বাকশাল প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার ।
************************
-বঙ্গবন্ধু, আপনার রাজনৈতীক চিন্তাধারার মূলনীতি বা লক্ষ্য কি?
আমার রাজনৈতীক চিন্তা-চেতনা ধ্যান-ধারনার উৎস বা মূলনীতিমালা হচ্ছে গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূল নীতিমালার সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শোষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীনদুখি, শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবি মেহনতি মানব গোষ্ঠির মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সমষ্ঠিগত প্রকৃত ‘গনতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক’ শাষণ প্রতিষ্ঠাকরণই আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারার একমাত্র লক্ষ্য।
-বঙ্গবন্ধু, গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কি পাশাপাশি চলতে পারে?
যে গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তাকে সংখ্যালঘু ধনীক শোষকদের গনতন্ত্র বলাই শ্রেয়। এর সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ দেখা দেয় বৈকি। তবে গনতন্ত্র চিনতে এবং বুঝতে আমরা ভুল করি ।
এর কারনও অবশ্য আছে। আর তা হল শোষক সমাজ গনতন্ত্র পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করুক তা চায়না এবং গনতন্ত্রকে কিভাবে নিজেদের ব্যাক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিনত করা যায়- এখানে চলে তারই উদ্যোগ আয়োজন। এভাবেই প্রকৃত গনতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারন অজ্ঞ জনগনই শুধু নয় –তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন মানুষেরাও প্রচলিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাবস্থায় গনতন্ত্রকে বুঝতে অক্ষম । এরা ভাবে যে ভোটা-ভোটিই হল গনতন্ত্র। একটু তলিয়ে দেখেনা প্রাপ্তবয়ষ্ক মোট কত পার্সেন্ট ভোট দিল, কোন শ্রেণীর লোকজন নির্বাচণী প্রতিযোগিতায় অবতির্ণ হল, কারা রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলো, ক্ষমতাসীনেরা কোন পদ্ধতিতে তাদের শাষন করছে, সাধারন জনতা কতটুকু কি পাচ্ছে । সুতরাং, আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, প্রচলিত গনতন্ত্রের বদৌলতে মাত্র ৫% লোকের বা প্রভাবশালী ধনীকশ্রেণীর স্বৈরাচারী শাষণ ও বল্গাহীন শোষণকার্য্যের পথই প্রসস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত গনতন্ত্রের মারপ্যাচে নিম্নতম সংখ্যালঘু জনগোষ্টির শাষণ ও প্রভাব প্রতিপত্তি, সর্বপ্রকার দূর্নিতী, অবিচার অত্যাচার ও প্রতারনায় সমাজের সর্ববৃহত্তম অজ্ঞ দূর্বল মেহনতী কৃষক-শ্রমিক সাধারন মানব গোষ্টির (শতকরা প্রায় ৯৫%) মৌলিক মানবাধিকার এবং তাদের গনতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে । তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রকৃত গনতন্ত্র বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতীক ব্যাবস্থাকে বুঝি, যে ব্যাবস্থায় জনগনের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যানের নিমিত্তে তাদের জন্য, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বশ্রেণীভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাদেরই প্রকৃত শাষণ ও আর্থসামাজিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়। কিন্তু এই ব্যাবস্থা প্রচলিত গনতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। কারন প্রচলিত গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতীক ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে চলে অর্থ সম্পদের অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতা। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগনের পক্ষে এ ধরনের আর্থপ্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিই এদেরকে রাজনৈতীক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের কার্যকরি নিশ্চয়তা দিতে পারে- তাদের আর্থসামাজিক তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ জন্য আমি মনে করি প্রকৃত গনতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র। এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গনতন্ত্র নিহিত। এজন্যই আমি গনতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করু প্রকৃত গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে কোন বিরোধ নেই ।
অনেকে বলেন ‘বাকশাল’ হল আপনার একদলীয় একনায়তন্ত্র এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাষন প্রতিষ্ঠার একটি অপকৌশল ।এ সম্পর্কে আপনি পরিষ্কার মতামত দিন।
সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ পুঁজিবাদি সমাজসভ্যতা ও শোষক পরজীবিদের দৃষ্টিতে ‘বাকশাল’ তো একদলিয় শাষন ব্যাবস্থা হবেই। কারন বাকশাল কর্মসূচীর মাধ্যমে আমি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বহুজাতিক শাষক, তাদের সংস্থাসমূহের লগ্নিকারবার এবং তাদের এদেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, উঠতি ধনিক গোষ্টির একচেটিয়া শোষণ ও অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তি, দূর্নীতি-প্রতারনার বিষদাঁত ভেঙ্গে দেবার ব্যাবস্থা করছি। এজন্য তাদের আঁ-তে ঘা লেগেছে। বাকশাল ও আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদিশক্তি শাষকরা এদেশে গোপনে অর্থ যোগান দিয়ে তাদের সেবাদাস ও এজেন্টদের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি এমনকি ধর্মিয় অণুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রাচারে লিপ্ত হয়েছে। কল-কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন থানায় তাদের চরদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ, অগ্নসংযোগ, গনহত্যা, অসামাজিক কার্যকলাপ ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের ষড়যন্ত্রের কথা আমার কানে আসছে।
প্রচলিত গনতান্ত্রিক বৈষম্য, শোষন- দূর্নীতিভিত্তিক সমাজকে, দেউলিয়া আর্থসামাজিক ব্যাবস্থাকে, জরাজীর্ণ প্রশাসন ও অবিচারমূলক বিচার ব্যাবস্থাকে সমূলে উৎপাটইত করে একটি শোষণহীন, দূর্নীতিহীন, বৈষম্যহীন ও প্রকৃত গনতান্ত্রিক সাম্যবাদি সমাজ বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী নন, তারাই বাকাশাল ব্যাবস্থাকে একদলীয় স্বৈরশাষন ব্যাবস্থা বলে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু আমি এইন সব বিরুদ্ধবাদিদের বলি, এতোকাল তোমরা মুষ্টিমেয় লোক, আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ট দুখি, মেহনতি মানুষকে শাষণ ও শোষন করে আসছো। তোমাদের বল্গাহীন স্বাধীনতা এবং সীমাহীন দূর্নীতির মধ্য দিয়ে ব্যাক্তি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতার হোলিখেলায় আমার দুখি মানুষের সব আশা-আকাংখ্যা, স্বপ্ন সাধ ধুলোয় মিশে গেছে। দুখি মানুষের ক্ষুধার জ্বালা ব্যথা বেদনা, হতাশা ক্রন্দন তোমাদের পাষাণ হৃদয়কে একটুও গলাতে পারেনি। বাংলার যে স্বাধীনতা তোমরা ভোগ করছো, এই স্বাধীনতা, এই দেশ, এই মাটি ঐ আমার দুখি মেহনতি মানুষের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দলোন সংগ্রাম, জীবন মৃত্যুর বিনিময়ে প্রতিষ্টিত হয়েছে। সেখানে তোমাদের কতটুকু অবদান রয়েছে তা নিজেদের বুকে একবার হাত দিয়ে চিন্তা করে দেখো। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিরোধিতাই করেছো । বিদেশী শাষক-শোষকদের সহায়তা করেছো। নিজেদের ঘরে থেকে ভাইয়ের ঘর পুড়িয়েছো। মানুষকে হত্যা করেছো । মা-বোনদের লাঞ্ছিত করেছো, আরো কি না করেছো । এই সব করেছো ব্যাক্তিস্বার্থ উদ্ধারের ঘৃন্য লক্ষ্যে ।
আমার দেশের মাত্র ৫ পারসেন্ট লোক ৯৫ ভাগ লোককে দাবিয়ে রাখছে, শাষন শোষন করছে। বাকশাল করে আমি ঐ ৯৫ ভাগ মানুষের স্বাধীনতা, গনতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যাবস্থা করতে চাইছি। এতোকাল মাত্র ৫ পারসেন্ট শাষন করেছে, এখন থেকে করবে ৯৫ ভাগ। ৯৫ ভাগ মানুষের সুখ দুঃখ দূর্দশার সাথে এই ৫ পারসেন্টকে মিশতে হবে। আমি মেশাবোই ।
এজন্য বাকশাল করেছি। এই ৯৫ ভাগ মানুষকে সংঘবদ্ধ করছি তাদের পেশার নামে, তাদের বৃহত্তর কল্যানের নিমিত্তে,তাদের একক দল বাংলাদেশ কৃষক, শ্রমিক, আওয়ামীলীগ বা বাকশালে । মূলত বাকশাল হচ্ছে বাঙ্গালীর সর্বশ্রেণীর সর্বস্তরের গনমানুষের একক জাতীয় প্লাটফর্ম, রাজনৈতিক সংস্থা- একদল নয় ।
এখানে স্বৈরশাষনের কোন সুযোগ নেই। কারন বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সম্মিলিত ও সমষ্ঠিগত শাষন ব্যাবস্থায় কে কার উপরে শ্বৈরশাষণ চালাবে? প্রত্যেক পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে শাষন পরিষদ গঠন করা হবে। কোন পেশা বা শ্রেণী অন্য পেশার লোকদের উপরে খবরদারি করতে পারবেনা। যে কেউ, যিনি জনগনে সার্বিক কল্যানের রাজনীতিতে তথা সমাজতান্ত্রিক
সমাজ ব্যাবস্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসি, তিনি এই জাতীয় দলে ভিড়তে পারবেন।
যারা বাকশালকে একদলীয় শাষন ব্যাবস্থা বলে তাদেরকে স্মরণ করতে বলি, ইসলামে কয়টি দল ছিল? ইসলামী ব্যাবস্থায় একটি মাত্র দলের অস্তিত্ব ছিল, আর তা হল খেলাফতে রাশেদীন। মার্জসবাদও একটি মাত্র দলের অনুমোদন দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, কিউবা,ভিয়েতনাম অথবা অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে? এই সব ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকেও বাদ দেও, ওখানে মহানবীর ইসলাম নেই।
বস্তুত প্রকৃত গনতন্ত্র বা সমাজবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক সংস্থা থাকা বাঞ্ছনিয়। একটি জাতীয় কল্যানের অভিন্ন আদর্শে, ব্যাপক মানুষের সারবিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি মাত্র রাজনৈতীক দলের পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া গতান্তর নেই। কিন্তু বহুদলীয় তথাকথিত গনতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই একটা জাতীকে ঐকবাদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেখানে বহুদলে জনগন বহুধা বিভক্ত হতে বাধ্য। আর বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন, পরষ্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতি দিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যান ও সমৃদ্ধি কোনভাবেই অর্জিত হতে পারে না। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে।
