somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুই অসীমতা

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মূল: ব্লেইজি প্যাসকেল
ভূমিকা ও ভাষান্তর : হান্নান কল্লোল
[প্যাসকেলের জন্মের দুই শতাব্দী আগে থেকেই সমগ্র ইউরোপ জুড়ে চলছিল স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ঐকান্তিক প্রয়াস। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি (১৪৫৫ খ্রি.) মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এই প্রয়াসকে বৈপ্লবিকভাবে ত্বরাণ্বিত করে। প্রতিক্রিয়াশীল যাজকতন্ত্র তখন আর ভিন্ন মতাদর্শীদের হাতে লেখা দু-চারটি বই পুড়ে ফেলে তাদের কন্ঠ রোধ করতে পারতো না। হাজার হাজার ছাপানো কপির কয়েকটি ধ্বংস করা সম্ভবপর হলেও বাকিগুলো অবলীলায় পৌঁছে যেতো পাঠকদের হাতে।

সেই সময়কালে সাধারণ মানুষ ধর্ম ও কৃচ্ছসাধনের জটিলতা হতে মুক্ত হবার জন্য ধর্মোপদেষ্টাদের অন্ধসমর্থক দার্শনিকুলের বিরূদ্ধে ক্রমশ সরব হয়ে উঠতে থাকে। তাদের দাবি- দার্শনিকগণ যেন প্রহেলিকাপূর্ণ তত্ত্বপ্রদান পরিত্যাগ করে বাস্তবের মধ্যে সত্য সন্ধানে নিরত হন।

কলম্বাস (১৪৪৭-১৫০৬ খ্রি.), ভাস্কো-ডা-গামা (১৪৭৫-১৫২৫ খ্রি.) আমেরিকা ও ভারতবর্ষের পথ আবিষ্কার করায় সাধারণ মানুষ আলস্যপ্রিয় ধর্মতন্ত্রী দার্শনিকদের চাইতে কর্মবীর আবিষ্কারকদ্বয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। প্যারাসেলসাস (১৪৯৩-১৫৪১ খ্রি.) এবং ফ্যান হেলমেন্ট (১৫৭৭-১৬৪৪ খ্রি.) দার্শনিকদের উপদেশ দেন, শুধুমাত্র পুঁথির পাতায় ডুবে না থেকে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিতে। তখনকার দিনে শিক্ষায়তনগুলো ধর্মীয় অনুশাসনকারীদের দখলে থাকায় বিজ্ঞানচর্চার পথ ছিল রুদ্ধপ্রায়। লেলেসিও (১৫৭৭-১৬৪৪ খ্রি.) নেপল্সে রসায়নাগার স্থাপন করে রুদ্ধ পথের প্রথম পথিক হন। ওদিকে যাবতীয় বিমূর্ত ভাবনাকে পরিহারপূর্বক ভেসালিয়াস ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন শারীরবিদ্যা বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থ।

যুগান্তরের আগমনী বার্তায় শঙ্কিত যাজকতন্ত্র কালের অগ্রগমনকে রুখে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ করতে চাইল। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সেভেটাস এবং ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে জিওনার্দো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হলো বিজ্ঞানচর্চা তথা মুক্তবুদ্ধিচর্চাকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য। কিন্তু সময়ের দাবিকে পাশ কাটানোর সাধ্যি কারো নেই। ষোড়শ শতকে প্রথাগত বিদ্যাবিরোধী ও প্রয়োগবাদী দার্শনিকগণের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরে সমগ্র ইউরোপ মুখর হয়ে ওঠে। তাঁদের মধ্যে মন্টেইন (১৫৬২-১৫৯২ খ্রি.), টাইকো ব্রাহো (১৫৪৬-১৬০২ খ্রি.), সানচেজ (১৫৬২-১৬৩২ খ্রি.) প্রভৃতি নাম সবিশেষ স্মরণযোগ্য।

