১.
ট্রেনে করে যাচ্ছেন মিসেস রহমান। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কামরাই তিনি একাই। কিছু মহিলাকে দেখলেই ভাল লাগে, কেমন জানি শুভ্রতার প্রতীক মনে হয়। মিসেস রহমানের চেহারায়ও একটা স্বর্গীয় দ্যোতি খেলা করে। মনে হয় তিনি কোন অন্যায় করতে পারেননা। দুনিয়ার সমস্ত ভালত্বের, শুভ্রতার প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি, এজন্যই তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং তিনি সত্যিই শুভ্রতার প্রতীক। ট্রেন একটা স্টেশনে থামলে একটা লোক হাঁপাতে হাঁপাতে উঠল তাঁর কামরাই। কামরাটা তিনি নিজের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন বিপদে পড়েছেন। তাই কিছু বললেননা। রাত দশটা হয়েছিল যখন লোকটা উঠল ট্রেনে। কাছে এসে হাতজোর করে বলল যে সে গত তিনিদিন উপুশ আছে। খিদায় তার মরে যাওয়ার অবস্থা। লোকটাকে দেখে খুব মায়া হল। এম্নিতেই মিসেস রহমানের বড় বেশী মায়া। তার কাছে টিফিন ছিল রাতের খাবারের। নিজে নিজে চিন্তা করলেন বিকালবেলায় হেভি খাওয়া হয়েছে। তাই এ বেলায় না খেলেও চলবে। টিফিনটা লোকটাকে দিলেন। লোকটা কি যে খুশি হল। তার খাওয়ার গতি দেখে বুঝা যায় তার কি পরিমাণ খিদা লেগেছে। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দৃশ্য ক্ষুধার্ত লোককে খাওয়ানোর দৃশ্য। লোকটার জন্য মিসেস রহমানের মায়া লাগল খুব। আহারে! বেচারা কত কষ্টে আছে। ছেড়া কাপড় পড়ে আছে। গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করার পর লোকটা খুব কৃতজ্ঞতার সাথে মিসেস রহমানের দিকে তাকাল। খাওয়ার পর লোকটাকে একটু সুস্থ দেখাচ্ছে।
রাত বাড়ল আরো। মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন লোকটা কোথায় যাবে। কোন উত্তর দেয়না। আর ঘাঁটাননা তিনি তাকে। কোন বিপদে পড়েছে হয়ত। সারাদিন জার্নি করাতে খুব ক্লান্তি, তাই সহজেই ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু ঘুম গভীর হওয়ার পর কেমন যেন তার শাড়ীতে টান অনুভব করলেন। আস্তে আস্তে চোখ খুললেন। দেখলেন লোকটা পশুর কামনার চোখে তার শাড়ী নিয়ে টানতেছে। মিসেস রহমান চোখে অতীব আশ্চর্য নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেমন জানি প্রতিরোধ করার কথা মাথায়ই আসলনা। এটা স্বপ্ন না তো? মুখে কোন কথাই আসতেছেনা। লোকটা আরো হিংস্র হয়ে শাড়ী আরো জোড়ে টান দিল...............।
মানুষ!
২.
আমি তখন ফার্স্ট-ইয়ারে পড়ি। ২য় সেমিস্টারে। দেশে ফ্ল্যাশ-ড্রাইভের চল তখনও শুরু হয়নি। সবাই ফ্লপি ব্যবহার করেন। আমার জন্য আমার বড় মামী যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার সময় একটা ১২৮ মেগাবাইটের ফ্লাশ-ড্রাইভ নিয়ে আসেন। আমি সেটা পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলাম। ফ্লপি্তে শুধু ১৪৪ কিলোবাইট জায়গা ছিল। ১২৮ মেগাবাইট সেই তুলনায় আকাশ সমান। এলিফ্যান্ট রোডে আমার বন্ধুর পিসি'র দোকান ছিল। সে বলল সেখানে নাকি ড্রাইভটার দাম প্রায় ৩৫০০ টাকা। এসাইনমেন্ট করার জনয় ড্রাইভটা খুব কাজে দিত। আমরা বাসায় টাইপ করে নীলক্ষেতে প্রিন্ট করতাম। অথবা সময় না থাকলে নীলক্ষেতে পার-পেজ ১০ টাকা দিয়ে টাইপ করা যেত। যারা টাইপ করেন তাদেরকে দোকানের মালিক মাসে ৪০০০/৫০০০ টাকা দিয়ে রাখত। অনেক সময় মালিক নিজেই টাইপ করত। ত একটা এসাইনমেন্টের জন্য ফ্ল্যাশ-ড্রাইভে করে ফাইল কপি করে নীলক্ষেতে নিয়ে গেছিলাম। প্রিন্ট