আজকে আমার বাবা তিন নম্বর মাকে ৩য় বারের মতো বিয়ে করছে। আমার মনে মোটেও আনন্দ নেই। জন্মদাত্রী মা এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবার পর ২য় মাকে পেয়েছিলাম আমার মায়ের মতো আদুরে। ঠিকমতো গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পারানোর মতো সব কাজ ২য় মা-ই করতেন। কিন্তু কখনো শাসন করতেন না। আমার বাবা তো তার নিজের তালেই আছে। রাতে কখন আসে তা দেখিনি, তবে বেলা বারোটার সময় ঘুম থেকে যখন আমার ২য় মা ঢেকে উঠাতেন তখন দেখতাম বাবা খুব রাগ করতেন। একটা দিনও ঝগড়া ছাড়া তাদের কাটতো না। ৩য় মায়ের সাথে বাবার যে খুব মিল সেটাও নয়। এই নিয়ে দুইবার তালাকও দিয়ে দিয়েছেন।
বাবা যখন আমার মাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে আনেন তখন আমার দাদা জীবিত ছিলেন। দাদাই মাকে এ বাড়িতে এনেছিলেন বাবার জন্য। আমার মা দেখতে মোটেই সুন্দরি ছিলেন না। তার বাড়ির অবস্থা যে খুব ভালো ছিলো তাও না। তবুও আমার নানা মাকে বিয়ে দেয়ার সময় পঞ্চাশহাজার টাকা যৌতুক দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে বাড়ির কাছে একখন্ড জমি কিনেন আমার দাদা। সাথে একটা দুধেল গাভি। আমার দাদার সংসার স্বচ্ছল ছিলো না। দাদা ভাবছিলেন তার ছেলে বিয়ে করার পর হয়তো সংসারের কাজে মন বসাবে। কিন্তু তার সে আশায় গুড়েবালি। বাবা আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলো। রাত বিরাতে বাড়িতে আসতো আগের মতোই। একেকদিন একেক মোটর সাইকেল নিয়ে বাড়িতে আসতো। মা কিছু বললেই ধরে ধরে মারতো। মা শুধু বসে বসে কান্না করতো। আর আমি মায়ের আচল দিয়েই মায়ের চোখ মুছে দিয়ে শুধু বলতাম, "কান্না করো কেন মা?"
আমার মা যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলো তখন থেকেই মায়ের একটা সমস্যা ছিলো। চোখে কম দেখতো। সম্ভবত ছানি পড়েছিলো চোখে। অল্প ট্রিটমেন্টেই সেরে যেতো হয়তো কিন্তু পোড়া কপালে মায়ের ভাগ্যে সেটুকুও জুটেনি। আমার জন্মের পর মায়ের সমস্যা আরো প্রকট হতে লাগলো। রান্না করতে গিয়ে কতদিন যে মা মার খেয়েছে বাবার হাতে তার ইয়াত্তা নেই। গাছের শুকনো পাতা কখনো কখনো রান্না করা তরকারিতে নাকি পেতো বাবা। আর সেকারনেই মায়ের পিঠে পড়তো কিল-ঘুষি। একবার তো মায়ের বুক বারবর লাথি মেরে অজ্ঞানই করে দিয়েছিলো বাবা। তবুও মা কোনদিন নানা বাড়ি গিয়ে নালিশ পর্যন্ত করে নি।
আমি তখন খুব ছোট। বাবা যখন মাকে বকাঝকা করতো মা বলতো, "বাবা, পোলাপানদের সাথে খেলতে যাও।" তখন বুঝতাম না মা কেন আমাকে খেলতে যেতে বলতেন। মা হয়তো জানতেন তার উপর বাবার পা উঠবে এখন। আমি দেখলে ভয় পেয়ে যাবো হয়তো। কিন্তু সব সহ্য করেও তো মায়ের ঠাঁই হলো না এ বাড়িতে।