-বঙ্গবন্ধু, বাকশালের মূল লক্ষ্য বা এর কর্মসূচি নিয়ে কিছু বলুন।
-বাকশালের মূল লক্ষ্য তো আগেই বিশ্লেষন করেছি। তবে এককথায় আমি যা বুঝি তা হল, একটি শোষণহীন, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শোষিতের গনতান্ত্রিক শাষণ প্রতিষ্ঠাকরন। বাকশাল কর্মসূচীকে আমি প্রধানতঃ তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। এক- রাজনৈতিক, দুই- আর্থসামাজিক, তিন- প্রশাসনিক ও বিচার ব্যাবস্থা।
এক/ রাজনৈতিক ব্যাবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লোকদের জাতীয় দল বাকশালে অন্তভূক্ত করার ব্যাবস্থা রেখেছি এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনি এলাকায় জাতীয় দলের একাধীক প্রার্থিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। জনগন তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগনের নির্বাচনে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধীকার বলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় দলের যে কোন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের অনাস্থায় প্রেসিডেন্টকে অপসারন করতে পারবেন। মন্ত্রীসভা প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের কাছে দায়ি থাকবেন। স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগনের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে।
দুই/ আর্থসামাজিক ব্যাবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমূখি গ্রাম-সমবায় প্রকল্প । এর মাধ্যমে গ্রামীন আর্থব্যাবস্থায় উন্নয়ন বা স্বনিরভর-স্বাধীন গ্রামীন ব্যাবস্থা, বিশেষ করে ভূমি সংষ্কারের প্রয়োজনিয় ও কার্যকরি ব্যাবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন ক্রিষকদের পূণর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বন্টন ব্যাবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারি শিল্পকারখানা , পরিত্যাক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বানিজ্য, ব্যাংক বীমা, যোগাযোগ ব্যাবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করন করে জনগনের যৌথ শেয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা । সীমিত ব্যাক্তিমালিকানাকে উৎসাহদানেরও ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। তবে ব্যাক্তিমালিকানাধীন সংস্থাসমূহ যাতে জনসাধারন ও তাদের শ্রমিকদে শোষন করতে না পারে তার ব্যাবস্থা থাকবে।
তিন/ প্রশাসনিক কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়, কর্পোরেশন ও বিভাগগুলোর পূনর্বিন্যাস ও পূণর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্ণর ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নিত করা হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূতিতার কারনে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় পরিষদকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জেলা ও থানাগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে থানা পরিষদ গঠন করা হবে। তবে থানা পরিষদের প্রশাসক/ চেয়ারম্যান ও জেলা গভর্নর জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। থানা প্রশাসক / চেয়ারম্যানরা ও জেলা গভর্ণররা জনগন, স্ব স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ি থাকবেন। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ- এর পরেই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গনতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রিকরন করে প্রশাসনকে জনগনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেওয়ার ব্যাবস্থা নিয়েছি। প্রশাসনিক আমলাতান্ত্র, স্টিলফ্রেম গতানুগতিক বা টাইপড চরিত্রকে ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো করে দেওয়ার ব্যাস্থা নিয়েছি। সকারি কর্মচারিরা এখন জনগনের সেবক।
বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিমকোর্টের অধিবেশন বছরে অন্তত একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্ট) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইবুনাল। প্রত্যেকটি আদালতে যে কোনো মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মিমাংসা করতে হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক শালিস বোর্ড। শালিস বোর্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। শালিস বোর্ড চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়োজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠু, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখী বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছে।
-বঙ্গবন্ধু, অনেকে বলেন, আপনি নাকি কোনো একটি পরাশক্তির চাপের মুখে বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাকশাল কর্মসূচী দিয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা নাকি সাময়িক কালের জন্য করেছেন- এ বিষয়ে আপনি অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন কি?
