নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যয়নকালে আমার সাহিত্যসাধনার সূত্রপাত। কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস- এই তিন শাখাতেই কাজ শুরু করি তখন। লেখালেখিকে জীবিকার উপায় হিসেবে বেছে নেওয়ার কথাও ভাবি। কবিতা লিখতে লিখতে ছোটগল্পে হাত দিই, ছোটগল্প লিখতে লিখতে প্রবেশ করি উপন্যাসের জগতে। তবে কোনো মাধ্যমকেই অন্য কোনোটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে দেইনি। প্রতিটির শর্ত ও দাবি পৃথকভাবে মেনে চলতাম। অল্পসংখ্যক গল্প-কবিতা পত্রপত্রিকায় এলেও উপন্যাস আলোর মুখ দেখেনি। পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলি। এরপর একগুচ্ছ দুর্ঘটনা। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টিশীলতায় নিয়ে আসে সাময়িক বিরতি। প্রায় পনোরো বছর পর পুনরায় গল্প লেখা শুরু করি। দুঃখিত, ভুল বললাম। আমি গল্প লেখি না, নির্মাণ করি পাখির বাসার মতো, ভাস্কর্যের মতো।
ইদানীং গল্প নির্মাণের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা-প্রবন্ধ ও অনুবাদকর্মে নিমগ্ন থাকি। একটা উপন্যাসও শুরু করেছি বছর দেড়েক আগে, কবে শেষ হবে জানি না। এর প্রধান কারণ বোধহয় আমার গল্পপ্রীতি। নিজেকে গল্পকার ভাবতেই অধিক স্বচ্ছন্দবোধ করি। হয়তো এজন্যই ছোটগল্পগ্রন্থ নীল দহন (২০১২), প্রণয় ও পরিত্রাণের গল্প (২০১৩) ও দর্পিত দংশন (২০১৫) ম্রিয়মাণ গল্পকারসত্তার পুনরুদ্দীপন ঘটিয়েছে, ঘটাচ্ছেও।
শিল্পোত্তীর্ণ হোক বা না হোক, এদেশে প্রতিনিয়ত লেখা হচ্ছে হরেক কিসিমের গল্প। বড়গল্প, ছোটগল্প, অণুগল্প, রম্যগল্প, রহস্যগল্প, কর্পোরেটগল্প ইত্যাদি। এসব গল্পের বেশকিছু কাহিনীনির্ভর; অল্প কিছু প্রায় কাহিনীবিহীন। বিবেকের দায়বোধ থেকে আমি চেষ্টা করছি ছোটগল্প তৈরির। তবে ছোটগল্পের তথাকথিত কোনো সংজ্ঞার ছকে ফেলে নয়। ছোটগল্পকে আমি খণ্ডিত বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ বলেই মনে করি। আমার গল্পে উঠে আসে জীবনের ছিন্নাংশ, জীবনের অন্তর্গত কোনো উপাখ্যানও। তাতে ঘটনার ঘনঘটা তেমন থাকে না; ঘটনার অন্তরালে নিহিত থাকে গল্পটি। বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে দুয়েকটি গল্পে সামান্য ব্যতিক্রম অবশ্যি আছে। তবে গল্পের ভেতরের কাহিনী লাপাত্তা হয়ে যায় না কখনও। কিন্তু শুধু কাহিনি শোনানোর জন্য আমি গল্প তৈরি করি না। জগজ্জীবনের কিছু জরুরি কথা, আমার একান্ত উপলব্ধির কথাও জানাতে চাই।
বাস্তব ও কল্পনার ভারসাম্য রা করে গল্পের পরতে পরতে জীবন্ত বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে সাধ্যমতো চেষ্টমান হই। অত্যাবশ্যক দর্শন ও মনস্তত্ত্বের সন্নিবেশ ঘটাই। পরিমিত পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতাকে তুলে আনতেও প্রয়াসী হই। গল্পের বিষয়ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিটি গল্পের আঙ্গিকেও আনতে চাই ভিন্নতা। ভাষার চিত্রকল্পময়তায় ও কাব্যময়তায় নিজস্বতা গড়ে তুলতে যতটা সম্ভব যতœবান থাকি। আমার শব্দচয়ন ও বাক্যপ্রকরণ কখনও স্বতঃস্ফূর্ত, কখনও স্বপ্রণোদিত। আমার গল্পে উপমার ছড়াছড়ি নেই; রূপকাশ্রিত ব্যাকুলতাও কম। সৌন্দর্যবৃদ্ধি কিংবা সুশ্রাব্যতার জন্য বাড়তি শব্দের প্রয়োগ নেই। বহুব্যবহৃত ম্রিয়মাণ শব্দের স্থলে দীপ্যমান প্রতিশব্দের পাশাপাশি স্ব-সৃষ্ট শব্দ থাকে। আঞ্চলিক ও অনাদৃত কিছু শব্দকে নতুন মাত্রা ও ভিন্ন ব্যঞ্জনা দিতে চেষ্টা করি। গদ্যভাষাকেও সাহিত্য-ভাষা থেকে প্রাত্যহিক জীবনের ভাষায় নিয়ে আসতে প্রচেষ্টা চালাই। এসবের পরেও পরিশীলিত গল্পনির্মাণে আমার সফলতা বিচার বিবেচনার ভার যখন নিজের ওপর অর্পণ করি তখন বুঝতে পারি কতটা অসফল আমি।
বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্পগুলো পঠনকালে প্রবলভাবে আলোড়িত হই; আহতও হই সম্যকভাবে। আমার গল্পকার সত্তার আত্মসমালোচনা আমাকে আর্ত করে। ভাষার নিটোল গতিময়তায় ও কথনকুশলতায় এখনও সৃষ্টি করতে পারিনি এমন একটি নান্দনিক গল্প যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে; যা পাঠকমানসে ইতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে ত্বরিতগতিতে। জানি না কাঙ্খিত মানের কোনো গল্প বাদবাকি জীবনে লেখতে পারবো কিনা। প্রচেষ্টা তবু চালিয়ে যাবো যদি সামান্য সফলকাম হতে পারি কোনোদিন। এ ল্েযই বোধহয়, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগে আমার গল্পগুলো বারবার সংশোধিত হতে থাকে। গ্রন্থিত হওয়ার সময় শুধু নামকরণে অপরিবর্তিত থেকে পরিমার্জিত রূপ লাভ করে।
আমার কোনো গল্পের গহিনে প্রবেশ করে পাঠক যদি একটু আনন্দ পান বা ব্যথিত হন কিংবা নিজেকে কিছুটা আবিষ্কার করেন বা হারিয়ে ফেলেন তবেই তো আমি গল্প লেখার প্রণোদনা পাই। তাই গল্পের নির্মাণ রসায়নে পঠন প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবক হিসেবেই বিবেচনা করি। আমার গল্প নিয়ে পাঠকের সমালোচনামূলক মন্তব্যকে স্বাগত জানাই। আমি চাই চুলচেরা বিশ্লেষণে আমার ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলি চিহ্নিত হোক যাতে গল্প নির্মাণে হতে পারি ক্রমাগ্রগতিসম্পন্ন। অথচ প্রশংসসূচক মন্তব্য ব্যতীত গঠনমূলক সমালোচনা তেমন পাই না।
আমার প্রণয় ও পরিত্রাণের গল্প-গ্রন্থের ফ্যাপে প্রকাশক আমজাদ হোসেন খান অত্যুক্তি করে লেখে দেন, ‘হান্নান কল্লোলের গল্পে সমকালের অজানা অচেনা সত্যের উদ্ভাস ঘটে। বাস্তবতার নানামাত্রিক সংবেদন আর সংশ্লেষণ তাঁর গল্পভাবনার প্রধান আকর। গল্পের বিষয়বস্তু মানবিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। কখনও কখনও মানবিকতা ও যান্ত্রিকতার সংঘাত প্রকটরূপ ধারণ করে। যন্ত্রণাকিষ্ট প্রায় সব কেন্দ্রিয় চরিত্রই জীবনের অর্থের সন্ধান করে, অস্তিত্বের সার্থকতা খোঁজে। তাঁর লেখায় ঝলকে ওঠে সামাজিক চৈতন্যের রূপায়ণ। তাছাড়া আভাস মিলে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও নিটোল জীবনদর্শনের। চরিত্র চিত্রণে ও কাহিনী কথনে তাঁর অনবদ্যতা লণীয়। আপন আঙ্গিকে, শীলিত শৈলীতে লেখা হান্নান কল্লোলের গল্প শুধু ভাবমূলক নয়, জ্ঞানমূলকও বটে। আমাদের প্রত্যাশা― নিবেদিতপ্রাণতায় এই লেখক যেন লিখে যান নিরন্তর।’
আসলে আমি অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, উপলব্ধি, স্মৃতি, কল্পনা, স্বপ্নÑ সবকিছু থেকেই গল্পের উপকরণ গ্রহণ করে থাকি। লেখার রসদ আহরণের জন্য ছুটে যাই যত্রতত্র। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মিশি। প্রত্য করি তাদের জীবন-জীবিকা ও আচার-অনুষ্ঠান। গণমানুষের প্রেম-বিরহ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ, প্রাপ্তি-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশার দোলাচল উপলব্ধির চেষ্টা করি। বাঙালি জাতিসত্তা, লোকাচার-জীবনাচার, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, প্রথা-প্রবণতা রূপায়ণে হতে চাই ভাস্বর।
