somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সন্ত্রাসবাদের সত্য-মিথ্যা

০১ লা জুন, ২০১০ ভোর ৪:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্ষুদিরাম বসুর আত্মত্যাগ ব্রিটিশ ভারতের স্বদেশী আন্দোলনে প্রবল গতি সঞ্চার করেছিলো। কলকাতার অত্যাচারী চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে বোমা নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কিংসফোর্ড যে গাড়িতে থাকার কথা ছিলো, বোমা নিক্ষেপ করেন সেই গাড়িতেই। কিন্তু কিংসফোর্ড বেঁচে যায় অন্য গাড়িতে থাকার কারণে। মারা পড়েন দু'জন ইংরেজ মহিলা। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন এবং ইংরেজের বিচারে তার ফাঁসি হয়। সে ১৯০৮ সালের কথা।

স্বদেশী আন্দোলনের এই বিপ্লবী শহীদ দেশপ্রেমের প্রতীকে পরিণত হন। তাকে নিয়ে অনেক অনেক গান রচিত হয়। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী একটা গান হলো, 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।' সেই ক্ষুদিরাম বসু ভারতবাসীর কাছে দেশপ্রেমের প্রতীক হলেও ইংরেজের দৃষ্টিতে ছিলেন সন্ত্রাসী, খুনী।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে। গরু ও শূকরের চর্বি ব্যবহার করে যে কার্তুজ তৈরি করতো ইংরেজরা, হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের সিপাহীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে সেটা। হিন্দু ধর্মে গরু ও মুসলমান ধর্মে শূকর নিষিদ্ধ। অথচ বন্দুক চালাতে গিয়ে প্রতিবারই গরু-শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজে কামড় বসাতে হচ্ছে এদেশীয় সৈন্যদের। এ নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পুঞ্জিভূত সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে সিপাহী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা কয়েকজন ইংরেজ সেনা অফিসারকে হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ইংরেজরা নৃসংশ হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। প্রাণ যায় হাজার হাজার মানুষের। পুড়ে ছাই হয় বাড়িঘর। দিল্লীর রাস্তার দুই পাশের গাছগুলিতে ঝুলে থাকে চৌদ্দহাজার আলেমের লাশ। মঙ্গল পাণ্ডে ধরা পড়েন এবং ইংরেজের বিচারে তার ফাঁসি হয়। পরবর্তীকালে তাকে নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেই মঙ্গল পাণ্ডে কিংবা চৌদ্দহাজার সংগ্রামী আলেম ভারতবাসীর কাছে বিপ্লবীর মর্যাদা পেলেও ইংরেজের দৃষ্টিতে তারা ছিলেন দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী।

শহীদ সূর্যসেন, যিনি চট্টগ্রামে ইংরেজের অস্ত্রাগার লুট করেছিলেন, তাকে নিয়েও লেখা হয়েছে প্রচুর কবিতা। কিন্তু ইংরেজরা তাকেও হত্যা করে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে।

এদেশে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লড়াই শুরু করে ওয়াহাবিরা। শহীদ তিতুমীর ছিলেন ওয়াহাবি ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত একজন সংগ্রামী। তার 'নারকেলবাড়িয়ার জঙ্গ' বা 'তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা' আমাদের কাছে বিপ্লবী ইতিহাসরূপে সমাদৃত। কিন্তু সেই তিতুমীরকে ইংরেজরা বলতো, ধর্মোন্মাদ, সন্ত্রাসী।