পঞ্চদশ শতাব্দীর স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়াস আর ষোড়শ শতাব্দীর ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ ইউরোপের মধ্যযুগীয় কূপমন্ডূকতা বিদূরণে বিশাল ভূমিকা রাখে। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ সপ্তদশ শতাব্দীতে অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে হলেও কিছু মুক্তবুদ্ধির সঞ্চলন ঘটে। চিন্তার রাজ্যে শুরু হয় নতুন অতিথির আনাগোনা। এই যুগের দার্শনিকদের মধ্যে দুই প্রকার সিদ্ধান্তের ধারা লক্ষ করা যায়। একদলের মতে, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ এবং প্রয়োগই (অভিজ্ঞতা) জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এঁদের বলা হয় প্রয়োগবাদী। বেকন(১৫৬১-১৬২৬ খ্রি.), হবস্(১৫৮৮-১৬৭৯ খ্রি.), লক(১৬৩২-১৭০৪ খ্রি.), বার্কলে(১৬৮৫-১৭৫৩ খ্রি.), হিউম(১৭১১-১৭৬৬ খ্রি.) এই দলের উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে অন্যতম। অপরপক্ষভুক্তরা জ্ঞানকে ইন্দ্রিয়জ বা প্রয়োগগম্য নয়, বুদ্ধিগম্য বলে মনে করেন। দার্শনিক মহলে এঁরা বুদ্ধিবাদী হিসেবে পরিচিত। দেকার্তে(১৫৯৬-১৬৫০ খ্রি.), স্পিনোজা(১৬৩৩-১৬৭৭ খ্রি.) বুদ্ধিবাদের প্রবর্তক।

ব্লেইজি প্যাসকেল(১৬২৩-১৬৬২ খ্রি.) কিন্তু দার্শনিক চিন্তায় সময়ের চাহিদাকে অনুসরণ করেননি। একেবারে ভিন্নপ্রান্তে এসে তাঁর দার্শনিক ভাষ্য এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ করলেন যা সাধারণ্যে তো বটেই বিদগ্ধজনকেও হতচকিত করে দেয়। তার বক্তব্যে তমিস্র এতটাই গাঢ় যে সেগুলোর তাৎপর্য নিরূপণ প্রায় অসম্ভব ঠেকে।

প্যাসকেল হলেন ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও দার্শনিক। পদার্থবিদ্যায় ‘প্যাসকেলের সূত্র’, গণিতশাস্ত্রে ‘প্যাসকেলের ত্রিভুজ’ প্রতিষ্ঠাকরণসহ একটি গণনযন্ত্রের উদ্ভাবন, অন্তরকলন(Diffrential Calculus)-এর উন্নয়নসাধন, ‘সম্ভাব্যতা-তত্ত্ব’ প্রণয়ন ইত্যাদি তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন। দর্শনভিত্তিক বক্ষমান প্রবন্ধটি তাঁর ব্যক্তিগত জার্নাল Pensces থেকে আহৃত- যার ইংরেজি ভাষান্তর করেছিলেন W.F Trotter, ‘The Two Infinites’ নামে। বাংলা অনুবাদে এর নাম দেওয়া হলো ‘দুই অসীমতা’।

কবির কল্পনায় ও মনোহারী ভাষায় লিখিত ‘দুই অসীমতা’ কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে তা নির্ণয়নের মানসে উপস্থাপন করা হলো। আশা করি পাঠকপ্রবর প্যাসকেলের মধ্যে যুগপৎ বিজ্ঞানমনস্কতা ও দার্শনিক চিন্তায় অসংলগ্নতা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।]

