( ফেক্ট-ফিকশন-মিথ সবকিছুকেই ছাড়িয়ে মানুষের কথা কিন্তু কথা' ই থেকে যাবে, কোনদিন ঠিক ঠিক গল্পো হয়ে উঠবেনা । )
আমার মামার বাড়ি ছিল পাশের গ্রামে। একদম পাশেই। একটু জোরে হাঁচি দিলেই শোনা যায়। অনেকটা এইরকম, আমাদের বাড়ির পাশের ঐ উঁচু কাঠালগাছে কিংবা জাম গাছে অথবা আম গাছের উঁচু একটা ডালে উঠে হিঁসু দিলে ঠিক মামা বাড়ির তুসিবোং এ গিয়ে পড়বে। তাই ও-বাড়ির যত্তো খারাপ খবর বলুন, নোংরা খবর বলুন, আমার নাক বরাবর এসে পড়তো আর কানের পাশ দিয়ে কেউ ফিস ফাস বলে কয়ে চলে যেত। আর মা-বাবার তুমুল ঝগড়া শুরু হতো এ-পক্ষ ও-পক্ষ নিয়ে, এ-খবর ও-খবর নিয়ে। আর আমরা সন্তানেরা বইয়ের গল্পে, রূপকথায়, বিটিভির ছায়াছন্দে-ছায়াছবিতে মুখ লুকাতাম। কিন্তু কানটা ঠিকই খোলা রাখতাম, মা-বাবার ঝগড়া যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা শোনার জন্য, মাঝেমধ্যে লুকিয়ে চুকিয়ে কাঁধটা এদিক ওদিক করে দেখতাম মায়ের মতিগতি, রাগ করে আবার মামার বাড়ি চলে যায় কি-না। আর ঝগড়ার কারণতো ঐ একটাই, মায়ের ঐ বোনটা, সবার ছোট্ট "থম্বানতম্বী'"-কে নিয়েই। আজ ওখানে কি করেছে, কাল ঐখানে কি বলেছে।
'থম্বানতোম্বী' মাসিমা আমার। এক ভাই এবং পাঁচ বোনের মধ্যে সবার ছোট হলে কী হবে, কনিষ্ঠা কন্যা হবার কোনো আদর আহ্লাদ পায়নি। বড়বোনেদের একে একে যখন সবার বিয়ে হয়ে যায়, বড় ভাইটি তখন একমাত্র পুরুষ হবার সমস্ত অধিকার, সুবিধা আর সুযোগটুকু নিয়ে বেশ গোলমেলে জীবন-যাপন শুরু করেছে, তখনও 'থাম্বানতম্বী' সংসারটা বেশ গুছিয়ে রেখেছিল হাজারটা `হাবিজাবি'র মধ্যেও। স্বামীর অকাল প্রয়াণে বিধবা "ইবোক" আর তখন মুখের খই ফোটানো ছাড়া সংসারের তেমন কিছুতে নাক গলাতে পারতো না। সকালে গোয়ালঘর সামলানো, দুপুরে উঠোনের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো, ধানক্ষেত কিংবা সব্জি বাগানের টুকটাক পরিচর্যা এবং বিকেলে গরু বাছুরের তদারকিসহ সারাদিনের ব্যাস্ততা শেষে সন্ধ্যায় সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালিয়ে রাত্রির আঁধার নেমে আসার আগেই ঢুকে পড়তে নিজ শয্যায় চুপচাপ। অন্যদিকে 'মামা' আমার একমাত্র মামা হবার সুবিধেই বলুন আর বংশের একমাত্র পুরুষ হবার কারণেই বলুন, ঘড়ের কাজ এবং সংসারের কাজের প্রতি তেমন একটা গুরুত্ব দিত না, অন্য হাজারটা পুরুষ মানুষের শখ নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
কি আর করা, মাসিমা আমার এক হাতে পুরুষ মানুষের কাজ অন্য হাতে মহিলা মানুষের কাজ সামলিয়ে সংসারটাকে সামলিয়ে আরও অনেক কিছুর সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলো কিছুটা মনের তাগিদে কিছুটা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায়। এই যেমন, পাড়ার-গ্রামের এলাকার বিভিন্ন সভা সমিতি, ক্লাব কী সংঘের ছোটখাট এক্টিভিটিজ, মহিলাদের বিভিন্ন সংস্থার সাথেও নিজেক যুক্ত করতে চেষ্টা করতো। এমনকি এলাকার মনিপুরী নাট্যচর্চার সাথেও যুক্ত রাখতেন। দিনভর কাজ করে আবার "শুমাং লীলা" কী মঞ্চ নাটকের রিহার্সেলেও ঠিকই হাজির হতো। মায়ের বকুনি, বড় ভাইয়ের ধমক, বড় বোনদের চোখ রাঙানি কিংবা সমাজের নাক সিঁটকানো কোনোটাই আমলে নেননি, সবকিছুকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে দৃপ্ত পায়ে নিজের বিশ্বাসে বিশ্বাস রেখে চলতে চেষ্টা করেছেন। থাম্বানতম্বী! সে এক মানুষ বটে। না, মেয়ে মানুষ, নারী কিংবা মানবী বলতে পারছি না কোনো ভাবেই।
অনেক দিন হলো, বাবা আর মায়েতে ঝগড়া হলেও মাসিমার প্রসঙ্গ আর আসে না। আসবেই বা কীভাবে। মাসিমা আমার, সেই যে অভিমান করে এক ঘুম দিল কোনো এক সন্ধ্যাবেলায় আর জেগে উঠলো না। কী জানি, কি ঔষুধ খাইয়েছে, মাসীমার ঐ হিংসুটে শাশুড়ি টা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১০ রাত ১:২৪