আজকের পৃথিবীতে একটা অতি উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ বা টেরোরিজম। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও তাদের প্রচারমাধ্যমেই অহরহ শোনা যায় এ শব্দ; এবং যাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এরা উদ্বাস্তু কিংবা দখলদারের কাছে বাড়িঘর হারানো দুঃখী মানুষ। তখন প্রশ্ন জাগে, 'সন্ত্রাসবাদ' আসলে কী? স্বাধীনতার জন্য লড়াই আর সন্ত্রাস কি একই কথা? অথবা, কী সেই কারণ, যে জন্যে জন্ম হচ্ছে 'সন্ত্রাসবাদের'?
পশ্চিমারা আজকাল সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসেবে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে দায়ী করেছে। বিশেষ করে ইসলামের প্রতি অঙ্গুলি-নির্দেশ করছে তারা। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীরা ইতোমধ্যে ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সমার্থক শব্দ বানিয়ে ফেলেছে। তাদের মুখে এটাও শোনা যায়, ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যার ইনফ্রেস্টাকচারের মধ্যেই সন্ত্রাসবাদী চিন্তাভাবনার বীজ লুকিয়ে আছে। তাদের এই দাবি কতোটা সত্য, সেটা দেখার আগে আমরা চেষ্টা করবো অন্য ধর্ম ও ভাবাদর্শে থাকা সন্ত্রাসী সংগঠনের একটা ছোট্ট তালিকা তৈরি করতে, এতে সন্ত্রাসবাদের হকিকত বোঝা আমাদের জন্য সহজ হতে পারে।

হামাস কিংবা বিন লাদেনের আল কায়দার বহু আগেই সুইসাইড স্কোয়াড বা মানববোমা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালিয়েছিলো শ্রীলংকার তামিল টাইগার বা এলটিটিই। এরা কিন্তু ধর্মে হিন্দু এবং বিশ্বের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কথা, এরা পৃথিবীর একমাত্র জঙ্গি সংগঠন, যারা সে দেশের সরকারি স্থাপনায় বিমান হামলা পর্যন্ত করেছিলো। যাদের রয়েছে নিজস্ব বিমান ও নৌ-বাহিনী। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল প্রচণ্ড ছিলেন মাওবাদী গেরিলা নেতা। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় জঙ্গি মাওবাদীরা প্রচণ্ড সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। এই মাওবাদী গেরিলাও হিন্দুদের হাতে তৈরি। ভারতের পূর্বাঞ্চলের 'সেভেন সিস্টার্সে' স্বাধীনতাকামী যে সংগঠনগুলো লড়ছে, ধর্ম বিশ্বাসে তারা হিন্দু। ভারত তাদেরকে বলে আতংবাদী।

নর্দান আয়ারল্যান্ডের আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, ব্রিটিশরা যাদেরকে বলতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী, তারাও বিশ্বাসী ছিলো খ্রিস্টধর্মে। খ্রিস্টধর্মে গভীর অনুরাগী বাস্করা স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। স্পেন এদেরকে আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। কম্বোডিয়ার পলপটের আমলে খেমারজরা ছিলো বৌদ্ধ, যাদের সন্ত্রাসী বলা হতো। ইহুদি 'ইরগুনজাই' 'হাগানা' 'স্ট্যার্ন গ্রুপের' মতো সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই আরবদের উৎপাত শুরু করে এবং সর্বাত্মক গুপ্ত হত্যায় মত্ত হয়, যার সঙ্গে সাম্প্রতিককালের বসনিয়ার গণহত্যার তুলনা চলে। লাতিন আমেরিকার ইতিহাস ঘাঁটলেও মৌলবাদী খ্রিস্টানদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অনেক নজির মিলবে। সুতরাং সন্ত্রাসের প্রজননকেন্দ্র বা আঁতুড়ঘর হিসেবে ইসলামকে চিহ্নিত করা যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলাই বাহুল্য।

স্বাধীনতাকামী, সন্ত্রাসী বা আতংবাদী যে নামেই ডাকি, এরা যে কেবল ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়, অন্য ধর্মে বিশ্বাসীরাও যে এই দলে আছে, এমনকি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী আদর্শগুলোও যে নানাভাবে সন্ত্রাসবাদকে পুষ্ট করেছে, তার প্রমাণও মেলে ইতিহাসে। নাজিজম-ফ্যাসিজমের কথা তো সবারই জানা।

সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিকতার আড়ালে বিশ্বসন্ত্রাস চালিয়েছে আজকের সেক্যুলার ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো। হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি এখনও মুছে যায় নি। বিন লাদেনের তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাস নিয়ে আমেরিকা যে বাণিজ্য করছে, বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সে আমেরিকার ধর্ম-উম্মাদনাময় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের খবর কী? নাইন-ইলেভেনের বিমান হামলার পর প্রেসিডেন্ট বুশ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে নিহতদের জন্য যে প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সে আহ্বানের কথাগুলো ছিলো এরকম : আমি প্রার্থনা করি, এমন একটি শক্তি আজ তাদের পাশে দাঁড়াবে, যে সকল শক্তির চেয়ে বড়। যুগ যুগ ধরে তেইশতম সমাচার (বাইবেল) যা বলে এসেছে... যদিও আমি মৃত্যুর ছায়াময় উপত্যকার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, তবু আমার ভয় নেই, কারণ ঈশ্বর আমার সঙ্গে আছেন। পরক্ষণেই তার উচ্চারণ : এই কাজ (বিমান হামলা) যারা করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে, উভয়ের মধ্যে আমরা কোনো ফারাক রাখবো না। যেখানেই থাকুক আমরা তাদের খুঁজে বের করবো, তাদের বিচার করবো।
এই 'বিচারের' পরিণতিতে আফগান-ইরাক দোযখে পরিণত হলো। লাখ লাখ নিরীহ মানুষ, নারী ও শিশুর প্রাণ গেলো। জর্জ বুশ এই যুদ্ধকে ক্রুসেড ও ইনফিনিটি জাস্টিসের সঙ্গে তুলনা করলেন, যে বিষয়গুলো খ্রিস্টান ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। তার মানে বুশও ধর্মকে আশ্রয় করে সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধে নামলেন এবং এই ধ্বংসযজ্ঞকে জায়েয করার জন্য ধর্ম থেকেই বৈধতা খুঁজলেন। তাহলে বুশকে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী বললে কি অন্যায় হবে?

আজকের পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলোতে 'সন্ত্রাসবাদ' একটি অতি উচ্চারিত বিষয়। এই বিষয়টিতে কাঁচামাল হিসেবে তারা ইতোমধ্যে বিন লাদেনকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। কিন্তু বিন লাদেনকে তার সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে কেউ বিচার করে নি। কারণ সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা বিশ্বজোড়া তার কুকীর্তি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ঢাকতেই বিন লাদেনকে বার বার সামনে খাড়া করেছে। এটা নতুন নয়, সাম্রাজ্যবাদীরা বরাবরই সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতার আড়ালে সন্ত্রাসকেই নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়।

নাইন-ইলেভেন কিংবা বিন লাদেন একদিনে তৈরি হয় নি। লাদেনের মনও একদিনে আমেরিকার বিরুদ্ধে খেপে ওঠে নি। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় থেকে পবিত্র ভূমি জাযিরাতুল আরবে বিধর্মী মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি, যুদ্ধের পর ইরাক অবরোধের কারণে সে দেশের মানুষের সীমাহীন দুর্দশা, শিশুদের মৃত্যু, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারীতে মার্কিন সমর্থন -- এসব কারণই বিন লাদেনকে আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমেরিকার শত চেঁচামেচির পরও লাদেনের মার্কিনবিরোধী জেহাদ আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। এর কারণটা অবশ্য মুসলিমবিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে নিহিত। মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও দালালীর কারণে সাধারণ মানুষ ফুঁসছে। এই অপদার্থ শাসকগোষ্ঠীকে দেশের জনগণের ক্ষোভ থেকে আড়াল করতে এগিয়ে আসছে আমেরিকা। এবং এদের দ্বারা ইচ্ছেমতো নিজেদের সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই সুবিধা ভোগ করতেই আমেরিকা চায় না ওই দেশগুলোতে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। যে কারণে দেখি, ইরাক-আফগানে বোমা মেরে 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করলেও মধ্যপ্রাচ্যের জুব্বাঅলা শেখদের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখছে ঠিকই। কারণ এতে যে আমেরিকারই লাভ। এই অবস্থায় মানুষ যদি আমেরিকাকে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, আশ্চর্যের কী!