বাবা তখন জুয়ার আসরে যাতায়াত ছিলো নিয়মিত। কখনো কখনো জিতে যেত, কখনো বা সব দিয়ে আসতো। মায়ের কাছে আরো টাকা দাবী করে বসলো একদিন। আমার মাকে বলে, "কানার বাচ্চা কানা, তর বাপের বাড়ি গিয়ে টাকা নিয়ে আয়।" মা শুধু এতটুকুই বলে, "ও বাড়িতে টাকা কই পাবে? আবার কি জমিদারী আছে নাকি?" আর কই যাবি! মুখে যা আসে তা বলে গালিগালাজ তো করলোই সাথে সব রাগ ঢাললো মায়ের পিঠে। ওমাগো, বাবাগো বলে চিৎকারে পাড়ার মানুষ জোটে গেলো। আমি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁপছিলাম। আমার দাদি ফিরাতে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু তাকে মেরে আহত করেছিলো আমার পাষন্ড সে মানুষটি।
মা নাকি চোখে দ্যাখেনা, রান্না করতে পারে না, কানা.......। বিভিন্ন দোষ ধরে মাকে তালাক দেয়ার বন্দোবস্ত করে। আমার দাদা ততোদিনে ভব সংসার ত্যাগ করেছেন। বাবা একদিন শালিস ডেকে মাকে তালাক দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার মায়ের চোখে সেদিন ছিলো নির্বাক চাহনি। আমি যে তার ছেলে তা হয়তো সেদিন ভুলেই গিয়েছিলেন। আশি হাজার টাকা কাবিনে ধার্য ছিলো। তাই দিয়েই মাকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করা হলো। মা আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু কি মনে করে যেন আমি গেলাম না তার সাথে। এ বাড়িতেই থেকে গেলাম। তখন বুঝিনি বলেই হয়তো। শুধু সমবয়সীদের সাথে খেলা আর সময়মতো খাবার পেলেই খুশি থাকতাম সেসময়। তাইতো শাসনবিহীন সময়টাকে বেশ উপভোগ করতাম। আমার মা যাবার সময় দাদীর সেকি হা হুতাশ..........! কিন্তু বাবা নামক মানুষটি কারো কথা শুনেনি।
তালাক হয়ে যাবার অল্প ক'দিন বাদেই আমার মায়ের বিয়ে হয়েছে আবার। সেখানে নাকি এক সন্তানও হয়েছে। মা এখন সুখেই আছে। কিন্তু আমি আছি নরক যন্ত্রনার মাঝে। তবুও থাকবো। বাবা নামক মানুষটাকে শেষ দেখার আশায় আছি। তার সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত দেখার আশায়। তালাক দেবার পর নতুন বিয়ে করে বউ আনবে বাবা, মায়েরাও বিয়ে করে সুখে থাকবে। মাঝখান থেকে আমার মতো সন্তানেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে।
মা চলে যাবার পর সপ্তাহ না ঘুরতেই বাড়িতে নতুন মায়ের আগমন ঘটলো। যেমন সুন্দরি তেমনি তার ব্যবহার। শুধু দোষের মধ্যে ছিলো তিনি তালাকপ্রাপ্তা। গুনে তার কমতি ছিলো না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কতবার যে মারামারি করেছে তার হিসাব রাখিনি। এ লড়াই আরো তীব্র। আগের মা প্রতিবাদ করতোনা বলে হয়তো এতো বেশি হতো না, কিন্তু নতুন মা ছেড়ে কথা বলে না। খুবই প্রতিবাদী নতুন মা আমার কাছে মা দূর্গা হয়ে এসেছিলেন মনে হয়। মাঝে মাঝে এই ২য় মায়ের সাথে কিছুতেই পেরে উঠতো না আমার বাবা। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা এবার নতুন ফন্দি আঁটলো। মানুষের মাঝে ২য় মাকে চোর হিসেবে প্রচার করতে লাগলো। বাবার পকেট থেকে মা নাকি টাকা চুরি করে। আবার বছর ঘুরে এলে নতুন মায়ের কোন সন্তান হয়না দেখে তাকে বাঞ্ঝা বলেও প্রচার করতে লাগলো। সব মিলিয়ে নতুন মা এ বাড়িতে যেন আর থাকতে না পারে সে ব্যবস্থা করে ফেললো আমার বাবা। নতুন মা নেয়াহেত ভালো ঘরের মেয়ে বলে আর বাড়ালেন না কাহিনী। আবার সংসার ছেড়ে সেও চলে গেলেন। এবার সে বাবাকে ডিবোর্স দিয়ে বাঁচলেন।
