চিনিমুক্ত লিকার চায়ে এক চুমুক দিয়ে পেয়ালাটি টি-টেবিলে রাখেন তিনি। ট্রেতে মাশরুমযুক্ত ডিমের অমলেট। আগে খেৃয়াল করেননি। বৃত্তাকার খাদ্যটি কাঁটা চামচে কেটে সামান্য মুখে পোরেন। লবণ ঠিক নেই বোধহয়। কম না বেশি তা বুঝতেও চাচ্ছেন না। সময় একদম কম। বের হবেন প্রাতঃভ্রমণে। তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ান সাদা ছড়ি হাতে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নন তিনি। বরং দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে অক্ষিগোলকের ওপর প্লাস্টিক লেন্স বসিয়েছেন। চশমার কাচে ঢাকতে চান না চোখ দুটিকে।
বেরুনোর সময় চকিত দৃষ্টি ফেলেন ড্রেসিং আয়নায়। ঘন শুভ্রকেশ। রক্তলাল ট্যাকস্যূট। সাদা ক্যাডস। পোশাক-আশাক দারুণ মানিয়েছে ছড়ির সঙ্গে। ফুরফুরে মনে দরজার বাইরে পা বাড়ান তিনি।
মানুষ হিসাবে তিনি সামাজিক না। পারিবারিকও না। একেবারেই আত্মকেন্দ্রিক। সমাজে কখন কী ঘটে তা নিয়ে একটুও মাথাব্যথা নেই তার। পরিবারের কে কোথায় আছে জানলেও কেমন আছে এর কোনো খোঁজখবর রাখেন না। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থেকে কদাচিৎ ফোন করে। তিনি দুয়েকদিনের মধ্যেই ভুলে যান তাদের কথা। ছাড়াছাড়ি না হলেও স্ত্রী থাকেন আলাদা বাসায়। বছর দশেক ধরে যোগাযোগবিহীন। তাতে কিছু য়ায় আসে না তার। সবসময় ব্যস্ত থাকেন নিজেকে নিয়ে।
নৈঃসঙ্গপ্রিয় এই নির্বান্ধব লোকটা সিঁড়ি ভেঙে নামছেন। পেছন থেকে শিশুর আকস্মিক আর্তস্বর শুনে থেমে যান। রংধনু রঙের একটা বল গড়াতে গড়াতে আটকে পড়ে তার দুই গোড়ালির মাঝখানে। নুইয়ে বাঁ হাতে বলটা ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান রাগত চোখে। বয়স চার-পাঁচ হবে হয়তো। সে ছেলে না মেয়ে তা চুলে পোশাকে সনাক্ত করতে পারছেন না। প্রয়োজনও নেই। কর্কশ স্বরে ‘এই ধর’ বলে ছুড়ে মারেন খেলনাটি। শিশুটির হাত ফসকে পড়ে সেটি আবার গড়াতে থাকে। শিশুমনের আকুলি-বিকুলি অগ্রাহ্য করে ইংরেজিতে ধমকিয়ে পা চালান তিনি।
নির্জন রাস্তায় কুয়াশার ঝাপটায় বিরক্ত হন নিজের প্রতি। কী দরকার সকালের শয্যাসুখ বাদ দিয়ে খামকা হাঁটাহাটি করার! বাসায় ফিরে যাই। কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে থাকি গিয়ে।
ভাবনা ফলপ্রসূ হয়নি। এক কুইন্টাল ওজনের দেহটি বয়ে নিয়ে এগিয়ে যান উদ্যানের দিকে।
পাকা বেঞ্চে পাথুরে স্তব্ধতায় বসে থাকেন চুপচাপ। কিছুই ভালো লাগছে না তার।
তার পোশাকি নাম আবুল কাশেম মোহাম্মদ নাজমুল হক। অতিথ্যাবড়া নাকের কারণে এলাকার লোকে তাকে বোচা কাশেম উপনামে ডাকে। দেদারসে ঘুষগ্রহণ করতেন বলে অফিসে ঘুষু কাশেম হিসেবেও পরিচিত তিনি। তত্ত্বাবধায়াক সরকারের আমলে হাতেনাতে ধরা পড়ে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেয়েছিলেন। পুনর্বহালের চেষ্টাতদ্বির চালাতে চালাতে অবসরে যাওয়ার সময় সমাগত। এ নিয়ে এত টেনশন নেই তার। সাত তলা বাড়িটাতে ডজনখানেক ভাড়াটে। ভাড়া যা আসে তা-ই তো লাগে না একজন একলা মানুষের। তা ছাড়া তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল নয় কারো ভবিষ্যত। অতএব সঞ্চয় নি®প্রয়োজন।
আজ মাসের শেষদিন। ঘরে উদ্বৃত্ত পড়ে আছে মোটা অঙ্কের অর্থ। কেনাকাটার কিছু নেই। রাতে মৌজ করা যেত পাঁচতারা হোটেলে। কিন্তু শরীরমন সায় দিচ্ছে না। ক্লাবে গিয়ে জুয়ায় বসলেও তো চলে। এতে জেতার সম্ভাবনাও যে থেকে যায়। তাহলে কী আর করা! টাকা তো বাতাসে উড়িয়ে দেওয়ার জিনিস না। খরচের খাত নিয়ে এলোমেলো চিন্তা করতে করতে উঠে দাঁড়ান কাশেম সাহেব। ছড়ি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে যেতে থাকেন গেটের দিকে।