মানুষ একাগ্রচিত্তে প্রকৃতির সমগ্রতা ও বিশালতা অবলোকন করতে প্রয়াসী হোক। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিবেশিক বস্তুসমূহ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করে রাখা শাশ্বত আকাশপ্রদীপ সূর্যের দিকে দৃকশক্তি প্রসারিত করুক। সূর্যকে পরিক্রমণশীল পৃথিবী বিশাল সৌরমণ্ডলের তুলনায় একটি বিন্দু; আবার মহাকাশে পরিভ্রমণশীল তারকামণ্ডলের তুলনায় সৌরমণ্ডলও একটি সূক্ষ্ম বিন্দু- বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে মানুষ তা অনুধাবন করুক। অবলোকন ও অনুধাবন ক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকলে সে তার কল্পনাকে প্রসারিত করুক, কিন্তু প্রকৃতি কর্তৃক ধারণার রসদ সরবরাহকরণ অব্যাহত থাকলেও তার ধারণার ক্ষমতা আড়ষ্ট হয়ে আসবে। প্রকৃতির বিস্তৃত বক্ষে সমগ্র দৃশ্যমান বিশ্ব তো একটি অবোধগম্য পরমাণুমাত্র। কোনো ধারণাই প্রকৃতিকে ধারণ করতে সক্ষম নয়। তাবৎ কল্পনীয় ব্যাপ্তির বাইরেও হয়তোবা মানুষ তার ভাবনাকে সম্প্রসারিত করতে পারে কিন্তু বস্তুবাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র প্রকৃতির পরমাণু বিষয়ক ভাবনাই সম্ভব। কেননা প্রকৃতি এক অসীম গোলকÑ কেন্দ্র যার সর্বত্র, পরিধি কোথাও নেই (the centre of which is everywhere, circumference is nowhere)। সেই পরিধি নিয়ে ভাবতে গেলে কল্পনাও হার মানে।

মানুষ তার নিজের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাবৎ অস্তিত্বের সমপার্শ্বিকে নিজেকে স্থাপন করুক; প্রকৃতির সুদূর কোণে হারিয়ে যাবার কথা ভাবুক; ছোট্ট এক প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রেক্ষিতে তার পৃথিবী, দেশ, শহর ও নিজের প্রকৃত অবস্থা অনুমান করক। অসীমের মাঝে মানুষের স্বরুপ কী?

মানুষের কাছে আর একটা বিষয় সমান বিস্মকর হবে যদি সে পরিচিত কোন জিনিস নিয়ে পরীক্ষা করে। পরীক্ষণের জন্য একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা তাকে দেয়া হোক। অঙ্গ যার কত ক্ষুদ্র, আরো ক্ষুদ্র সন্ধিযুক্ত প্রত্যঙ্গগুলো। প্রত্যঙ্গের ভেতর শিরা, শিরায় ভেতর রক্ত, রক্তে গ্রন্থিরস, গ্রন্থিরসে জলকণা, জলকণায় জলীয় বাষ্প। জলীয় বাষ্পের উপাদানগুলো বিভাজিত করে সে তার ধারণার শক্তিমত্তা নিঃশেষিত করুক। পরিশেষে যে জিনিসটার সম্মুখীন হবে সে- ইহাই হোক এখানকার প্রতিপাদ্য বিষয়। সে হয়তো ভাবতে পারে, এটিই প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম বিন্দু। কিন্তু আমি তাকে দেখাতে চাই এখানেও রয়েছে নতুন এক অনন্তবিবর যেখানে আমি তার জন্য কেবল দৃশ্যমান বিশ্বই নয়, সামান্য পরমাণুগর্ভে প্রকৃতির বিশালতাও চিত্রিত করবো, তার কাছে যা অনুভবগ্রাহ্য হতে পারে। সেখানে সে দেখতে পাবে বিশ্বসমূহের অসীমতা (the centre of which is everywhere, circumference is nowhere) যাদের রয়েছে নিজস্ব আকাশ, গ্রহমণ্ডল ও পৃথিবীÑ ঠিক দৃশ্যমান বিশ্বের মতো, একই অনুপাতে। প্রতিটি পৃথিবীর প্রাণিসমূহের মাঝে রয়েছে সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা; ব্যবচ্ছেদকৃত পোকাটির ক্ষুদ্রতম বিন্দুতে পূর্বের মতোই অসীম বিশ্ব- অন্তহীন, বিরতিহীন। বিশালত্বের ন্যায় ক্ষুদ্রত্বের এই বিস্ময় নিয়ে ভাবতে গেলে মানুষ খেই হারিয়ে ফেলবে। কে এই বিষয়টাতে বিষ্ময় প্রকাশ না করবে, কিছুক্ষণ আগে সমগ্রের বক্ষস্থিত অবোধগম্য বিশ্ববভ্রহ্মাণ্ডে মানুষের যে দেহকে অতি সামান্য মনে হয়েছিল তা এখন এক বিশাল জিনিস, একটি বিশ্ব কিংবা একটি পূর্ণতাÑ অগম্য শূন্যতার প্রেক্ষিতে! যে তাকে এই আলোকে বিচার করবে সে নিজেকে নিয়ে ভীত হয়ে পড়বে। সে যখন উপলব্ধি করবে অসীমতা ও শূন্যতার দুই অনন্তবিবরের মাঝামাঝি প্রকৃতিপ্রদত্ত দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন সে শুধু বিস্ময়াভিভুত হবে। তার কৌতুহল যখন প্রশংসায় পর্যবসিত হবে তখন সে কোনো ধরণের পূর্বানুমান দিয়ে পরীক্ষণের পরিবর্তে সেগুলো নিয়ে বরং নীরবে অনুধাবন করতে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠবে।

