একবার ভাবুন তো...আমাদের দেশে শিক্ষার মূল লক্ষ্য কী? অনেক বিকল্প জবাব মাথায় এলেও বাস্তবতা বলছে...ভাল একটি চাকরি জোগাড় করা, তাই নয় কি? যদি কথাটি সঠিক হয় তবে সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো... চাকরির পরীক্ষাতে যে বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে তা আমাদের স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়ানো হয় না। আর তাই ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীকেও পরীক্ষার পড়াশোনার পাশাপাশি আবার চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে হয়। আর যেহেতু সমগ্র ছাত্রজীবনে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক জ্ঞান লাভের তেমন একটা সুযোগ হয় না সেহেতু তারা পদে পদে ভুল করে। আর যে দেশে চাকরিকে ‘সোনার হরিণ’ এর সাথে তুলনা করা হয় সেখানে একটি ভুল যে আপনাকে অনেক পিছিয়ে দিতে পারে তা বোঝার জন্য নিশ্চয়ই বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। ক্যারিয়ার বিষয়ে আমার আগ্রহের কারণে বিভিন্ন সময়ে যে সকল বিষয়ে অবগত হয়েছি তার কিছু দিক তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
যেহেতু ছোটবেলা থেকেই নোট বা গাইড দেখে উত্তর মুখস্ত করার প্রবণতা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল সেহেতু যখনি কোন ‘ডকুমেন্ট’ তৈরির প্রসঙ্গ আসে তখনি তারা অন্যের একটি কপি পাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। যেমন কোন ছাত্র হয়তো একটি ক্লাস টেস্টে অংশ নিতে পারল না তখন কোর্সটিচার যদি বলেন, তুমি কারণ ব্যাখা করে একটি অ্যাপ্লিকেশন দাও। হয়তো ঐ শিক্ষার্থী দশ মিনিট চিন্তা করলে নিজেই একটি ড্রাফট তৈরি করতে পারত। কিন্তু না, আমাদের শিক্ষার্থীরা তখন ব্যস্ত হয়ে ওঠে ইতিপূর্বে কখন কে এরূপ একটি আবেদনপত্র লিখেছিল তাকে খুঁজে বের করতে এবং খুবই প্রীত বোধ করবে যদি তার কপিটি দেখতে/পেতে পারে। অর্থাৎ নিজেদের জ্ঞান ও যুক্তির ওপর নির্ভর না করে অন্যের কপির ওপর নির্ভর করা খুব স্বাভাবিক মানসিকতা।
চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রেতো এই প্রবণতা আরো ব্যাপক। দেশের পাঁচ পার্সেন্ট শিক্ষার্থীও বিসিএস পরীক্ষার ফরম নিজ বুদ্ধিতে (অন্যের সহযোগিতা ছাড়া) পূরণ করে বলে আমার মনে হয় না। আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণের ক্ষেত্রে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। অথচ উল্লেখিত ফরমগুলো সহজ-সরল ও প্রাঞ্জলভাবে ‘বাংলা’য় (আমাদের মাতৃভাষা) লেখা। এবার ভাবুন তো যদি সেগুলো ‘বিজাতীয় ভাষা’ ইংরেজিতে হতো তবে চিত্রটি কতো করুণ হতো! নি:সন্দেহে অর্ধেকেরও বেশি ফরম গ্রহণ করা সম্ভব হতো না/বাতিল বলে গণ্য হতো। কিন্তু ঘটনাক্রমে বর্তমানে দেশের বড় কর্মসংস্থানকারী খাত (দেশী বা বিদেশী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ) স্বভাবতই এই প্রক্রিয়াগুলো ইংরেজিতে সম্পন্ন করে। ফলে আমাদের অনেক ভালো শিক্ষার্থীও ঐ প্রক্রিয়াটি সফলভাবে সম্পাদন করতে পারে না।
