সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলোর রেখাটা সংকীর্ণ থেকে গভীরতর হতে থাকে। চোখের আলোর ঝলসানির মতো বুকটা আশায় ভরে যেতে থাকে আলেক্সাই’র। ক্লান্ত, শীর্ণ নির্জীব শুকনো ঠোটে হয়তো একফোঁটা পানির আস্বাদের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। সবকিছুর চাইতে গলা ভেজানোর কথাই সবার আগে মনে আসছে তার। আলোটা আরেকটু এগিয়ে আসতেই প্রশান্তিতে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। আহ্....ঘুম।
শুরুটা ভালোই ছিল আলেক্সাই’র। প্রিয়তমা স্ত্রী আর কথা ফুটতে শেখা চার বছরের ছোট্ট পরী সিনডারেলা’র সাথে ছোট্ট সংসারে মাথা গোঁজার ঠাই আর টাকা জমিয়ে জমিয়ে এক একটি শখ পূরণ করেই কাটছিল দিন। কাজ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করেই খনির শ্রমিকের কাজটা পেয়ে যায় অথবা নিতে হয় তার (হয়ত বাধ্য হয়ে কিংবা স্বচ্ছন্দ্যেই বেছে নিয়েছিল পৃথিবীর বুক চিরে চিরে চকমকি ধাতুর বিলাস সন্ধান করা; আমরা সে প্রসঙ্গ সচেতনে এড়িয়ে চলছি।) যেভাবেই হোক, আলেক্সাই এখন সিনডারেলার কাছ থেকে ২০০০ ফুট গভীরে।
দিন দুয়েক আগেও পরীটার (আদর করে সিনডি ডাকে আলেক্সাই। যদিও তার মায়ের তাতে ঘোর আপত্তি। সে ডাকবে পুরো নাম ধরেই। বাবা-মেয়ে অবশ্য মায়ের চোখ এড়িয়ে আরো অনেক দুষ্টুমি করে বেড়ায়।) সাথে আধো আধো বোলে ডাক শুনতে পাওয়া আলেক্সাই বেশ আমোদেই ছিল। খনি জীবনের কাঠিন্য সেখানে উধাও। আছে সারল্য আর উচ্ছ্বাস। কাজ থেকে ছুটি কাটাচ্ছিল সে। গতকালই ওভারসিয়ার ফোন করে কাজে যোগ দেবার কথা বললে বরাবরের মতোই মনটা দমে যায় তার। তবু পরদিন ভোরেই কাজে যোগ দিতে চলে আসে অথবা আসতে হয় তাকে।
আবার একঘেয়ে বড় ম্যাড়ম্যাড়ে দিন রাত। কপিকল দিয়ে আরো ৩২ জনের সাথে পৃথিবীর গভীরে নেমে যেতে যেতে আলেক্সাই শুধু তার স্ত্রী আর সিনডি’র কথাই ভাবছিল। কাঁপতে কাঁপতে নেমে যাওয়া লিফট একটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে যায়। হাত দিয়ে লিফটের নেট’টা শক্ত করে ধরেছিল সে। একবার উপরের দিকে তাকায় আলেক্সাই। অনেক উপরে আলোর মুখটা অনেক বেশি বাস্তব মনে হচ্ছে। বরং এই নিচে টিমটিমে আলোটাকেই বরং অনেক বেশি অপার্থিব মনে হচ্ছে তার। এই যে তার সঙ্গীরা আর এই যে সামনে এগিয়ে যাবার রাস্তা তার তুলনায় ফেলে আসা পৃথিবীটাকে অনেক বেশি দূরের মনে হয়। শেষবারের মতো উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা হেলমেটের লাইটটা জ্বেলে দিয়ে সঙ্গীদের পিছু নেয় আলেক্সাই।
সমস্যাটা যখন শুরু হয় তখন তারা সবাই স্থির হয়ে গিয়েছিল। গাঁইতি চালাতে চালাতে হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়েছিল সবাই গুড়গুড় শব্দে। শব্দটা চলে গেলেও শঙ্কাটা থেকেই গেল শ্রমিকদের মনে। আনমনে গাঁইতি চালাতে চালাতে সবাই হয়তো ভুলে গিয়েছিল আর সব। আচমকাই মনে পড়ল সব। ভয় পাবার আগেই চোখের সামনে বেরুবার পথটা চাপা পড়ে গেল মাটি ধ্বসে। অপ্রতুল বর্গাকড়িকাঠগুলো মাটির আক্রোশ আর ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। হতবিহ্বল মানুষগুলো ধুলো আর অন্ধকারে হেলমেটের লাইটগুলোকে স্থির করে রাখে। ভয়টা আসেনি তখনো। চমকটা কাটতেই হয়তো পিয়ে পড়ে আতঙ্ক। রেডিওতে সব ঘটনা জানায় আলেক্সাই।