প্রকৃতিতে মানুষের প্রকৃত স্বরুপ কী? অসীমের তুলনায় সে কিছুই না, শূন্যতার প্রেক্ষিতে সে সবকিছু এবং এই ‘কিছুই না’ ও ‘সবকিছু’-র মাঝে সে এক সেতুবন্ধও। যেহেতু সে অসীমতাদ্বয়ের উপলব্ধি থেকে অসীম যোজন দূরে, সেহেতু বস্তুনিচয়ের সমাপ্তি ও প্রারম্ভ তার কাছে অভেদ্য এক রহস্যের মতো অনধিগম্য থেকে যায়। উপরন্তু যা থেকে তার উৎপত্তিÑ সেই ‘কিছুই না’-কে এবং তাকে গলাধঃকরণ করে রাখা অসীমতাকে প্রত্যক্ষণ করতে সমানভাবেই অক্ষম সে।

অগত্যা কী আর করবে সে! প্রারম্ভ ও সমাপ্তিকে জানতে না পারার চিরব্যর্থতা বুকে নিয়ে সে কেবল বস্তুর মধ্যকে জানতে চায়। কিন্তু সমুদয় বস্তু শূন্যতা থেকে উৎসারিত এবং অসীমের পানে ধাবিত। কে এই বিস্ময়কর প্রক্রিয়া অনুসরণ-অনুধাবন করতে পারে?

অসীমসমূহকে বুঝতে ব্যর্থ হয়ে মানুষ হুট করে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে লিপ্ত হয়েছে। অবস্থাটা এমন যে প্রকৃতির সাথে তার যেন একটা আনুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। এটা শুনতে অদ্ভুত লাগে, মানুষ বস্তুনিচয়ের প্রারম্ভকে জানতে চায়, বস্তুর মতোই অসীমের পূর্বানুমান দিয়ে সামগ্রিকতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে চায়। অথচ নিশ্চিত ধারণা এবং প্রকৃতির মতো অসীম ক্ষমতা ছাড়া তা কখনও হতে পারে না।

আমরা যদি সম্যকভাবে জ্ঞাত হই তাহলে বুঝতে পারবো, প্রকৃতি সমূদয় বস্তুর মধ্যে তার নিজের এবং তার রচয়িতার ভাবমূর্তি খোদিত করে দিয়েছে বলে প্রায় সবকিছুই দ্বৈত অসীমতাকে আংশিকভাবে হলেও প্রকাশ করে। এভাবে আমরা দেখি, সকল বিজ্ঞানের গবেষণার পরিধি অসীম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জ্যামিতির রয়েছে সমাধানযোগ্য সমস্যার অসীম অসীমতা (infinite infinity)। কে তাতে সংশয় প্রকাশ করবে? বহুত্ব ও সূক্ষ্মতার বিবেচনায় আমাদের অনুসিদ্ধান্তগুলোও অসীম। কারণ এটা পরিষ্কার যে যাকে চূড়ান্ত আখ্যা দেওয়া হয় তা স্বতঃসিদ্ধ নয়; প্রমাণের জন্য তা অন্যকিছুর ওপর নির্ভরশীল যা আবার পরনির্ভরতার কারণে চূড়ান্ত নয়। আমরা কোনো কিছুকে চূড়ান্ত হিসেবে যুক্তি দেখাই, ঠিক যেভাবে ভৌত পদার্থের নিরিখে বলি অবিভাজ্য বিন্দু- যা আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে এবং প্রকৃতিগতভাবেই নিরতিশয় বিভাজনযোগ্য।