অবিশ্বাস্য মনে হলেও ২৪তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদনপত্র যাচাই বাছাইকালে সাড়ে তিন হাজার আবেদনকারী পাওয়া যায় যারা আবেদনপত্রে এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট অনুযায়ী নিজের নাম, পিতার নাম বা স্কুলের নাম লেখে নি। যেমন: হয়তো সার্টিফিকেটে লেখা আছে ‘মোহাম্মদ আব্দুল করিম’ কিন্তু সে প্রচলিত পদ্ধতিতে লিখেছে ‘মো: আব্দুল করিম’। কারো হয়তো পিতার নাম ‘মো: আব্দুস সালাম’ কিন্তু বর্তমানে বাবা বেঁচে না থাকায় সে নিজে নিজেই লিখে দিয়েছে ‘মরহুম/মৃত আব্দুস সালাম’ (কথিত আছে যে মৃত ব্যক্তির নামের সাথে মো: শব্দটি লিখতে হয় না। এরকম হাজারো পার্থক্য হয়ে থাকে। এমনকি ‘চৌধুরি’ না ‘চৌধুরী’; ‘সালাম’ না কি ‘ছালাম’; ‘খাঁন’ অথবা ‘খান’; ‘সারোয়ার’ বা ‘সারওয়ার’; ‘উদ্দিন’ না ‘উদ্দীন’ না কি ‘উদ্দীন’; ‘বাগাতিপাড়া’ না ‘বাগাতীপাড়া’; ‘বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ অথবা ‘উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ ইত্যাদি বিষয়গুলো ফরমপূরণ করা বা সিভি/রিজিউম/বায়োডাটা তৈরি করার সময় আমাদের ছাত্র/ছাত্রীরা অনেক সময়ই খেয়াল করে না। অথচ আমার পরিচিত একজনের সার্টিফিকেটে নামের শেষে ‘শিকদার’ পদবীটি লেখা ছিল। কিন্তু সিভি তৈরির সময় সে এটি ভুল করেই হোক আর সচেতনভাবেই হোক বাদ দিয়ে মূল নামটি লিখে দেয়।
সে একটি নামকরা বেসরকারী ব্যাংকের চাকরিতে সিলেকশনও পায়। কিন্তু সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনের সময় গরমিল দেখে ব্যখ্যা চাওয়া হয়। তখন সে ‘ভুল’ হয়েছে বলায় কর্তৃপক্ষ মন্তব্য করে, “এত লেস কেয়ারিং মানুষ ব্যাংকিং প্রফেশনের জন্য ফিট নয়।” পরে তাকে আর নিয়োগ দেওয়া হয় নি। তাই এজাতীয় ক্ষেত্রে আমার সহজ পরামর্শ হলো: এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেটকে ভিত্তি ধরে আপনার সকল সার্টিফিকেট তৈরি করতে চেষ্টা করবেন। যদি কোথাও গরমিল থাকে তবে অন্যটি/ অন্যগুলো এসএসসি’র মতো করে নেবেন। ঐ সার্টিফিকেটটি প্রথম পাবলিক পরীক্ষার সনদ এবং বয়স প্রমাণের জন্য সেখানে লেখা জন্মতারিখটিই গ্রহণ করা হয়। তাই সেটি কাটা ছেঁড়া না করাই উত্তম। আর সকল ফরম পূরণের সময় সংশ্লিষ্ট ডকুমন্টগুলো বা সেগুলির ফটোকপি সামনে রেখে দেখে পূরণ করবেন। ওভাররাইটিং করবেন না। সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা যতোটা পারা যায় পরিহার করতে হবে।
বিশেষ কারণে আমার শত শত শিক্ষার্থীর বায়োডাটা প্রতিবছর পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়। সেগুলোতে এমনও ভুল তারা করে যা কখনোই হবার কথা নয়। যেমন: একজন শিক্ষার্থী তার সিভিতে নিজ থানা ও জেলা দুটোই বানান ভুল লিখেছে। ভাইভার সময় যখন তাকে তার জেলার নাম বানান করতে বললাম। সে স্বভাবতই ঠিক বলল। তাকে যখন সিভিতে লেখা ভুলটি দেখালাম লজ্জায় সে মাথা নিচু করে ফেলেছে। এথেকে বোঝা যাচ্ছে এজাতীয় ডকুমেন্টে না জানা বিষয় খুব কমই ভুল হয় বরং জানা বিষয়গুলোও ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। তার এই ভুল দু’টি হবার কারণ হলো, যে শব্দগুলো ইংরেজি নয় সেগুলোর নীচে কম্পিউটার লাল দাগ দেখায়। ফলে শিক্ষার্থীরা শুধু ইংরেজি শব্দগুলো কারেকশানে সচেষ্ট হয় আর বাংলা শব্দগুলোর বিষয়ে উদাসীন থাকে কারণ তারা মনে করে ‘সঠিক’ লিখলেওতো কম্পিউটার ভুল ধরে তাই ওগুলো দেখার দরকার নেই। আর সমস্যাটা তখনি হয়।
জেনে অবাক হবেন যে অনেক আবেদনকারী নিজের নামটিও ভুল করে। আরো একটি সমস্যা হলো যখন তারা ক্যাপিটাল লেটারে ইংরেজি লেখে। কারণ উইন্ডোজের কিছু সংস্করণে ক্যাপিটাল লেটারে টাইপ করা শব্দের বানান ভুল ধরে না। তাই অবশ্যই বাংলা শব্দ এবং ক্যাপিটাল লেটারে করা টাইপগুলো গুরুত্বসহকারে যাচাই করবেন।
