somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘তুমি থাকবে, তুমি আছ আমাদের নিত্য দুঃখ জয়ের’

০২ রা অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, শাসন, সোহাগসহ সবকিছু দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন কবির সংসার। শুধু গড়া নয়, আঁকড়ে রেখেছিলেন তাদের। নিত্য অভাব, দারিদ্র্যের মাঝেও হাসিমুখে সব কিছুকেই বরণ করেছিলেন তিনি। কত অপবাদ, নিন্দা, লোকগঞ্জনা, ধর্মীয় বিরূপতা একাই সয়ে যেতে হয়েছে বৈধব্য জীবনে। জামাতা ভিন্নধর্মী হলেও কন্যা এবং তিনি নিজে একই পরিবারে অবস্থান করেও স্ব স্ব ধর্ম পালন করেছেন। এজন্য অনেক ভর্ৎসনা, গঞ্জনাও সহ্য করেছেন। কিন্তু সংসার ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। টানা ২২ বছর তিনি কবির সংসার আগলে রেখেছিলেন। এমনকী দৌহিত্রদের লালন-পালনও করেছেন। কী কঠিন কঠোর দৃঢ়তা, মনোবল, শক্তি-সাহস, স্পর্ধা, মানবতা, মানবিকতা, নৈতিক মানদণ্ড, অসাম্প্রদায়িক মনোবল এবং আÍশক্তির বোধন জাগ্রত রেখেছিলেন সব সময়ই। যে কারণে দু’টি ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানকে করেছিলেন শান্তিপূর্ণ। জামাতার চিন্তা-চেতনা, লেখায় তার এ চেতনার যে এক প্রছন্ন প্রভাব ছিল, তা গভীর মনোযোগ দিলে অনায়াসে স্পষ্ট হয়। তিনি গিরিবালা দেবী।
বাঙালির জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শ্বাশুড়ীমাতা, কবি জায়া প্রমীলার গর্ভধারিণী গিরিবালা দেবী জন্মেছিলেন মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রামে। বিয়ে হয়েছিল ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েব বসন্তকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে। গিরিবালা ছিলেন বৈদ্যজাতি সম্প্রদায়ের। সে যুগে বৈদ্যরা খুব সংঘবদ্ধ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল। পরস্পরের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে আÍীয়তার বন্ধন জুড়ে থাকত। সেনগুপ্ত পরিবারের আদিবাস কুমিল্লা শহরে। সুবৃহৎ যৌথ পরিবার। বসন্ত সেনগুপ্তের আকস্মিক প্রয়াণের পর গিরিবালা দেবী একমাত্র কন্যা আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে দোলনকে নিয়ে কুমিল্লা শহরে শ্বশুরালয়ে আশ্রয় নেন। বসন্ত সেনগুপ্তের অগ্রজ ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত তখন ব্রিটিশ রাজের কর্মচারী। তার স্ত্রী বিরজাসুন্দরী দেবী ছিলেন প্রতাপশালী এবং সংসারের কর্ত্রী। ভাশুরের এ সংসারে বিধবা গিরিবালার ঠাঁই হয়েছিল এককোণে। একদিকে বৈধব্য জীবনের গ্লানি, তদুপরি পুত্র সন্তান না থাকায় বসন্ত সেনগুপ্তের উত্তরাধিকার একমাত্র কন্যা সন্তান থাকায় সহায়-সম্পত্তিপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে ওঠেছিল বৈকি। কন্যার ভবিষ্যত নিয়েও ছিলেন উদ্বিগ্ন। অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত হয়েছিলেন গিরিবালা। যে জন্য ধর্মকর্ম নয়, শ্বশুরবাড়িকেই ত্যাগ করেছিলেন। যেমন করেছেন কন্যা ও জামাতাকে অসুস্থ ফেলে রেখে সংসার ত্যাগ, শেষ বয়সে। প্রয়াত স্বামীর যৌথ পরিবারে কন্যাকে নিয়ে জীবন যাপনে অসহায়ত্বও ছিল নিশ্চয়। সেকালের বিধবাদের আর্তি ও সকরুণ কাহিনীগুলো তা-ই জানান দেয়।
