শুভেচ্ছা দত্তের বিয়ে উপলক্ষে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করলেন সালমা বেগম। শুভেচ্ছা হিন্দু মেয়ে। সালমা মুসলমান। একটা হিন্দু মেয়ের বিয়েতে স্মারক বের করছে আরেকটা মুসলিম মেয়ে! লিখছে প্রাণ খুলে! মানুষের এই নির্মলতা দেখে আমাদের চোখ ভিজে ওঠে।
স্মারকের প্রকাশক-সম্পাদক মুসলমান। অধিকাংশ লেখক মুসলমান। যেখানে লেখকেরা তাদের প্রিয় 'শুভেচ্ছাকে' নিয়ে স্মৃতিচারণের পর স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই স্মৃতিচারণ শুধু বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে নিয়ে নয়, নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়েও। যে-মুখর দিনগুলোর সঙ্গে ওই মেয়েটিও জড়িত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই সৌন্দর্য দেখে আনন্দে আমাদের চোখ ভিজে যায়।
সিলেট শহরের মদনমোহন কলেজের ছাত্রী ছিলো শুভেচ্ছা। গান করতো, কবিতা লিখতো। গান ও কবিতার সূত্রেই একদা পরিচয় হয় কবি ও গীতিকার সৈয়দ মবনু'র সঙ্গে। সেই থেকে শুরু। শুভেচ্ছা আসতে থাকে মুসলিম ছেলেদের পরিচালিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে। করতে থাকে গান। বাড়তে থাকে তার মুসলিম বন্ধু-বান্ধব। কী আশ্চর্য, মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই শুভেচ্ছা হয়ে ওঠে সবার প্রিয়। আত্মা দিয়ে জয় করে নেয় সবগুলো আত্মা। আর এভাবেই একদিন তার বিয়ের বয়েস হয়ে যায়। বিয়ের দিন এসে যায়।
বিয়ে উপলক্ষে স্মরকগ্রন্থ বের করার একটা চল্ সিলেটে বেশ পুরনো। কিন্তু শুভেচ্ছার বিয়েতে স্মারক বেরোলো_পারিবারিকভাবে নয়, বন্ধুদের মাধ্যমে। বন্ধুরা বের করলো। প্রকাশনার খরচ দিলেন সালমা বেগম ( সৈয়দ মবনুর সহধর্মিনী )। সম্পাদনা করলেন নেছর আহমদ জামাল ও অঞ্জন কর। লিখলেন বন্ধুজন সুধিজন, সকলে। আশীস করলেন বাবা সাধন দত্ত ও মা নন্দা রাণী দত্ত, মদনমোহন কলেজের অধ্যক্ষ কৃপা সিন্ধু পাল, জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিষদের সেক্রেটারি অসিত ভট্টাচার্য, জেলা বারের আইনজীবী এডভোকেট বিমান চন্দ্র দাস, মদনমোহন কলেজের শিক্ষক বিপ্রেশ রঞ্জন রায়, বিপ্লব রায় জন, বিজিত কুমার দে, এমসি কলেজের শিক্ষক অহিদুজ্জামান, বিশ্বনাথ কলেজের শিক্ষক তাপসী চক্রবর্তী লিপি, আবৃত্তিকার দেবাশীষ চৌধুরী রাজা, গীটারশিল্পী সুবর্ণা চৌধুরী, তাহিরপুর উপজেলার ইউএনও নাসরিন জাহান খান, এবং আরো অনেকে।
লিখলেন সৈয়দ মবনু, অঞ্জন কর, লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমার সাহিত্যসম্পাদক কবি আহমদ ময়েজ, লিটলম্যাগ শব্দপাঠের সম্পাদক কবি আবু মকসুদ, কবি কাজর রশীদ, রোদেলা খাতুন, কাইয়ুম আবদুল্লাহ, নুরুন নেসা বেগম, রঈস দীন, খালেদ সানোয়ার, ছড়াকার মতিউল ইসলাম মতিন, সাধন দত্ত, সৈয়দা শাহরিনা রহমান বীথি, নেছার আহমদ জামাল, সৌরভ ভূষণ দেব, দোলন রাণী দাস, সৈয়দা মারহামা ও শুভেচ্ছা দত্ত।