আজকাল অনেকেই সামান্য খরচ বাঁচানোর জন্য নিজেরা কম্পিউটারে ছবি প্রিন্ট করে সিভি/ আবেদনপত্রের সাথে জমা দেয়। কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে বাস্তব ধারণা না থাকার কারণেই আবেদনকারীরা এটা করার সাহস পায়। ছয়মাস বা একবছর পরে এভাবে প্রিন্ট করা ছবিগুলো দেখে অনেকেই নিজের ছবিও চিনতে পারবেন না। এমনকি নতুন অবস্থাতেও প্রিন্ট সুন্দর না হওয়ায় ক্যান্ডিডেটের রুচিবোধ সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। তাছাড়া আপনার চাকরিটি যদি সত্যিই হয় তাহলে ঐ ছবিটি আপনার পর্সোনাল ফাইলে সংরক্ষণ করা হতে পারে রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত। পেনশনের সময় আপনার নিয়োগ সংক্রান্ত ডকুমেন্টগুলি আবার যাচাই করা হবে। এক্ষেত্রে ল্যাব থেকে প্রিন্ট করা ছবি জমা দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে (আলাদাভাবে উল্লেখ না থাকলে) ছবি বা অন্যান্য কাগজপত্র ‘সত্যায়িত’ করে পাঠানো দরকার নেই। তবে কখনোই ছবির উল্টোপিঠে নিজের নাম লিখতে ভুল করবেন না। এটি আপনার ছবির অপব্যবহার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রার্থীরা ‘স্বাক্ষর’ ইস্যুতে প্রায়ই বিপত্তিতে পড়েন। বিশেষত সরকারী ফরম বা কাগজপত্র বাংলায় তৈরি করা হয় অপরদিকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কিংবা কম্পিউটারে পড়বে এরূপ সরকারী ডকুমেন্টগুলো ইংরেজিতে তৈরি হয়। কখনো একই আবেদনপত্রেও উভয় মিডিয়ামে লেখা কাগজে একাধিক স্বাক্ষর দিতে হয়। এক্ষেতে অনেকেই কমনসেন্সের ওপর নির্ভর করে বাংলা ফরমে বাংলায় এবং ইংরেজি ফরমে ইংরেজিতে স্বাক্ষর করেন। এপদ্ধতিটি সঠিক নয়। সহজ কথা মনে রাখবেন। স্বাক্ষর কোন ভাষার অক্ষরে না লিখলেও চলবে। অনেকেই শুধুমাত্র কয়েকটা আঁকাবাঁকা টান দিয়ে স্বাক্ষর দিয়ে দেন। ঐ লাইনগুলো বিশেষ কোন ভাষার হওয়া খুব কী জরুরী? না মোটেই না।
আপনার স্বাক্ষরটি অবশ্যই আপনার স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের বাহন হতে হবে। এবং তা একটিই ও একই রকম হওয়া উচিত। বারবার চর্চার মাধ্যমে এমন একটি স্বাক্ষর ডেভলপ্ করবেন যেন সারাজীবন সেটি ব্যবহার করতে পারেন। সেটি বাংলা, ইংরেজি বা আরবী যে ভাষারই ডকুমেন্ট হোক না কেন একই স্বাক্ষর দেবেন। তবে তার আকারটি যেন খুব বড় বা খুব ছোট না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখবেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রে স্বাক্ষরের জন্য লিমিটেড জায়গা বরাদ্দ থাকে।
কভার লেটারে সঠিক ব্যক্তিকে সম্মোধন করা, সংক্ষেপে বিষয়টি তুলে ধরা, বক্তব্যগুলোকে সর্বোচ্চ তিনটি অনুচ্ছেদে শেষ করা , স্বাক্ষর করা (বন্ধনীর মধ্যে পুরো নাম সহ) এবং শেষে সংযুক্তি তালিকা দেওয়া খুব গুরুত্বপুর্ণ। যে নামে আপনি এলাকায় পরিচিত মেইলিং অ্যাড্রসে অবশ্যই সেই নামটি উল্লেখ করা। নইলে এমন হতে পারে যে আপনার বাসার নীচতলায় এসেও আপনার পুরো নাম বলায় কেউ প্রাপককে চিনতে পারবে না এবং পিওন চিঠি ফেরত নিয়ে যাবে। অবশ্যই ই-মেইল অ্যাড্রেস সিভিতে উল্লেখ করা এবং নিয়মিত মেইল চেক করা।
মনে রাখবেন আবেদনপত্রটি আপনার পক্ষে দূত হিসাবে নিয়োগকর্তার কাছে যাবে। নির্ভুল ও সুন্দর একটি আবেদনপত্র ও সিভি পেলে আপনার সম্পর্কে তাদের ভাল ধারণা হবে। পরবর্তী ডিলিং এর ক্ষেত্রে তারা আন্তরিক হবে। কঠিন প্রতিযোগিতার এই সময়ে এটাই কী কম পাওয়া? কারণ কথায় বলে.... ওয়েল বিগিন ইজ হাফ ডান।লিংক