১৯২১ সালে কোলকাতা শহর থেকে হঠাৎ কুমিল্লা শহরে আবির্ভূত হলেন বঙ্গে সবে পরিচিত হয়ে ওঠা কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বয়স ২১/২২ বছর। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের একদা সহপাঠী কলকাতায় বই ব্যবসায় জড়িত আলী আকবর খান কবিকে নিয়ে কুমিল্লায় আসেন। সেনগুপ্তের বাড়িতেই অতিথি হন তারা। নজরুল তার স্বভাবসিদ্ধ মধুর ব্যবহার ও মজলিশি চরিত্রের গুণে বাড়ির সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এই কুমিল্লাতেই পাল্টে যেতে থাকে নজরুলের জীবনধারা। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত শুরু হয় ভিন্ন ভাবে। আলী আকবর খান নজরুলকে নিয়ে যান নিজের গ্রাম মুরাদনগরের দৌলতপুরে। সেখানে আলী আকবর পিতৃহীন ভাগিনী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে পড়িয়ে দেন। এই স্বল্পস্থায়ী কয়েকদিনের সফরে নজরুল সৈয়দা খাতুনের নয়া নামকরণ করেছিলেন নার্গিস আসার খানম। এই বিবাহ উপলক্ষে সেনগুপ্ত পরিবারের বিরজাসুন্দরী দেবী পুত্র বীরেন্দ্র সেনগুপ্তসহ অন্যরা নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ডও ছাপা হয়েছিল কুমিল্লা শহরের প্রেস থেকে। কিন্তু বিবাহ টেকেনি। কবি বিবাহের রাতেই নৌকাযোগে সেনগুপ্ত পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন কুমিল্লায়। অত্যন্ত অপ্রস্তুত আর অপ্রীতিকর তিক্তময় পরিস্থিতির মধ্যে নজরুল দৌলতপুর থেকে চলে এলেন। সেনগুপ্ত বাড়িতেই আশ্রয় নেন। বিবাহের এই কেলেংকারিতে নজরুল তখন মর্মাহত, অপমানিত ও মানসিকভাবে খুবই বিচলিত ছিলেন। বিরজাসুন্দরী পুত্রপ্রতিম নজরুলের প্রতি ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েন এবং স্নেহ মমতা দিয়ে মর্মব্যথা দূর করার চেষ্টা করেন। নজরুল এ পরিবারের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েন সাহিত্য-সঙ্গীত, সহমর্মিতা ও স্নেহময় এক নিবিড় বন্ধনে। শহরের তরুণ সমাজের আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ কবির মানসিক অশান্তি, বেদনা দূরীভূত করতে সহায়ক হয়েছিল বৈকি। যে কারণে এখানে তিনি কবিতা ও গান লিখেছেন, গেয়েছেনও। ঠিক কী পরিস্থিতিতে নজরুল বিয়ে করেছিলেন নার্গিসকে, সেসব নিয়ে নানা কথাবার্তা আছে। তবে নার্গিসের জন্য নজরুলের মনে যে অপরাধবোধ ও বিষাদ ছিল, তা তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। অনেকদিন পরে চিঠি লিখেছিলেন নার্গিসকে। চেয়েছিলেন ক্ষমা। সেই চিঠিটি এখনও রচনা হিসেবে অনবদ্য। বিরজাসুন্দরী দেবী অবশ্য বলেছেন, নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হয়নি। শুরুতেই ঘটপট লেগে যায়। আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়নি। অবশ্য নজরুল গোড়াতে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন। কবির তখন সুডৌল বলিষ্ঠ দেহ। বড় বড় বিস্ফারিত উজ্জ্বল চোখ। মাথায় রুক্ষ দোলায়মান লম্বা চুল। সহাস্য মুখ। দীর্ঘ ঢিলা পিরান। পীত শিরস্ত্রাণ। হাতে বেণু। সবকিছু কবিকে মহিমান্বিত করে তুলত।
সেনগুপ্ত পরিবারে অবস্থানকালে কবি নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। বিরজাসুন্দরীও নজরুলের প্রতি পুত্রবৎ স্নেহ প্রদর্শন করতেন। এই বাড়িতেই নজরুল প্রথম দেখেন ১২/১৩ বছর বয়সী বালিকা আশালতা ওরফে দোলন এবং তার মা গিরিবালা দেবীকে। নজরুল তাকে মাসীমা সম্বোধন করেছেন সুস্থ থাকা পর্যন্ত। দোলনকে নজরুল সংক্ষিপ্ত করে ‘দুলি’ ডাকা শুরু করেন। নজরুল এক বিবাহ আসর থেকে চলে আসার পর আরেক জীবনে প্রবেশ করলেন যেন। ’দুলি’র প্রতি তার ভালবাসা জেগে ওঠেছিল বুঝি সেসময়। পরবর্তী সময়ে নজরুল কুমিল্লায় কয়েকবার এসেছেন। বিয়ের আগেই এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ গাঢ় হয়।