বিজ্ঞানের দুই অসীমতার মধ্যে বৃহত্তের ব্যাপারটাই তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট। এবং এজন্য কেউ কেউ এমন ভাব দেখান যে তাঁরা যেন সব জানেন। ‘ আমি সমগ্রের কথা বলব, I will speak of the whole.’ দাবি করেন ডেমোক্রিটাস (গ্রীক দার্শনিক- প্রকৃতির পরমাণু তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা, জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ অব্দ)।

অসীম ক্ষুদ্রত্বের ব্যাপারটা প্রায় অস্পষ্ট। দার্শনিকেরা প্রায়শই একে বোঝার দাবি করেন এবং এখানে এসেই তাঁরা সব হোঁচট খান। ফলে দর্শনে ‘প্রথম নীতিসমূহ’, দর্শনের ‘মূলনীতিসমূহ’ ইত্যাদি কিছু পরিচিত শিরোনামের জন্ম হয়েছে। বহিরাবরণে না হলেও তত্ত্বের দিক দিয়ে এগুলো এতোই চাকচিক্যপূর্ণ যে জ্ঞেয় বস্তুসমূহের ব্যাপারে আমাদের বোধকে বিভ্রান্ত করে দেয়।

আমাদের সাধারণ বিশ্বাস, আমরা কোনো কিছুর পরিধিকে স্পর্শ করার চাইতে বরং এর কেন্দ্রে পৌঁছুতে অধিক পারঙ্গম। দৃশ্যমান বিশ্বের পরিধি দৃশ্যতই আমাদের অতিক্রম করে আছে। কিন্তু যখন দেখি আমরা ক্ষুদ্র বস্তুসমূহকে অতিক্রম করে আছি তখনই আমাদের ধারণা হয়, আমরা সেগুলোকে বেশ জানি। অথচ ‘সবকিছু’-র চেয়ে ‘কিছুই না’-কে অর্জন করার জন্য আমাদের কম ক্ষমতার প্রয়োজন- এমনটি কিন্তু নয়। উভয় ক্ষেত্রেই অসীম ক্ষমতার দরকার। আমার কাছে মনে হয়, সত্তার পরম নীতিসমূহ কেউ যদি উপলব্ধি করতে পারে তবে সে অসীমের জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে। এই সত্তা ও অসীমতাÑ পরস্পর নির্ভরশীল এবং এরা একে অন্যকে পরিচালিত করে। এই দুই চরম দূরত্বের বল (force of distance) দ্বারা মিলিত ও পুনর্মিলিত হয়ে থাকে।

আবার আমাদের বিষয়ে আসা যাক। আমরা কোনো কিছু, সবকিছু নই। আমাদের অস্তিত্বের প্রকৃতি ‘কিছু না’ থেকে উদ্ভুত প্রারম্ভের জ্ঞানকে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে। আর আমাদের সত্তার সামান্যতা অসীমের দৃশ্য থেকে আমাদের আড়াল করে রাখে।

প্রকৃতির বিশালতায় আমাদের দেহ যতটুকু পরিব্যাপ্ত, চিন্তন-জগতের ব্যাপকতায় আমাদের ধীশক্তিও ততটুকু বিস্তৃত।

আমরা সর্বোতভাবে সীমাবদ্ধ এবং এই সীমাবদ্ধতা যা দুই চরমের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করে তা আমাদের সমস্ত অক্ষমতায় প্রকাশিত হয়। আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ কোনো চরমকেই উপলব্ধি করে না। উচ্চনাদ আমাদের বধির করে দেয়; তীব্র আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়; অতিদূরত্ব ও অতিনৈকট্য দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চরম উষ্ণতা কিংবা চরম শৈত্য- কোনোটাই আমরা অনুভব করি না। অতিগুণাবলী আমাদের মধ্যে অহংবোধ সৃষ্টি করে এবং তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার বাইরে বলে আমাদের মধ্যে অনুভব সৃষ্টি করে না, যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। আসলে চরমসমূহ আমাদের মাঝে থেকেও যেন নেই; আমরাও যেন এদের নিকট অলক্ষ। এরা আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায় কিংবা আমরাই পালিয়ে বেড়াই এদের কাছ থেকে।