এক ভদ্রমহিলা উদ্যানে ঢোকছেন। সাদা বোরকায়-ওড়নায় সমস্ত শরীর ঢাকা। চোখে মোটা ফ্রেমের কাল গগলস। হাতে পায়ে চামড়ার মোজা। এভাবে প্যাকিং হয়ে কেউ প্রাতঃভ্রমণে আসে! বিস্মিত ও কৌতুহলী হন কাশেম সাহেব।
রহস্যময় মহিলাটি তার সামনাসামনি থামেন। ছড়িটির দিকে তাকিয়ে পুনরায় চলতে শুরু করেন। পিছু নেন কাশেম সাহেব। এই যে শুনছেন? বলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অবান্তর আগ্রহ হারিয়ে ফিরে আসেন তিনি।
দ্রুত বাসায় যাওয়া দরকার। মূত্রথলিতে চাপ বাড়ছে। হেঁটে গেলে দেরি হবে। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল শুরু হয়নি। হরতাল চলছে। ফোন হাতে নিয়ে মনে পড়ে ড্রাইভার ছুটিতে আছে। অগত্যা তিনি হেঁটেই রওনা করেন।
চিরবিদায় স্টোর নামক একটা দোকানের সামনে তার পা থেমে যায়। চোখ পড়ে সাদা কাপড়ের থানের ওপর। দৃষ্টি ঘুরিয়ে পথচলা শুরু করেন তিনি।
আশ্চর্যান্বিত হয়ে উপলব্ধি করেন তার নিস্তরঙ্গ হৃদয়ে কী যেন ঝংকার তুলছে।
বাসার প্রবেশ পথে সাক্ষাত ঘটে বুয়ার সঙ্গে। বাইরে যাচ্ছে কাঁচা মরিচ আনতে। তার কাছ থেকে সিঁড়িতে দেখা শিশুটির খোঁজখবর নেন। বুয়ার গোলমেলে বর্ণনা থেকে জানতে পারেন শিশুটি সম্ভবত ছেলে। ডাকনাম রাসা। মা মারিয়া বা ফারিয়া। মাস্টারি করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে। বাবা প্রবাসে অথবা নিরুদ্দেশে। পরিবারের ভরণপোষণ চালান না বোধহয়।
চটির শব্দ তুলে বুয়া চলে গেলে কাশেম সাহেব পা রাখেন সিঁড়িতে। চোখে ভেসে ওঠে গড়িয়ে নামতে থাকা রঙিন বল। অন্যমনস্কতায় ছড়ির হাতল দিয়ে চাপ লাগান রাসাদের দোরঘন্টিতে।
আসুন আঙ্কেল, দরজা খুলে নিম্নস্বরে রাসার মা বলেন।
নারকেল ছোবড়ার পাপোশে ক্যাডসের বালু ঝেড়ে ঘরে ঢোকেন তিনি। সোফায় বসতে বসতে বলেন, আপনার সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
আমি মারিয়া মেহজাবিন, সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে রাসার মা চলে যান কিচেনে।
রাসা চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ আধবোজা। কপালে ব্যাণ্ডেজ।
বল নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে কচি কপালটা থেঁতলে গেছে হয়তো। অনুতপ্ত কাশেম সাহেব তার নাম ধরে ডাকেন। পাশ ফিরে শোয় রাসা। সাড়া দেয় বিদ্রুপের ভাষায়।
তুমি পচা। তুমি বোচা কাশেম। ঘুষু কাশেম।
এসব কে বলেছে তোমাকে?
তোমার বুয়া বলেছে আম্মুকে। আম্মু আমাকে।
অবমাননাকর কথায় একটুও রাগ করেননি তিনি। বরং ওর কাছে গিয়ে বসেন। রাসা তাকে ঠেলা মেরে উঠে দাঁড়ায়। সাদা ছড়িটি হাতে নিয়ে চোখ বুজে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে অন্ধ মানুষের মতো।
কিচেন থেকে ফিরে আসেন মারিয়া। ট্রেতে পাপরভাজা। দুধ-চা।
মুড়মুড়িয়ে পাপর খেতে খেতে কাশেম সাহেব তাকান মারিয়ার দিকে। দারুণ ফিগার! স্বগতোক্তি করে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে দেন।
চোখ ইশারায় তিনি কাছে ডাকেন রাসাকে। সে মাথা নাড়ে। নড়ে না।
ভ্যানিটি ব্যাগে ছোট্ট আয়নাটা ভরে মারিয়া বলেন, আমি আর এক মাস আছি এখানে। বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে দিতে পারেন।
চলে যাবার কারণটা জানতে পারি?