দৌলতপুর থেকে ফেরার পর সেনগুপ্ত বাড়িতে প্রায় ১৭ দিন ছিলেন। তারপর কোলকাতায় চলে যান। আবার আসেন একই বছরের নভেম্বরে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় মাসখানেক কুমিল্লার সেনগুপ্ত বাড়িতে অবস্থান করেন। ১৯২২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে আবারও কুমিল্লায় এসে অবস্থান করেন মাস চারেক। এ সময় কবিতা লিখেছেন, গানও বেঁধেছেন। কলকাতায় ফিরে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। তখনই নজরুল গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ধূমকেতু পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারবিরোধী লেখার জন্য তাকে ১৩ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাগারে তাকে ডাণ্ডাবেড়িও পরানো হয়। হুগলি জেলে থাকাকালে কয়েদিদের প্রতি বৈষম্য, উৎপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে নজরুল অনশন শুরু করেন। এক পর্যায়ে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের দাবির পক্ষে কলকাতায় জনসভা হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নজরুলকে বাঁচানোর আহ্বান জানালেন। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনশন ভঙ্গ করার আহ্বান জানিয়ে নজরুলকে টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রাম নজরুলকে দেওয়া হয়নি এবং তা ফেরত যায়। অনশন ভাঙ্গানোর জন্য রাজনীতিক থেকে বিভিন্ন স্তরের মানুষ আহ্বান জানান। কিন্তু নজরুল সিদ্ধান্ত থেকে ‘নটনড়নচরন’। অবশেষে কুমিল্লা থেকে এলেন বিরজাসুন্দরী দেবী, নজরুল যাকে সবচেয়ে বেশি ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। তিনি কারাগারে নজরুলের সঙ্গে দেখা করে লেবুর রস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করান।
টানা ৩৯ দিন অনশন করেন জেলে নজরুল। ১ বছর জেল খাটার পর ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল জেল থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে কলকাতায় না গিয়ে চলে আসেন কুমিল্লায়। বিরজাসুন্দরীর অপত্য স্নেহ তাকে আপ্লুত করে। এই বিরজাসুন্দরীকে নজরুল তার ‘সর্বহারা’ নামক সেরা কাব্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘সর্বংসহা সর্বহারা জননী আমার/তুমি কোনদিন কারো করোনি বিচার;/ কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা বারিধির/কূলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর/একাকিনী। যেন কোন পথ ভুলে আসা/ ভিন্গাঁর ভীরু মেয়ে কেবলি জিজ্ঞাসা/করিতেছে আপনারে এ আমি কোথায়?’ কিন্তু এই বিরজাসুন্দরী দেবী নজরুলের সঙ্গে আশালতার বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। কোলকাতায় বিয়ে হয়েছে সংবাদ শুনে তিনি মর্মাহতই হয়েছিলেন। বিয়ের বিরোধিতাও করেছিলেন। নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগই আর ছিল না। যেমন ছিল না গিরিবালা দেবী ও তার কন্যার সঙ্গে। তিনিও সম্ভবত আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। তবে বিরজাসুন্দরী অসুস্থ হয়ে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি হলে নজরুল তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। বিরজা দেবীর অন্তিম শয্যার পাশে বসে ভক্ত হরিদাসের মতো নামকীর্তন করেন। সঙ্গে ছিলেন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত। লিখেছেন তিনি,‘তার মুখে নামগান শুনে গৌরর্পিতাচিত্ত বিরজাসুন্দরী বল্লেন, অদ্যাপিও সংকীর্তন করে গোরা রায়/কোনো কোনো ভাগ্যবান দেখিবারে পায়।’ বিরজাসুন্দরী সেই ভাগ্যবতী।