এই হলো আমাদের সত্যিকারের অবস্থা যা আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান ও পরিপূর্ণ অজ্ঞতার সন্ধান দেয় না। আমরা যেন বিশাল বিস্তৃতির স্রোতে পাল তুলে ছুটে চলি, ভেসে চলি চির অনিশ্চয়তার পথে, প্রারম্ভ থেকে সমাপ্তির দিকে। আমরা যখন কোনো বিন্দুর সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে চাই, শক্ত করে বাাঁধতে চাই, তখনই তাতে ঢেউ জাগে, ঢেউ খেলে খেলে তা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। আমরা যদি সেই ধাবমানতার পিছু পিছু ছুটে চলি ইহা আমাদের ফাঁকি দেয়, পাশ কাটিয়ে চলে এবং উধাও হয়ে যায় চিরতরে। আমাদের প্রবণতা কিন্তু অন্যরকম। আমরা মজবুত ভূমির সন্ধান পেতে চাই; পেতে চাই একটা চূড়ান্ত নিশ্চিত ভিত্তি যার উপর মিনার নির্মাণ করতে পারি, অসীমে পৌঁছার বাসনায়। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ ভিত্তি ধসে পড়ে, ভূমি সরে গিয়ে তৈরি হয় এক অনন্তবিবর।

আসলে নিশ্চয়তা ও স্থিতিশীলতার অনুসন্ধান করে লাভ নেই। আমাদের যুক্তিবোধ চিরপরিবর্তনশীলতার ছায়ার দ্বারা প্রতারিত হয়। কোনো কিছুই দুই অসীমের মধ্যস্থিত সসীমকে স্থির করতে পারে না। অসীমতাযুগল সসীমতাকে আচ্ছাদিত করে রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

আমার মনে হয়, প্রকৃতি যাকে যেখানে স্থাপিত করেছে সেখানেই সে স্থির হয়ে থাকবে। এই যে বিস্তৃতি যা আমাদের ওপর নিয়তির মতো চেপে আছে তা উভয় চরম থেকেই সর্বদা সমদূরবর্তী। তাই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড সস্পর্কে সামান্য জ্ঞানার্জন করেই বা মানুষের কী লাভ? সে হয়তো অন্যের চেয়ে একটু বেশি জানতে পারবে, কিন্তু তার জানার অবস্থান কি জ্ঞানের চিরন্তনতা থেকে অসীম দূরত্বে নয়?

মানুষ যদি নিজেকে তার গবেষণার প্রথম বিষয় হিসেবে বেছে নেয় তাহলে দেখতে পাবে সামনে অগ্রসর হতে কতোটা অক্ষম সে। একটা অংশ কীভাবে সমগ্রকে জানতে পারবে? তবে সে সেই অংশগুলোকে জানার চেষ্টা করতে পারে যেগুলোর সাথে তার একটা অনুপাত নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু বিশ্বের অংশসমূহ একে অপরের সাথে এমনভাবে সম্পর্কিত ও সংযুক্ত যে, আমার বিশ্বাস, এদের কোনো একটাকে কিংবা সমগ্রকে বাদ দিয়ে অন্যটার বিষয়ে কোনো কিছুই জানা সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ, মানুষ যা জানে- এর সাথে সে সম্পর্কিত। তার বসবাসের জন্য দরকার একটা জায়গা, জীবন অতিক্রান্ত করার জন্য সময়, বাঁচার জন্য গতি, গঠিত হওয়ার জন্য উপাদান, জীবন ধারণের জন্য উষ্ণতা ও খাদ্য, নিশ্বাসের জন্য বাতাস। সহজ কথায়, সবকিছুর সাথে সে যৌথ নির্ভরতার সম্পর্কে আবদ্ধ। যেমন, মানুষকে জানতে হলে জানতে হবে তার বেঁচে থাকার জন্য বাতাস কীভাবে কাজ করে, এজন্য জানতে হবে বাতাসকেও এবং সেই সাথে জানার প্রয়োজন হবে বাতাস কীভাবে মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত, ইত্যাদি। বাতাস ছাড়া জ্বলে না অগ্নিশিখা- অর্থাৎ অগ্নি ও বাতাসের রয়েছে এক যৌথ নির্ভরতার সম্পর্ক। কাজেই একটাকে বুঝতে বা জানতে হলে অবশ্যই জানতে হবে অন্যটাকেও।