আজকের বিন লাদেন কিংবা সন্ত্রাসবাদ হলো বিশ্বজোড়া মার্কিনীদের বেইনসাফির ফল। মানুষ যখন অত্যাচার ও বঞ্চনার শিকার হয়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে, তখন বিদ্রোহী না হয়ে পারে না। এটা মরার আগে শেষ ঝাঁকুনি দেয়ার মতো। যেদিন আমেরিকা বিশ্বজুড়ে তার আগ্রাসন থামিয়ে দেবে, বিন লাদেন বা সন্ত্রাসবাদীদের কণ্ঠও সেদিন নীরব হবে।

আজকের সন্ত্রাসবাদকে কি পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের ফল বলা যাবে? হ্যাঁ, যাবে। লাদেন বা তালেবানদের কথাই ধরি, এই তালেবানদের লালনকর্তা কে? আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের পর 'গণতন্ত্রী' আমেরিকাই তো তালেবানদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়েছিলো, সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানের মাটিতে একটা 'ভিয়েতনাম যুদ্ধ' উপহার দিতে। এখানে তালেবানকে সাহায্য করা মানে শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিকে খর্ব করা। হলোও তাই। পুরনো শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তি খর্ব হলো। তারপর এগিয়ে এলো মার্কিনীরা। আবির্ভূত হলো বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে। এর পরের ঘটনা তো সবারই জানা। সোভিয়েত আগ্রাসনের পর মার্কিন আগ্রাসন শুরু হলো। ফলে বিন লাদেন ও তালেবানরা ঘুরে দাঁড়ালো মার্কিনীদের বিরুদ্ধেই। পিতা ও পুষ্যপুত্রদের লড়াইয়ে তপ্ত হলো পৃথিবী। তাহলে ফলাফল দাঁড়ালো এই : সন্ত্রাসবাদের কার্যকারণ ইসলাম নয়, সাম্রাজ্যবাদের বেইনসাফি। সেই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে দুই পরাশক্তির অন্যায্য কর্মকাণ্ডের কারণেই তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।