প্রশ্ন জাগবে, নজরুল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় কেন গেলেন না? এমনকী নজরুল যে কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মুক্তি পাবেন, তা-ও জানা ছিল না, যারা তার মুক্তি ও বাঁচার দাবিতে সমাবেশ করেছিলেন। জেলে বসেই কি তবে নজরুলের বারবার মনে পড়েছে আশালতা বা দোলনা বা দুলির কথা। অথচ এ সময়ে তিনি লিখেছেন বিদ্রোহ-বিপ্লবের কবিতা ও গান। ‘দুলি’ তার স্বপ্নে বিচরণ করেছিলেন নিশ্চয়ই। ‘দুলির’ টানেই তিনি জেল থেকে কুমিল্লায় এলেন। এখানেই বোধ হয় স্থির করে ফেলেন বিবাহ সম্পর্কের। দুলিও ততোদিনে সৌম্যকান্তি কবির প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেছিল নিশ্চয়ই। ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যের ছত্রে ছত্রে আছে স্ত্রী প্রমীলা। আশালতা নাম বদলে নজরুল এই নতুন নামকরণ করেছিলেন। এই নামায়ন পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথেও দেখা যায়। ভবতারিণী দেবীর নাম রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীতে রূপান্তর করেছিলেন। ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ প্রমীলাকে উৎসর্গকালে লিখেছেন নজরুল, “দেবী তুমি সতী অন্নপূর্ণা নিখিল তোমার ঋণী/সব ত্যজি মোর হলে সাথী/ আমার আশায় জ্বলছে বাতি/তোমার পূজা বাজে আমার হিয়ার কানায় কানায়/তুমি সাধ করে মোর ভিখারিণী সেই কথা সে জানায়।/” কবির পূজারিণী, বিজয়নী, মনের মানুষ, বুঝবে সেদিন বুঝবে কবিতাগুলো এই প্রমীলাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। কেমন ছিলেন প্রমীলা উড়নচণ্ডী কবির জীবনে? কবি জসীম উদ্দীন তো প্রশংসাই করেছেন, ‘ভাবীর (প্রমীলা) মতো এমন সর্বংসহা মেয়ে বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। কবির ছন্নছাড়া শেকড়হীন জীবন। এই জীবনের অন্তঃপুরে স্নেহ-মমতায় মধুর হইয়া চিরকাল তিনি কাব্যসাধনাকে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন। কোন সময়ে তাহাকে কবির সম্পর্কে কোনও অভিযোগ করিতে দেখি নাই।’ বালিকাবধূ থেকে মাতৃরূপে প্রমীলার যে জীবন, তাতে পুত্রবধূ, মাতা, স্বামী, শুভানুধ্যায়ীদেরও কোনও অভিযোগ শোনা যায়নি।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার চারমাস পর নজরুল বিয়ে করলেন আশালতাকে। কুমিল্লায় এ বিয়ে হয়নি। নজরুলের প্রস্তাব সেনগুপ্ত পরিবার যে মেনে নেয়নি, তা বিরজাসুন্দরীর বিরোধিতাতেই স্পষ্ট। গিরিবালা গররাজি ছিলেন না। একে নিজের বৈধব্য জীবন, তার মধ্যে উঠতি বয়সী একমাত্র কন্যা, যা তারও একমাত্র সম্বল। বৈধব্য জীবনে কন্যাকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন। নজরুলকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। ডাকতেন ‘নুরু’। সেনগুপ্ত পরিবার নজরুলকে ধর্মত্যাগের জন্য প্ররোচনা দিলেও নজরুল তাতে রাজি হননি। এমনকি আশালতাকে ধর্মত্যাগে বাধ্যও করেননি। গিরিবালা কন্যাকে নিয়ে চলে যান কলকাতায়। বিবাহ আয়োজনে সেনগুপ্ত পরিবার কলকাতায় এসেও প্রচণ্ড বাধা দেয়। নজরুল ভ্র“ক্ষেপ করেননি। ভালবাসার বিজয় চেয়েছেন তিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের ঊর্ধ্বে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে নানা ধরনের লেখালেখিও হয়। গিরিবালা দেবী তো জানতেনই নজরুল দৌলতপুরেই বিয়ে করেছিলেন এবং বিচ্ছেদও ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, নজরুল ধর্মে মুসলমান এবং তিনিও তার কন্যা গোঁড়া হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ। এই দুই ধর্ম ও মতের অনুসারীদের বিবাহ সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় ছিল অকল্পনীয়। আইনের দিক থেকেও আসে বাধা। শেষতক ব্রাহ্মমতে (আহলে কেতাব) বিয়ে হয়। নজরুলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সে সময়ের সাহসী মুসলিম লেখিকা মিসেস এম রহমান (নজরুল তাকেও গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন)। নজরুলের বয়স তখন ২৪ বছর ১১ মাস আর প্রমীলার ষোল বছর। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল শুক্রবার কলকাতার ৬নং হাজি লেনের বাড়িতে নজরুল-আশালতা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহের সময়ই আশালতা নজরুলের পছন্দনীয় নাম প্রমীলা ইসলাম নামে বিয়ে করেন। বিয়েতে কাজী ছিলেন মঈনুদ্দিন হোসেন, উকিল ছিলেন আবদুস সালাম। সাক্ষী ছিলেন ওয়াজেদ আলী ও খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন। কাজী মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ এই বিয়ে পড়িয়েছিলেন।
প্রমীলার সঙ্গে বিবাহ নিয়ে মোসলেম ভারত ১৩৩১ সালের ৪ আষাঢ় সংখ্যায় খান বাহাদুর একিনউদ্দিন লিখেছেন,‘কবি নজরুল ইসলাম মুসলমান থাকিয়া হিন্দু কন্যাকে বিবাহ করিলেও আমি নিশ্চিত বলিতে পারি যে, শিক্ষিত হিন্দু কন্যা পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরীফে বিশ্বাসী এবং স্বীকারকারিণীও বটেন। সুতরাং মুসলমান ধর্মের সারমর্ম তিনি সুচারুরূপে স্বীয় জীবনের মূলমন্ত্র করিতেছেন। আশা করি নজরুল ইসলাম ও তাহার সহধর্মিণী বঙ্গদেশের চিন্তার ধারা নতুন দিকে প্রবাহিত করিবেন।’ কবি গোলাম মোস্তফাও নজরুলের এই বিয়েকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেননি। নজরুলকে নানাভাবে হেয় করার জন্য হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের গোঁড়াপন্থীরা ছিলেন সচেষ্ট।
এইচ এম ভির গীতিকার-সুরকার হিসেবে নজরুলের সাফল্য তখন প্রশ্নাতীত। গোড়াতে গজল দিয়ে শুরু হলেও শ্যামা সঙ্গীত, ইসলামী সঙ্গীত, পল্লীগীতি সব ধরনের গানই করেছেন। এ সময় তার আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। ১৯৩২ সালের অক্টোবরে এক সকালে কবির সীতানাথ রোডের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে হাজির বন্ধুবর সুফী জুলফিকার হায়দার। গিয়ে দেখেন,‘কবির বাড়িতে নেপালী দারোয়ান; গ্যারেজে দামি মোটর। বেশ শান-শওকতের সঙ্গেই তিনি ছিলেন। পরিচ্ছন্ন ধুতি-গেঞ্জি পরিহিত কবিকে তার চোখে খুব সুন্দর লাগছিল। শান্তি নিকেতনে প্রশিক্ষিত প্রথম বাঙালি মুসলমান রবীন্দ্র স্নেহধন্য শিল্পী আবদুল আহাদ নজরুলের ওই বাড়িতে গিয়েছেন। বলেছেন, ‘১৯৩৪-৩৫ সালে কাজী সাহেব সত্যিকারের স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছিলেন। এ সময় তার একটা ক্রাইসলার গাড়ি ছিল। এবং বিবেকানন্দ রোডে বেশ বড় একটি রেকর্ডের দোকান ছিল, কলগীতি। মাঝে মাঝে ট্রামে শ্যামবাজার থেকে কলেজ স্ট্রীট যাওয়ার পথে ট্রাম যেই বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে আসত অমনি চোখ দু’টি চলে যেত ‘কলগীতি’ লেখা সাইনবোর্ডের দিকে।.