আগে শিক্ষকতার পাশাপাশি টিউশনি করতাম। বাসায় বাসায় গিয়ে পড়াতে আর ভালো লাগছে না। গতমাসে ছেড়ে দিয়েছি। আয় নেমে এসেছে অর্ধেকে। তাই ভাড়ায় পোষাচ্ছে না আমার।
সাধ্যমতো ভাড়া দেবেন। একেবারে না দিলেও চলবে। আপনি তবু থেকে যান আমার বাসায়।
ধন্যবাদ আপনাকে। তবে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। ভেবেচিন্তে পরে জানাচ্ছি। প্লিজ ডুন্ট মাইন্ড, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঘরে তো কাউকে দেখছি না। কার কাছে থাকবে রাসা?
কাজের মেয়েটি পালিয়ে গেছে। বাবুকে সাথে নিয়েই বেরোব।
আজ নাহয় আমার কাছে রেখে যান। ওকে নিয়ে বল খেলব ঘরের ভেতর।
মারিয়া নির্বাক। কী বলবেন বা বলা উচিত, বুঝতে পারছেন না। সাদা ছড়িটা উঁচিয়ে তেড়ে আসে রাসা। চিৎকার করে বলে, বাড়ি মারব একটা। দূর হও তুমি।
রাসাকে মৃদু ধমকে ছড়িটা কাশেম সাহেবের হাতে দিয়ে মারিয়া বলেন, মনে কিছু করবেন না আঙ্কেল। আমার ছেলেটা এমনই। রেগে যায় যখন-তখন।
ইটস ওকে, বলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যান কাশেম সাহেব।
ব্যালকনির রেলিং ঘেঁষে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। কিছু ভাবতে চেষ্টা করেন। ভাবনার শিরোনাম বদলে যাচ্ছে বারবার।
কাশেম সাহেবের নিমগ্নতা ভেঙে সেলফোনে কড়া মেসেজ টোন বেজে ওঠে। অজানা নাম্বার থেকে একটা এসএমএস। ইংরেজি অক্ষরে লেখা বাংলা বাক্য।
amake chite parle na tumi― এতটুকু পড়েই রিং করেন তিনি। ওপর প্রান্ত থেকে থেমে থেমে কান্নাতরঙ্গ ভেসে আসছে। চেনা চেনা লাগছে কান্নার স্বরটা।
কে? কে? কাশেম সাহেবের অস্থির প্রশ্ন।
কোনো জবাব নেই। পুত পুত শব্দে লাইন কেটে গেছে। আবারো চেষ্টা চলে সংযোগের। ফোন বন্ধ। মাথাটা শূন্য শূূন্য লাগছে।
টলতে টলতে শোবার ঘরে পা রাখেন তিনি। অসহ্য ঠেকছে স্মৃতিরেণুমাখা পুরনো সব আসবাবপত্র। কড়কড়ে টাকার একটা বাণ্ডিল বুয়ার সামনে ছুড়ে মেরে উচ্চৈঃস্বরে নির্দেশ দেন, বেডরুমে যা কিছু আছে সরাও তাড়াতাড়ি।
ক্যান খালু? বদলাইয়া ফেলাইবেন নাকি?
সকল কী এবং কেন’র জবাব হয় না। যা বলছি কর।
শঙ্কিত বুয়া সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোক ডেকে আনে। মনিবের আজগুবি ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেলে।
ততক্ষণে দোকানে দোকানে ঘুরে এক বস্তা বল নিয়ে ঘরে ফেরেন কাশেম সাহেব। দরজা লাগিয়ে হরেক কিসিমের বলগুলি নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন। মনে মনে তখন তিনি রাসা হয়ে যান।
শেষবিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আসেন মারিয়া। ব্যালকনিতে রাখা বেডরুমের জিনিসপত্র দেখে বুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। সদুত্তর মিলে না।
ওদিকে কাশেম সাহেব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েন মেঝেতে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
তিনি দেখতে পান কালো কালো চশমা পরা একদল ছেলেমেয়ে সাদা ছড়ি হাতে তার বাসা ঘেরাও করে রেখেছে।
দৃশ্যটা খোয়াবে দেখছেন নাকি কল্পনা করছেন, বুঝতে পারছেন না।
ডোরবেলের সুরেলা কম্পনে তিনি সম্বিত ফিরে পান। তবে সিদ্ধান্তগ্রহণক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। নিজের অজান্তে চলে যান শাউয়ারের নিচে। আধভেজা শরীরে বেরিয়েও পড়েন ওয়াশ-রুম থেকে।
একটা লাল বল ডান বগলে চেপে বাম হাতে দরজা খোলেন কাশেম সাহেব। একদৌড়ে সিঁড়িমুখে দাঁড়ান গিয়ে। বলটা বৃত্তাকার গতি পেলে বুয়াকে চেঁচিয়ে বলেন, টেল এভরিওয়ান টু লীভ মাই হাইজ অ্যাট ওআন্স।
অতঃপর সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
কিছুই না বুঝে বুয়া তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে।
মারিয়া ফোন করছেন হসপিটালের ইমারজেন্সিতে।
হাততালি দিয়ে রাসা ফেটে পড়ছে অট্টহাসিতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:৩২