মাটি দু'ভাগ করে ভেতরে ঢুকে যাই! ফলাফল প্রকাশিত হবার আগে সংবাদটা দিয়েছে মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকা বড় ভাইয়েরা, যারা সেবছর দাখিল পরিক্ষার্থী ছিলো। আমার রোল নম্বর দুই হয়েছে শুনে যতটা না কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়ে কষ্ট পেলাম বড় ভাইদের দেয়া তথ্য থেকে। তারা আমাকে বললো, আমি হাতেরকাজ দেইনি বলে নাকি রোল নস্বর দুই হয়েছে। অবাক ব্যাপার! কেউই তো হাতেরকাজ দেয়নি। আবু সাঈদও না। তাহলে? তাহলে কি আবু সাঈদ আমার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে? বড় ভাইয়েরা আরো জানালো, আবু সাঈদ গোপনে এসে হাতের কাজ দিয়ে গেছে! আমার মাথায় হাত! মাত্র ত্রিশটা টাকার জন্য রোল এক থেকে বঞ্চিত হলাম! এ যেন আমার চোখে দেখা সাক্ষাত মীরজাফর!
আমার মুখের অবস্থা তখন প্রায় কেঁদে দেবার মতো। বড় ভাইয়েরা তখনো সামনে দাঁড়ানো। সবাই আমাকে আশ্বস্ত করলো। বললো, "হাবিব, চিন্তা করোনা, তোমার রোল নম্বর আমরা দুই হতে দেই নি। আমরা নিজেরাই একটা প্লাস্টিকের জগ কিনে তোমার নামে হাতেরকাজ দিয়েছে। ৪৫ টাকা খরচ হয়েছে মাত্র।" কথাটা শুনে তাদেরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আবেগে। এতক্ষণ শান্ত থাকলেও বড় ভাইদের কথা শুনে চোখের পানি একাই পরছিলো। মনে হলো একজন বন্ধু চিনলাম। আর একজন মীরজাফরকে........!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৭