পুত্রহীন গিরিবালা দেবী নজরুলকে পুত্রবৎই স্নেহ করতেন। স্রেফ জামাতা নয়। আদর করে নুরু ডাকতেন। এই নুরুর মুখে তিনি মা ডাক শুনতে চাইতেন। কিন্তু ওই যে মাসীমা গোড়াতেই নজরুল ডেকেছেন তা-ই বহাল ছিল। নজরুলের গানের স্বরলিপিকার জগৎঘটক ও সঙ্গীতের সহকারী ছিলেন তারই অনুজ নিতাই ঘটক। বহররমপুর জেল থেকে কুমিল্লা এবং কুমিল্লা থেকে কলকাতায় বিয়ের আগে আসেন নজরুল। এ সময় বিভিন্ন স্থানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বহররমপুর ঘটক পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং তাদের মা সুনীতি দেবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। আঠারো বছর নজরুলের কণ্ঠে নজরুলগীতি শোনা জগৎঘটকরা কলকাতায় আসার পর নজরুল পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ আত্মীয়তার পর্যায়ে পৌঁছে। জগৎঘটক স্মৃতিচারণায় বলেছেন,‘কবি আমাদের অগ্রজের মতো। কবি পত্মী আমাদের ‘দুলি’ বৌদি (নজরুলও ‘দুলি’ ডাকতেন)। কবির শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকে কবির মতো আমরাও মাসীমা বলতাম। মাসীমা এবং আমার মা কবিকে নুরু বলতেন। সেই সূত্রে আমরা কবিকে নুরুদা বলতাম। আমার একমাত্র বোন অকাল বিধবা গৌরীকে মাসীমা আপন সন্তানের মতো ভালবাসতেন। অনেক সময়েই কাছে রাখতেন।’
নজরুলের প্রায় সমবয়সী এবং পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যারা ছিলেন, তাদের কাছে নজরুলের উদারতা, চক্ষুলজ্জাকে অন্যতম বৈশিষ্ট্য মনে হতো। নজরুলের বাড়িতে আত্মীয়-অনাত্মীয় ভক্ত, অনুরক্তদের আনাগোনা এমনকি বসবাসও ছিল। এদের খাবারের ব্যবস্থা কবিকেই জোগাড় করতে হতো। কবি এদের উৎপাত সহ্য করেছেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো সহজ উচ্চারণটিও করতে পারেননি। কবির বাড়িতে শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের নিয়ে মাঝে মাঝেই আড্ডা বসতো। সমবয়সী ও ঘনিষ্ঠজন আয়নুল হক খাঁ লিখেছেন,‘কোথা থেকে এদের খাবারের ব্যবস্থা হবে, সে হিসেব কবির নেই। কবির শাশুড়ি ছিলেন একজন সুনিপুণা গৃহিণী। তিনি একঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক করে ফেলতেন। কবির বেহিসেবী আচরণের জন্য তার শাশুড়ি অনেক সময় বিব্রত হয়ে পড়তেন।’ এটা তো সত্য যে, গিরিবালা দেবীর মাতৃস্নেহ ছিল প্রবল। শতবাধা কণ্ঠকিত সংকীর্ণ হিন্দু সমাজের পল্লী পরিবেশের মধ্যে তার চিত্তের গহনে চিরজাগ্রত ছিল; যা নজরুলের কবি মানসকে সর্বজাতি সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে পেরেছেন। মৈত্রীয় দেবী তাই আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে, “রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি গোরার আনন্দময়ী কল্পিত চরিত্র, একমাত্র সেই কল্পনার সঙ্গেই যেন তার তুলনা মেলে, জানিনা রবীন্দ্রনাথ এই মহিমাময়ী নারীর কোন সংবাদ জানতেন কিনা; জানলে অবশ্যই তাকে অভিনন্দন জানিয়ে যেতেন।’
জাত-বেজাতের সীমা মানেননি নজরুল। ব্যক্তিজীবনে মুসলমান হয়েও বিয়ে করেছেন ব্রাহ্ম রমণী। ধর্মের স্বাধীনতাও দিয়েছেন সেই কারণেই। বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান, ভক্তিগীতে, ছেলেদের নামকরণ আচারানুষ্ঠানে কোথাও ধর্মের বেড়া মানেননি। নজরুল বলেছেন,“কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের, আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ গিরিবালাও তো দেখি এই বিশ্বাসে নজরুলের সহায়ক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ভারত সরকার বিদ্রোহী কবিকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেন। ১৯৭২-এর ২৪ মে বাংলাদেশ বিমানে কবিকে সপরিবারে ঢাকায় আনায়ন করা হয়। ধানমন্ডি ২৮নং সড়কে কবি ভবনে বঙ্গবন্ধু কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকায় তার অবস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির সুব্যবস্থা ছাড়াও মাসিক ভাতার ঘোষণা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ঢাকায় কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়েছিল, কবিভবনে জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকতো প্রতিদিন। নজরুল মাটি ও মানুষের কবি। বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তার সুনিবিড় যোগ তাকে প্রাতঃস্মরণীয় করে রাখবে এই বিশ্বাস আমাদের সবার।


মু হ ম্ম দ স বু র আহমেদের লেখা থেকে......................।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×