করার জন্য। নীলক্ষেতের অলিগলি তখনও এত চিনিনা। কোথায় কোন দোকান সেটা চিনার প্রশ্নই আসেনা। যাই হোক অনেক ভিতরে একটা দোকানে নিয়ে গেলাম। প্রিন্ট করলাম। বাসায় চলে আসলাম ক্লাশ থেকে। পরেরদিন ব্যাগে হাতিয়ে দেখি ফ্ল্যাশ-ড্রাইভটা নেই। মাথায় বাজ পড়ল। বাসায় আরো খুঁজলাম। পেলাম না। নিশ্চিত হলাম নীলক্ষেতেই ফেলে এসেছি। কোন দোকানে ফেলে এসেছি সেটা মনে করতে পারতেছিনা। অলিগলির কথা মনে করা খুবই কঠিন। মনে হল শখের ফ্ল্যাশ-ড্রাইভটা হারালাম। তাছাড়া দোকানটা খুঁজে বের করলেও ড্রাইভ পাওয়ার কোন চান্স নেই। যে ছেলেটা প্রিন্ট করেছিল তার চেহারাও মনে পড়তেছেনা। যাক, কি আর করা। ড্রাইভটার কথা ভুলেই গেছিলাম। এর মধ্যে অনেকদিন নীলক্ষেতে যাইনি। প্রায় দু'মাস পর আবার এসাইনমেন্টের জন্য যেতে হল। ভিতরে গেলে পিছনে একটা আওয়াজ শুনলাম "এই যে ভাই, এই যে কাল ট-শার্ট, এই যে ভাই শুনেন।" পিছনে ফিরে তাকালাম। একটা অপরিচিত ছেলে আমাকে ডাকতেছে মনে হচ্ছে। ঠিক বুঝলামনা। পিছনে ফিরে দেখলাম, না আমাকেই ডাকতেছে। গেলাম। সে বলল, "ভাইজান, আপনাকে খুঁজতেছি গত দু'মাস যাবৎ। আপনার পেন-ড্রাইভটা আমার কাছে ফেলে গেছিলেন।" আমি অবাক। ছেলেটার চেহারা আমার একটুও মনে নেই। সে আমাকে তার দোকানে নিয়ে গেল আবার আর ড্রয়ার থেকে বের করে আমার ফ্ল্যাশ-ড্রাইভটা দিল। আমার মনে হল তাকে অন্তত ১০০টা টাকা দেওয়া দরকার। আমরা আধুনিক ভন্ড মানুষগুলো সবকিছুই টাকা দিয়ে হিসেব করি। আমি পার্স বের করে তাকে ১০০টাকা দিতে চাইলাম। সে মুখ অন্ধকার করে বলল সে টাকা নিবেনা। বুঝলাম সে অপমানিত বোধ করেছে টাকা দিতে চাওয়ায়। আমি তার কাছে মাফ চাইলাম। সে বলল ঠিকাছে।
ভার্সিটিতে এসে আমার বন্ধু মাসুমকে এসে বললাম। সে রিকশাওয়ালার একটা কাহিনী শুনাল। তার মানিব্যাগে ২৫০০ টাকা ছিল, টিউশানির বেতন পেয়েছিল সেদিন। পকেটে কিছু খুচরা রেখে মানিব্যাগটা অন্য পকেটে রেখেছিল। হলে এসে রিকসাওয়ালার সাথে স্বাভাবিকভাবেই টাকা নিয়ে ঝগড়া হল। সে বলতেছে ৫ টাকা শাহবাগ থেকে জিয়া হল, আর রিকশাওয়ালা বলতেছে না, ৬ টাকা। সে ৫ টাকাই দিল। রিকশাঅলাকে গালিও দিল। রুমে গিয়ে গোসল করে যখন আবার বের হবে দেখল তার পার্স নেই। বুঝল রিকশায় ফেলে এসেছে। তখন ২/৩ ঘন্টা হয়ে গেছে। টিউশানির টাকা চলে যাওয়াতে মাথার উপর বাজ পড়ল। সারা মাস চলবে কেমনে? মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। মন খুব খারাপ। নিচে নেমে দেখল রিকশাঅলাটা সিটের উপর বসে আছে। তার দিকে তার পার্সটা এগিয়ে দিয়ে কিছু না বলেই দ্রুত চলে গেল। দারোয়ান থেকে জানতে পারল রিকশাঅলাটা চলে গেছিল, আবার ৩০ মিনিট পর ফিরে এসেছিল। আসার পর হলের অনেকেই ভাড়ায় যেতে চাইলেও রিকশাঅলা যায়নি। দারোয়ানের কাছে এসে মাসুমের বর্ণনা দিয়ে সে কোন রুমে থাকে জানতে চাইল। দারোয়ান মনে করেছে হলের অনেকেই রিকশাঅলাকে টাকা না দিয়ে "আসছি" বলে উপরে গিয়ে আর আসেনা। রিকশঅলারা ১৫/২০ মিনিট বসে থেকে তারপর চলে যায়। সেরকম কোন কেইস হয়ত। দারোয়ান তাই মাসুমের রুম নাম্বার বললনা। অনেকেই রুম নাম্বার বললে দারোয়ানকে হম্বিতম্বি করে, তাই সে ঝামেলাই গেলনা। রিকশাঅলা মাসুমের রুম নম্বর না পেয়ে সেখানেই বসে থাকল, কখন মাসুম আসবে। মাসুম আসলে ২/৩ ঘন্টা পর পার্স ফেরত দিয়ে তার দিকে না থাকিয়েই দ্রুত চলে গেল। পার্সের সবকিছুই ঠিকঠাক আছে।
মানুষ!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০০৮ ভোর ৫:৩০