সকাল প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে। মাদ্রাসার ক্লাসরুমের পার্টিশন খুলে হলরুম বানানো হয়েছে। শিক্ষক-অবিভাবক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ফলাফল প্রকাশের দিনটিকে অন্যরকম আনন্দ আর উৎকন্ঠায় পূর্ণ করে তুলেছে। কোরআন তেলাওয়াত আর ইসলামী সংগীতের পর প্রারম্ভিক কথা শেষ করেছেন মাদ্রাসার সভাপতি মহোদয়। এবার ফলাফল ঘোষণার পালা। রুম ভর্তি মানুষ অথচ পিনপতন নিরবতা। টিনের চালে একটা শুকনো পাতার শব্দও যেন কানে এসে পৌঁছে। ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ শ্রেণির ফলাফল ঘোষণা শেষ। ফলাফল ঘোষণার সাথে সাথে যাদের রোল নম্বর এক, দুই ও তিন হচ্ছে সবাইকে সভাপতি মহোদয় পুরষ্কৃত করছেন। এবার আমাদের পালা। মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে, "এবার পঞ্চম শ্রেণি থেকে যারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠছে তাদের ফলাফল ঘোষণা করছি!" ঘোষণা শুনে বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা ধরে রাখা কষ্ট হচ্ছে। "রোল এক, হাবিবুর রহমান!" মাইকের আওয়াজ কানে আসলো ঠিকই কিন্তু আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। উঠে দাঁড়ালাম পুরষ্কারের জন্য। শেষ হলো প্রতিক্ষার প্রহর। পনের নম্বরের ব্যবধানে প্রথম হলাম। প্রথম হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু করবো এবার।
স্বপ্নের ষষ্ঠ শ্রেণি। যেখানে আরো দুইবছর আগে বসার কথা ছিলো। আজ একটুও আফসোস নেই। দুই বছর হারানোর কথা এখন আর মনে হয়না। কিছু পেতে চাইলে কিছু হারাতেই হয়। আমার জন্য হয়তো এটাই ভালো ছিলো।
আমাদের সময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলা আর ইংরেজি ছিলো ১০০ নাম্বারের। কোন ২য় পত্র ছিলো না। সহপাঠি চাচাতো ভাইদের ঘরে যখন যেতাম, দেখতাম বাংলা ১মপত্র-২য় পত্র, ইংরেজি ১মপত্র-২য়পত্র। তখন খুবই ইচ্ছে করতো ২য় পত্র পড়ার। ইংরেজিতে ন্যারেশন, ভয়েস চেঞ্জ, আর্টিকেল সহ কত কত টার্ম ছিলো....। মাদ্রাসায় এর কোনটায় পাঠ্য নয়। বাংলাতেও একই অবস্থা। ২০০ নাম্বারের বাংলা ইংরেজি কোন দিনই পড়া হয়ে উঠেনি। এখন অবশ্য বাংলা ইংরেজিতে ২য় পত্র চালু করা হয়েছে।
সিলেবাসে না থাকলে কি হবে, ইংরেজি স্যার ২য় পত্রের টার্মগুলো আমাদের পড়াতেন। সপ্তাহে দুইদিন মাত্র। কিন্তু অনেক ছাত্রই বলতো, "এগুলো পড়ে কি হবে? পরিক্ষায় আসবেনা কিছুনা..." কিন্তু স্যার আমাদের বুঝাতেন, "আজ হয়তো তোমরা এর উপকার পাবেনা কিন্তু একদিন ঠিকই মনে হবে।" আজ বুঝি স্যারের কথা কতটা বাস্তব ছিলো।
আরবিতে দুই পত্র, সামাজিক বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান, কোরআন, হাদিস আর স্কুলের ইসলাম শিক্ষার আদলে একটু বড় পরিসরে ছিলো আকাইদ ও ফিকাহ। গনিতে বীজগনিত, পাটিগনিত আর জ্যামিতি ছিলো স্কুলের অনুরূপ। কিন্তু হলে কি হবে, মাদ্রাসার নাম শুনলেই লোকে যে নাক ছিটকাতো তা আমার সময়েও ছিলো। "স্কুল থেকে ফেল করে এসে মাদ্রাসায় দুই বছর পড়েই কিভাবে দাখিল পাশ করে?" এই প্রশ্ন তখন মাদ্রাসায় পড়ুয়া আমাদেরকে ছোট করে রেখেছিলো। আমিও চিন্তা করতাম, কিভাবে সম্ভব পাশ করা? কোন উত্তর খুঁজে পেতাম না!