খনির নিচ থেকে রেডিওতে শুনতে পেয়েই খবর খনির মালিকদের কাছে। সেখান থেকে রাষ্ট্র আর সেখান থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ। তাদের সাথে ছোট্ট সিনডারেলা আর প্রিয়তমা স্ত্রীও। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় নিরাপত্তার সংকীর্ণতা নিয়ে। তারপর আলাপ-আলোচনা আর উদ্ধারের উপায়। কয়েকদিন বাদে সিদ্ধান্ত হয় সুড়ঙ্গ করে উদ্ধার করা হবে। এদিকে প্রতিদিন একটু একটু করে রেডিও’র ব্যাটারি বাঁচিয়ে রাখে আলেক্সাই। সাথে তাদের আশাটাও। বেঁচে থাকার আশা। পরিবারের কাছে ফিরে যাবার আশা নাকি অনিশ্চয়তাটাকে অগ্রাহ্য করার আশা তা জানা নেই। যেভাবে জানা নেই এমন মুহূর্তে মানুষের নিজের চাইতে আর কারো জন্য আশাবাদ খরচ করে কিনা।) বাইরে তখন মাস তিনেকের প্রস্তুতি চলছে। খনন করে আসতে এই সময়টুকুই লাগবে।
প্রতিদিন একটু একটু করে আশা বিকোয় আলেক্সাইরা। প্রথম প্রথম নিজেরাই নিজেদের সাহস দিতো। পরে তার পরিণত হয় স্মৃতিচারণে। অতঃপর নিশ্চুপ সময় টেনে টেনে সময় পার। নিভু নিভু দু’একটা বাতি অবশিষ্ট আর। তারপর হয়তো গাঢ় অন্ধকার। ইদানিং অন্ধকারকেই আলো মনে হয়। শেষ খবর পেয়েছে ১৮ দিন হয়ে গেল। ব্যাটারি শেষ হতেই মৃত হয়ে গেছে রেডিওটা। খাবার, পানির অভাবে মৃতের মতো পড়ে থাকা দেহগুলোতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রাণ খোঁজে আলেক্সাই। ঘুমনোর মতো শক্তিও হয়তো নেই। শুধুই অবশ পড়ে থাকা।
চোখ খুলেই প্রবল অন্ধকার দেখতে পেয়ে ভড়কে যায় আলেক্সাই। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। আচমকা মনে পড়ল তার, সে এখন খনির তলে, বন্দী। ফিরে যাবার পথ নেই। আবার ভুলে যায় সে। হঠাৎ হয়তো অবচেতনা মনে সিনডি’র খিলখিল করে হাসে। সে সময়টুকু ভারী ভালো লাগে তার। এমন স্বপ্ন সে বারবার দেখতে চায়। অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে তার চারপাশে। অন্ততঃ তার তাই মনে হয় এই মুহূর্তে। এরপর অনেকটা সময় নাকি অল্পসময় পরেই, সময়ের হিসেবটা সে আর রাখতে পারছে না ক’দিন ধরে; হঠাৎ দূরে যেন একটা আলো দুলে উঠে। প্রথমে বুঝতে পারে না আলেক্সেই। আবার যেন নড়ে ওঠে। আলোটা যেন আলেক্সেইকে আবার নতুন প্রাণ দেয়। লাফ দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে। শরীর খুব একটা নড়ে না। আলোটা চোখের সামনে বড় হতে হতেই চোখে আর কিছু দেখতে পায় না আলেক্সেই।
মাসতিনেকের কাজ মাত্র অর্ধেক সময়েই করে দেখিয়েছে উদ্ধারকারী দল। দ্রুতই খুঁজে বের করা হলো জীর্ণ শীর্ণ দেহ। প্রাণ আছে কি নেই জানা নেই আমাদের। উদ্ধারকারীদের একজন পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় আমাদের আলেক্সাই’র কাছে। আলেক্সাই’র কুঁকড়ে যাওয়া মুখ। শুকনো, ফেটে চৌচির।
আজ এক কিংবা বত্রিশ জন আলেক্সাই’র মুক্তির দিন।
৩ সেপ্টেম্বর ২০১০
১.৫১
পাদটীকা: পেরু'র তামা-স্বর্ণ খনিতে গত ৫ আগস্ট আটকে পড়া ৩৩ জন খনিশ্রমিকের উদ্দেশ্যে।
প্রথম প্রকাশ: Click This Link