জগতের সবকিছুই কার্যকারণ (cause and effect), আশ্রিত(dependent), অবলম্বন(support), অমাধ্যম(mediate), মাধ্যম(immediate) ইত্যাকার সম্পর্কে আবদ্ধ এবং অবোধগম্য প্রাকৃতিক শৃঙ্খলে একত্রিভুত। এ শৃঙ্খল সন্নিকটবর্র্তী ও অতিদূরবর্তী ভিন্ন রকমের বস্তুসমূহেও সৃষ্টি করে এক বন্ধন। তাই সমগ্রকে না জেনে অংশকে জানা যেমন অসম্ভব তেমনি অংশসমূহকে ব্যাপকভাবে না জেনে সমগ্রকে জানাও অসম্ভব বটে।

আরেকটা বিষয় যা বস্তুসমূহকে জানার ব্যাপারে আমাদের অক্ষমতাকেই পূর্ণ করে তোেেল তা হলোÑ বস্তুসমূহ সরল আর আমরা হলাম বিপরীত প্রকৃতির ও ভিন্ন ধরণের দুই জিনিস: আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে এক জটিল রূপ। আমাদের বিচারবোধসম্পন্ন অংশ আধ্যাত্মিক ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কেউ যদি ভাবে যে আমরা শুধুই রক্তমাংসের- তাহলে তা বস্তুসমূহকে জানার ব্যাপারটা আরও অসম্ভব করে তোলে। বস্তু নিজেকে বা অন্য বস্তুকে জানে- এ কথা বলার কোনো অর্থই হয় না। বস্তু কীভাবে নিজেকে জানবে তা কল্পনায়ও আসে না।

কাজেই, আমরা যদি কেবল বস্তুর সমন্বয় হই তাহলে কোনো কিছুই জানা সম্ভব নয়। আমরা যদি মন ও বস্তুর সমন্বয় হই তাহলেও কোনো বস্তুকে সঠিকভাবে জানা যাবে নাÑ তা আত্মিক হোক কিংবা ভৌতই হোক। এই জটিলতার কারণে প্রায় সব দার্শনিকই বস্তুর ধারণাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা আত্মিকতার নিরিখে বস্তুর, বস্তুতত্ত্বের নিরিখে আত্মিক বিষয়ের ব্যাখ্যা দেন। উদাহরণত, তাঁরা বেশ জোড় দিয়ে বলেন, দেহ কেন্দ্রের অনুসন্ধান করে, ধ্বংস থেকে পালিয়ে বেড়ায়, শূন্যতাকে ভয় পায়, দেহের রয়েছে পতনপ্রবণতা, রয়েছে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা। অথচ এগুলো মনের গুণাগুণ প্রকাশ করে। মনের ব্যাপারে তাঁরা ধারণা করেন, মন চলন্ত কোনো কিছু যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যখন খুশি বিচরণ করতে পারে। কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্য দেহের মধ্যেই থাকে।

মন ও দেহের ব্যাপারে সঠিক ধারণা পাওয়ার বদলে আমরা নিজেদের চিন্তনরং দিয়ে এগুলোকে রঞ্জিত করি এবং দৃশ্যমান সমূদয় সরল বস্তুতে নিজেদের সত্তার সীলমোহর লাগিয়ে দেই।

মন ও দেহের সমন্বয়টি আমাদের নিকট সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। প্রকৃতিতে মানুষ নিজেই সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার। কেননা সে তেমন বুঝতে পারে না দেহ কী জিনিস, তার চাইতেও কম বোঝে মন কী জিনিস এবং মন ও দেহ কীভাবে সম্পৃক্ত হয় তা সে বুঝতেই পারে না বলা যায়। তদুপরি এসব সমস্যার সমষ্টি নিয়েই তো মানুষের অস্তিত্ব।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×