আরবি ২য় পত্রে তাহক্বীক-তারকীবের মতো কঠিন টার্ম, আরবি হতে বাংলা-বাংলা হতে আরবিতে অনুবাদ, আরবি সাহিত্যের বড় বড় প্রশ্ন মোটেই সহজ ছিলো না। বর্তমানে তারাই ভালো তাফসীর করেন যারা আরবি ব্যকরণে পাকা ছিলেন। সেই সমস্ত হুজুরেরাই জাতির মধ্যে বিভেদ তৈরি করেন যারা ফাঁকি-ঝুকি দিয়ে পাশ করেছে। এমবিবিএস ডাক্তার যদি কোন বিষয় না শেখে ঐ বিষয়ে চিকিৎসা দেন তাহলে যেমন হয় ঠিক তেমন অবস্থা হয় কাঠ মোল্লাদের বেলায়। আমাদের আরবি স্যার প্রায়ই বলতেন, "ভালো করে পড়। নইলে তো কাঠ মোল্লা হয়ে জাতির মধ্যে মারামারি লাগাবি!" চিকিৎসায় ভুল হলে একজন মানুষ মরবে কিন্তু কোরআন হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা যে পুরো জাতিকে মারতে পারে। আজ হচ্ছেও তাই............।
আকাঈদ ও ফিকাহ পড়াতেন এক ম্যাডাম। কেমন পড়াতেন সে বিষয়ে যাবো না, কিন্তু তিনি শিক্ষিকা না হয়ে সংবাদ পাঠিকা হলে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন তা আমি নিশ্চিত। বেচারি দেখে দেখেও রিডিং পড়া ভুল করে ফেলতেন। বইয়ে যা আছে তার বাইরে একটা অক্ষর কম কিংবা বেশি লিখলেই খবর আছে। পড়া ধরতেনও বই দেখে পরিক্ষার খাতা দেখার সময়ও বই দেখে লাইন বাই লাইন মিলাতেন। কি যে বিপদে পরেছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে! ম্যাডাম আবার আমাদের মাদ্রাসার সহকারি প্রধান শিক্ষকের সুযোগ্য কন্যা। তিনি মারতেন না খুব একটা, কিন্তু গ্রাম্য ভাষায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে কথা বলতেন। সবাই কথার ভয়েই পড়া মুখস্থ করে আসতো।
কুরআনের একজন দুই নাম্বার হুজুর নিয়ে আমরা ট্রল করতাম ইচ্ছা মতো। ক্লাসে পান চিবাতে চিবাতে আসতেন আর এসেই মেয়েদের দিকে ঘুরে পড়ানো শুরু করতেন। ঘন্টা বাজা অবধি ছেলেদের দিকে তাকাতেন না। একদিন স্যারের নামে দিলাম প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ। যে স্যার কোনদিন বেত নিয়ে আসেন না, সেই স্যারের হাতে বেত দেখে সেদিন সবাই নড়ে-চড়ে বসলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। দুই একজন বাদে সবার পিঠেই পড়লো বেতের বারি। এই একমাত্র স্যার ছিলো ফাঁকিবাজিতে চ্যাম্পিয়ন।
সে বছর নতুন গনিত স্যার এসেছে মাদ্রাসায়। স্যার দেখতে খুবই হ্যান্ডসাম ছিলেন। পড়াতেনও খুব ভালো। ষষ্ঠ শ্রেণির বীজগনিত-পাটিগনিত খুবই সহজ করে বুঝাতেন। আমাদের অনেকের কাছেই স্যার প্রিয় হয়ে উঠলেন অল্প ক'দিনের মাঝেই। নতুন গনিত স্যার ছিলেন খুবই মিশুক প্রকৃতির। আর এ স্বভাবের কারনেই মাদ্রাসার সবার কাছে স্যার হয়ে উঠলেন পরিচিত নাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:১৪