-কারো প্রেশার বা প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পন বা মাথা নত করার অভ্যাস বা মানসিকতা আমার নেই। এ কথা যারা বলেন, তারাও তা ভালো করেই জানেন। তবে অপপ্রচার করে বেড়াবার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই, তাই উনারা এ কাজে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। করুন অপপ্রচার। আমি স্বজ্ঞানে বিচার বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, আমার দীনদুখী মেহনতী মানুষের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আমি বাকশাল কর্মসূচী দিয়েছি। আমি যা বলি, তাই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো, মুক্ত করেছি। বলেছি শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়বো, তাই করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। কোনো কিন্তুটিন্তু নাই, কোনো আপোষ নাই।
-বঙ্গবন্ধু, বাকশাল বিরোধীমহল অর্থাৎ ঐ ৫% সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও তাদের হাতেই রয়েছে বিপুল সম্পদ। তাদের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শক্তির যোগসাজশ। তাদের পেইড এজেন্টরাই রয়েছে প্রশাসনিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাদের কায়েমী স্বার্থের উপর আপনি আঘাত হানতে যাচ্ছেন, এই অবস্থায় তারা চোখ মেলে, মুখ গুজে বসে থাকবে বলে আপনি মনে করেন? তারা তাদের অবস্থান নিরাপদ ও সংহত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না?
- আমি জানি তারা বসে নাই। ষড়যন্ত্র চলছে। প্রতিদিনই ষড়যন্ত্রের উড়ো খবর আমার কাছে আসে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীরা এসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। গোপন পথে অঢেল অর্থ এ কাজে লাগাবার জন্য বাংলাদেশে আসছে। সুকৌশলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলছে। অপপ্রচার চলছে। আমি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এ পথে নেমেছি। জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্র করে, বাধার সৃষ্টি করে, হুমকি দিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। আমার কাজ আমি করে যাবোই।
হয়তো শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরোয়া করি না। ও মৃত্যু আমার জীবনে অনেকবার এসেছে। একসিডেন্টলি আজো আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। তাই মৃত্যু ভয় আমার নেই। জনগন যদি বোঝে আমার আইডিয়া ভালো, তাহলে তারা তা গ্রহণ করবে। আমার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে। আমার একটা বড় স্বান্তনা আছে, যুদ্ধের সময় আমি জনগনের সাথে থাকতে পারিনি। জনগণ আমারই আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আজকের এই শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও থাকি, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাঙালীরা যে কোনো মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়িত করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ ”।
শেষ কথা : বঙ্গবন্ধুর এই আশা পূরণ হওয়ার নয়। সমাজতন্ত্র এখন ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে চলে গেছে, আর বাঙালী এই তন্ত্রের উপযুক্তও নয়। আমি গরীব পছন্দ করি, কারণ গরীব থাকলে আমার নিজেকে ধনী মনে হয়। দান-ভিক্ষা দিতে পারি। আমি ৫ ভাগ সুবিধাবাদীর দলে থাকতে চাই। বাকশাল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনিবার্য ছিলো, আমার কাছে মনে হয়েছে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। না হলে, বঙ্গবন্ধুকে মরতে হতো না।
নতুন প্রজন্মের কাছে আমার অনুরোধ, চীলে কান নিয়ে গেছে বলে আন্দাজে চীলের পেছনে না দৌড়ে একবার অন্ততঃ নিজের কানে হাত দিয়ে দেখুন আগে যে কানটি যথাস্থানে আছে কি নেই।
ইন্টারনেটে বিপুল তথ্যের ভান্ডার মজুদ রয়েছে। একটু সময় নিয়ে সেগুলো খুঁজে বের করাও কঠিন কিছু নয়।
আসুন, আমরা প্রকৃত সত্যকে জানি। সত্যের উপরে আস্থা রেখেই শুরু করি নিজেদের মুক্তির পুনরুদ্ধারের নতুন সংগ্রাম।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১:১৮