আজকের পৃথিবীতে শান্তিকামী মানুষের মধ্যে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব যে দিন দিন বাড়ছে, তার মূলে আছে একটি গভীর অসুখ -- যার নাম ফিলিস্তিন। আজ ইসলামি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মার্কিনীরা যে হইচই করছে, তার প্রেক্ষাপট ও বিকাশের ক্ষেত্র তো ওই ফিলিস্তিনই। পত্রপত্রিকা ও টিভিতে যে আমরা দেখি, ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোররা দখলদার ইসরাইলের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সমুখে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়ছে, তাদের একেকটি ঢিলের বিপরীতে ইসরাইলী সৈন্যদের মারণাস্ত্রগুলো গর্জে উঠছে, এই শিশুরা লাশ হচ্ছে -- এদের অপরাধ কী? অথচ পশ্চিমা একচোখা প্রচারমাধ্যমগুলি ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার সংগ্রামকে যতটা সম্ভব বিকৃত করে দেখায়। তাদের চোখে ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোররা সন্ত্রাসী আর দখলদার ইসরাইলী সৈন্যরা এনজেল। এই অসম যুদ্ধ, ফিলিস্তিনিদের উপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, আবার তাদেরকেই দোষী বানানোর অপচেষ্টা -- এটা বিশ্বাবাসীর সামনে পরিষ্কার। বিশ্ববাসী দেখছে ফিলিস্তিনি মজলুম জনগণ একই সঙ্গে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও জায়োনিজমের বিরুদ্ধে লড়ছে। আজকের 'সভ্য' পৃথিবীতে মানবাধিকারের বিধি-বিধান ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সম্পর্কে যেসব আধুনিক চুক্তি, সনদ ঘোষণা আছে, এতে এতোদিনে ফিলিস্তিনিদের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবার কথা। কিন্তু হয় নি। এটা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষকে পশ্চিমাবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ক্ষুব্ধ করে তুলছে। 'সভ্য' দুনিয়ায় মানবাধিকারের এই যখন অবস্থা, তখন বিন লাদেন এসে যখন মার্কিনবিরোধী জেহাদের ডাক দেন, তখন অতি সহজেই এটা মজলুম মানুষের অনুমোদন পেয়ে যায়। লাদেনের কণ্ঠস্বরকে তখন নিপীড়িত মানুষেরা মনে করে নিজেদের কণ্ঠস্বর।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলী দখলদারির একষট্টি বছর হয়ে গেছে। এই একষট্টি বছরে অনেক রক্ত ঝরেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় নি। প্রথম কয়েক দশকে ফিলিস্তিনিরা রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু কাজ হয় নি। তখনও সুইসাইড স্কোয়াডের জন্ম হয় নি। আত্মঘাতি হামলার ঘটনা ঘটে আরও পরে। ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল ইসরাইলের আফুলা শহরে। এর কিছুদিন আগে (২৫ ফেব্রুয়ারি '৯৪) হেবরন শহরে নামাজরত অবস্থায় ২৯ জন মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করে জায়োনিস্ট নেতা বারোক গোল্ডস্টাইন। তার বদলা নিতে এবং ফিলিস্তিনের প্রতি বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে আত্মঘাতি মানব-বোমার জন্ম হয় ফিলিস্তিনে। এর পর থেকেই চলছে।

আত্মঘাতি মানব-বোমা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য প্রস্তুত ফিলিস্তিনি যুবক ইউনুসের স্বীকারোক্তি এরকম : আমি ভালো করেই জানি, ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কিছুই করতে পারবো না, মুহূর্তেই ট্যাংক আমাকে পিষে ফেলবে। তাই আমি নিজেকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবো। এরা এটাকে বলে সন্ত্রাসবাদ। আমি বলি আত্মরক্ষার লড়াই। (Inside the world of the Palestine suicide bomber, the Sunday times, London) ফিলিস্তিনি যুবকদের এই আত্মঘাতি বোমা হামলাকে যদি সন্ত্রাস বলি, তবে যারা তাদেরকে এই কাজ করতে বাধ্য করছে তাদেরকে কী বলবো?

তাই আজকের সন্ত্রাসবাদের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরাই দায়ী। মার্কিন দখলদারীর আগে ইরাকে আত্মঘাতি বোমার নজির ছিলো না। মার্কিনীদের দখলদারী ও অত্যাচারের পরেই এর সূত্রপাত। আফগানিস্তানেও তাই। অতএব স্বীকার করতেই হবে, পশ্চিমা দখলদারী ও আধিপত্যবাদের মধ্যেই সন্ত্রাসের বীজ লুকিয়ে আছে, ইসলামের মধ্যে নয়।
আজকের পশ্চিমা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদকে নিয়ে গবেষণা চলছে। পশ্চিমা তাত্ত্বিকরা এটাকে বলছে মনোবিকলনের সমস্যা। এতে তাদের সুবিধা। সন্ত্রাসবাদকে রোগ হিসেবে ধরে নিলে বিশ্বজুড়ে তাদের অন্যায় অত্যাচারের দিকগুলি আড়াল করা যাবে। অনেক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আসলে পশ্চিমারা হানাদারিতে যেমন পাকা, তত্ত্ববাজিতেও তেমনি নিপুণ। কিন্তু তাদেরকে এই সত্যও মনে রাখতে হবে, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম চলবেই, তাকে যে নামেই ডাকা হোক।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×