স্মারকের প্রকাশক সালমা বেগম লিখেছেন, 'শুভেচ্ছা আমাদের খুব স্নেহের বোন, দিলীপ বাবু নিয়ে যাচ্ছেন তাকে আমাদের কাছ থেকে। আমরা আশা করবো তিনি আমাদের থেকে বেশি স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেবেন তাকে আমাদের কথা।'
পীর-আউলিয়ার দেশ এই বাংলাদেশের নরোম মাটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ধারা বেশ পুরনো। শত শত বছরের মুসলিম শাসনে এ অঞ্চলের মানুষ এসেছে হৃদয়ের কাছাকাছি। একে অপরের। শয়তান ব্রিটিশরা এসে এই ঐক্যে ফাটল ধরায়। সর্বপ্রথম। রাজনৈতিক স্বার্থে তারা এখানে বিভাজন সৃষ্টি করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে অনৈক্যের বীজ বপন করে। ব্রিটিশরা যখন অনৈক্যের বীজ বপন করতে শুরু করে, তখন এদেশের পীর-দরবেশরা প্রেমের বাণী প্রচার করে সাধারণ মানুষের মাঝে ঐক্যের বীজ বপন করতে শুরু করেন। ব্রিটিশদের বিভাজননীতিকে রবীন্দ্রনাথ আখ্যায়িত করেছেন 'বিরোধের চাষ' হিসেবে। দায়ি করেছেন তাদের 'ডিভাইড এন্ড রুল' নীতিকে। লিখেছেন : 'এই বিরোধ মিটাইয়া দেওয়া গবর্মেন্টের আন্তরিক অভিপ্রায় নহে। পাছে কংগেস প্রভৃতির চেষ্টায় হিন্দু-মুসলমান ক্রমশ ঐক্যপথে অগ্রসর হয় এইজন্য তাহারা উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মবিদ্বেষ জাগাইয়া রাখিতে চান।' ( কালান্তর : 'সুবিচারের অধিকার' প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
ব্রিটিশদের এই চক্রান্তের জালে আটকা পড়ে গেলো ভারতের হিন্দুরা। কিন্তু বাঙালিরা বুঝে ফেললো ব্রিটিশদের এই ধূর্তামি। ফলে তারা সংকীর্ণ ধর্মবোধের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে গেলো ইসলামের উম্মুক্ত বিশালতায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ' খিলাফত আন্দোলনের সময় মুসলমান হিন্দুকে মসজিদ বা অন্যত্র যতোখানি টেনেছে, হিন্দু ততোখানি টানতে পারে নি।'('কালান্তর')। বর্ণনা করেছেন, নিজের কাছারিতে দেখেছেন মুসলমান প্রজাদের বসতে দেয়া হয় জাজিমের এক প্রান্ত তুলে। ( কালান্তর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
মরমী পীর-দরবেশদের কল্যাণে সেদিন বাঙালিরা ব্রিটিশদের চক্রান্ত থেকে বেঁচে গিয়েছিলো বলে বাংলাদেশ আজ সাম্প্রদায়িক সম্পীতির দেশ। তবে কিছু বদ লোক আমাদের সোনার এই দেশকে বহির্বিশ্বে সাম্প্রদায়িক দেশ প্রমাণের চক্রান্তে লিপ্ত। এরা 'সংখ্যালঘু নির্যাতনের' কাল্পনিক ডকুমেন্টারি বানায়। বিদেশে ছড়ায়। এদের এই শয়তানি দেখে দুঃখে আমাদের চোখে জল এসে যায়। আমাদের চোখ ভিজে যায়।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ আগে যেমন ছিলো, আগামিদিনে তেমনি থাকবে। এখাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দিনদিন আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে, আমরা দাঁড়াবো একই কাতারে, করবো হাত ধরাধরি, আসবো হৃদয়ের কাছাকাছি। ওই বদ লোকগুলো চক্রান্ত করবে, করুক।