বাবা যেন আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলো। আগে শুধু জুয়া খেলতো, আর এখন নাকি হেরোইন-ইয়াবার মতো মাদকের কারবার শুরু করে দিয়েছে। তাইতো নিত্য নতুন মোটর সাইকেল চালান। নেশাখোরেরা নেশার টাকা না দিতে পেরে মোটর সাইকেল দিয়েই ওসব কিনে নিয়ে যায়। আর বাবা নামক মানুষটার মুখেও চকচকে হাসি। রাজার হালে চলে।
মাস না যেতেই বাবা ৩য় বারের মতো বিয়ে করে নিয়ে আসলেন। এর সাথে নাকি আগে থেকেই যোগাযোগ ছিলো। যাকে বলে প্রেম করে বিয়ে। তিন নম্বর মা আরো সুন্দরী। সবাই শুধু বলে, ওর কাছে এতো সুন্দর মেয়ে কে বিয়ে দেয়। মানুষের কি মেয়ে বেশি হয়েছে নাকি? আমিও চিন্তা করি, বাড়িঘর দেখার খবর নাই, ছেলের চরিত্র দেখার খবর নাই, মানুষ কি করে এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে বিয়ে দেয়? বাবার চেহারা এখনো চমকায়। যেমন লম্বা তেমন শরীরের গঠন। খুবই হ্যান্ডসাম মানুষটার মুখের কথায় যেন মধু ঝরে। তাই শুনেই হয়তো মেয়েরা ভুলে যান।
তিন নম্বর মা আরো ভয়ংকর। তার সুন্দর চেহারায় যখন রাগ ফুটে উঠে কখন আরো ভয়ংকর দেখায়। দু'মাস যেতে না যেতেই বাবাকে দুই বার অজ্ঞান করেছে মেরে। বাবার কথা শুনে যা বুঝলাম তা হলো, এই নতুন মা তাকে প্রজনন অঙ্গে ধরে টান মেরেছে। আর তাতেই বাবা কুপোকাত! হা হা হা...... শুনে আমার খুবই হাসি পেয়েছে। যাক! এই তিন নম্বর মা হয়তো বাবাকে শায়েস্তা করতে পারবে। কিন্তু আমার সে আশায় ঘুরেবালি! ছয় মাস না যেতেই মাকে কাজি অফিসে গিয়ে তালাক দিয়ে দিলো বাবা। খুবই হতাশ হলাম, যখন দেখলাম নতুন মাও আপসেই চলে গেলো।
আমার ধারনা ভুল ছিলো। দুইদিন যেতে না যেতেই তিন নম্বর মা আবার এলো এবাড়িতে। বাবা তাকে কোন ভাবেই বাড়ি থেকে তাড়াতে পাড়লো না। অগত্যা নতুন মায়ের বাড়ির লোক ডেকে তাদের হাতে মেয়ে বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু মা সেদিনই রাতে আবার চলে আসলো। বাবা যখন দেখলো একে সরানো যাবে না তখন আবার বিয়ে করে ঘরে উঠালো। বাবা ভেবেছিলো হয়তো এবার জাত হবে নতুন মা। কিন্তু তিন নম্বর মায়ের আচরন অপরিবর্তিত থাকলো। বাবার সাথে ঝগড়া বাঁধলে কোন ছাড় দেন না।
ছয়মাস পরের কথা। তিন নম্বর মা কন্যা সন্তান জন্ম দিলো। নতুন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার চরিত্র হয়তো পাল্টাবে ভেবেছিলাম, কিন্তু তা হলো না। মায়ের সাথে বাবার ঝগড়া চলতেই লাগলো। মাকে আবার তালাক দিলেন বাবা। কিন্তু মা তালাক মেনে নিলেন না। কিছুতেই ছাড়লেন না এ বাড়ি। আবার নতুন মায়ের বাবা-চাচাদের ঢেকে আনা হলো। নতুন মাকে বলা হলো, সে এবাড়ির ভাত খাবে কি না। মা বললেন, "খাবো"। শালিসে বাবাকে আবার বিয়ে করতে বললেন। দু'জনের মধ্যে মিলমিশ করে দেয়া হলো আবার। আবার সংসার শুরু করলেন। ঝগড়ার সংসার। আমার মনে শুধু একটাই চিন্তা, আরো একটি সুন্দর শিশুর ভবিষ্যৎ আমার মতো অন্ধকার হলো।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ২:০৮