চিন্তনে মননে প্রগতিকে ধারণ করে আমি তো চাই সুস্থ-সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে আমার গল্পেরও সামান্য ভূমিকা থাকুক। নৈর্ব্যক্তিকতায় নয়, দ্বান্ধিকতায় শ্রমশোষণ ও শ্রেণিসংঘাতের কথা উঠে আসুক। মাটি-মানুষ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জাগরণ-আন্দোলন আমার গল্পের শিকড়ে প্রাণরস জুগিয়ে যাক। নতুন প্রজন্মের চিন্তাচেতনা, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার, ধর্মনিরপেতা স্থান পাক। আমার গল্প কুসংস্কার, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক। ঝংকৃত হয়ে উঠুক মানবিকতা ও পাশবিকতার সংঘাত, মানবসভ্যতা ও আণবিকসভ্যতার সংকট।
গল্প নিয়ে আমার মাতামাতি পাগলামির পর্যায়ে পড়ে। কী সৃষ্টি করবো, কেন করবো, কীভাবে প্রকাশ করবো এসব ভেবে নিয়েই কোনো গল্পের থিমকে মাথায় আসতে দিই। ধীরে ধীরে অন্তর্জগতে তাগিদ ও যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি। এরপর অস্থির হয়ে যাই গল্পের কাহিনী বিন্যাসের জন্যে। গল্পে কী কী চরিত্র থাকবে, চরিত্রগুলো কেমন হবে, তারা কেমন আচরণ করবে, কী কী বলবে এসব মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে কী-বোর্ডে আঙুল চালাই। উপযুক্ত একটি বাক্য বা শব্দের জন্য কম্পিউটারের সামনে অনির্দিষ্ট সময় ধরে অপো করতে থাকি। যে ঘরে বসে আমি লিখি তার দরজা জানালা প্রায়শ বন্ধই থাকে। আবদ্ধ ঘরের বাইরে গল্পসংশ্লিষ্ট কোনো দৃশ্য বা ঘটনা দেখলে চোখের ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলি, মগজের পৃষ্ঠায় চিত্রিত করে রাখি। আচমকা কোনো বাক্য মনে পড়লে কাগজে, সঙ্গে কাগজ না থাকলে মোবাইলে লিপিবদ্ধ করি। বাসায় একা থাকলে এমনও সময় যায় ুৎপিপাসাকে অগ্রাহ্য করে মগ্ন থাকি গল্পলেখায় কিংবা গল্পভাবনায়। অবসরে আমার গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে মেতে উঠি আলাপচারিতায়।
ছোটগল্প নিয়ে আমার মধ্যে মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড একটা প্যাশান কাজ করে। কখনো কখনো ভাবি, আহা, আমি যদি একজন তুখোর গল্প বলিয়ে হতে পারতাম! গল্পের শুরু যেভাবে বা যেখানেই হোক না কেন, এর সুতাটাকে কীভাবে টানতে হয় এবং কোথায় নিয়ে ছেড়ে দিতে হয়, সেটা যদি ভালো করে জানতাম! প্রাঞ্জল ভাষায় হৃদয়গৃাহী বর্ণনায় আমার গল্পগুলো পাঠককে যদি সম্মোহিত করতে পারতো! গল্পের নিটোল কাহিনীটা যদি সুপ্ত বাণীময় হতো! তাহলে স্রেফ কাহিনীর আকর্ষণে যারা গল্প পড়েন তারাও গল্পপাঠের পর একাত্ম হয়ে যেতেন আমার বক্তব্য আর উপলব্ধির সঙ্গে।
আমার গল্পকার সত্তা অসম্ভব স্বপ্নও দেখে। তার ছোটগল্প একদিন সর্ববৈশ্বিক বাংলাভাষীর কাছে পাঠকপ্রিয়তা পাবে, নন্দিত হবে। একদিন সমকালকে স্বল্পপরিসরে ধরে রেখে কালোর্ত্তীর্ণ হয়ে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করবে। বাংলা সাহিত্যের পাকাপোক্ত আসনে আসীন হবে। ক্রমে জায়গা করে নেবে বিশ্বসাহিত্যে।
আনকোরা আবেগের আবহে আমার ভেতরকার গল্পকারের অনুভবগুলো ছিন্নভিন্ন। প্রকাশ করতে পারছি না বর্ণমালার ভাষায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৮