somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ হাইওয়ে

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কাঁচ নামিয়ে দিলাম আমি।ওয়াসা, বিটিআরসি আর পিডিবি’র কল্যাণে চট্টগ্রাম শহরের যে রাস্তা দিয়েই গাড়ি চালাই, শুধু ধূলা ওড়ে। সেই ধূলার সমুদ্র পেরিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ হল। অনেকক্ষণ ধরে ড্রাইভ করছি, প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেছে হাইওয়েতে উঠেছি, মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি আমার গাড়িটাকে ক্রস করে যাচ্ছে, কখনোবা বিপরীত দিক থেকে দুয়েকটা গাড়ি ছুটে আসছে।
দুপাশে এখন সারি সারি গাছ, মাঝখানে রোড ডিভাইডার।রোদ পড়ে চিকচিক করছে পীচঢালা রাস্তার বুক, মনে হচ্ছে যেন ভেজা রাস্তায় সূর্যের আলোর প্রতিফলন হচ্ছে।
আমি বাইরে তাকালাম। শীতের সকালে গাড়ীর জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া নরম রোদ অসাধারণ ওম দিচ্ছে, মনে হচ্ছে স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ি। ড্রাইভ করার জন্য অসাধারণ পরিবেশ।
আমি বামে তাকালাম। আমার পাশে, প্যাসেঞ্জার সীটে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন, শাড়ীর ওপর একটা হালকা ঘিয়া রঙের শাল চাপানো। ভাল করে লক্ষ্য করলাম। মহিলার বেশকিছু চুল ধূসর হতে শুরু করেছে।
-আম্মু, আমি কেমন ড্রাইভ করি? আমি জানতে চাইলাম।
-খারাপ না। আম্মুর ছোট্ট জবাব।
-খারাপ না! আব্বুর সাথে বসলে দেখতা। গত দুই ঘন্টায় একটা ঝাকিও খাইছ?
-লাইসেন্স পাইছস দুইদিন হল না আর এর মধ্যে নিজের বাপের সাথে তুলনা।
আম্মুকে নিয়ে এই এক সমস্যা। কোন কথার সরাসরি জবাব দিবে না, দিবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। আর আব্বুর চাইতে কোন কিছু ভাল করি কিংবা পারি-এই স্বীকৃতি জীবনেও দিবে না।
-গান-টান দে কিছু, শুনি।
-এদিকে কোন রেডিও চ্যানেলের সিগনাল পাবা বলে মনে হয় না।
-দিয়ে দেখ।
আমি রেডিওটা অন করলাম। কয়েকটা চ্যানেল ঘুরে ফেললাম।যা ভেবেছিলাম, তা-ই। ঘর ঘর শব্দ ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না।
-ধুর্বাল।
-ল্যাংগুয়েজ। আম্মু ধমকের সুরে বলল।
-আচ্ছা বাবা, সরি।
রেডিওটা অফ করে দিলাম।
-মাহীন।
-জ্বি।
-তোর আব্বুকে একটা ফোন দে তো।
-কেন?
-ফোন দিতে বলেছি, ফোন দে। এত কথা কিসের?
আমি ফোনটা বের করে আব্বুর নম্বর ডায়াল করলাম।
-ধর, রিং হচ্ছে।
আম্মু ফোনটা নিল।
-এই শোন…
আম্মু কথাটা শেষে করতে পার না, তার আগেই খুকখুক করে কাশতে লাগল। চেয়ে দেখি আমাদের ঠিক সামনেই একটা বালুভর্তি ট্রাক হাইওয়ের বুক চিড়ে উড়ে চলেছে, তেরপল দিয়ে ঢাকাঢাকির কোন বালাই নেই, ট্রাকের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাসে ভাসতে থাকা বালুকণা।
-ইডিয়টের বাচ্চা…
আম্মুর দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করলাম না, দুই সাইডের কাঁচ তুলে দিলাম।
-এসি দিয়ে দে। আম্মু বলল।
চালু করে দিলাম।
-আব্বু এখনো লাইনে? আমি জানতে চাইলাম।
আমার কথা শুনে আম্মুর হুশ হল। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে কলটা কেটে গেছে।এবার আম্মু নিজেই আব্বুর নম্বরটা ডায়াল করল, আমার আর করে দেয়া লাগল না।
-আরে বইল না আর, একটা ট্রাক থেকে এত ধূলা আসতেছিল, আর কি কথা বলব তোমার সাথে? শাহীন ঘুম থেকে উঠছে?
আব্বু-আম্মুর খাজুরে আলাপ চলতে থাকে। প্রিয় পাঠক, এই সুযোগে আপনাদের বলে রাখিঃ আম্মু আর আমি যাচ্ছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে, একটা আত্মীয়ের বিয়ে এটেন্ড করার জন্য। আব্বু আর আমার ছোটভাই শাহীন গতকালই চলে গেছে।আমার সেমিস্টার ফাইনাল চলছিল বলে সবাই একসাথে যেতে পারিনি। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তাই আজ সকালেই আম্মু আর আমি রওয়ানা হয়েছি।
আসলে সেমিস্টার ফাইনালতো ছিল একটা অজুহাত মাত্র। মাত্র অল্প কয়দিন আগেই আমি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছি, তাই মনে মনে সুযোগ খুঁজছিলাম হাইওয়েতে গাড়ী চালানোর। রূপা আপুর বিয়ে আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
-ধর। আম্মু ফোনটা এগিয়ে দিল আমার দিকে।
-কি?
-তোর আব্বু কথা বলবে।
-দাও। আমি ফোনটা নিলাম। হ্যা, আব্বু, বল।
-শোন…
আব্বুর সাথে কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করতে পারিনি, কোথা থেকে একটা লরি এসে হাজির হয়েছে সামনে। লরিটা আগাচ্ছে খুব ধীর গতিতে, আমার গাড়ীটা এভাবে এগোতে থাকলে ঠিক লরিটায় গিয়ে ধাক্কা খাবে!
-মাহীন, ব্রেক চাপ।
আম্মুর চিৎকারে হঠাৎ যেন ব্রেইনে তালা গেল। এত করে চেষ্টা করছি, অথচ আমার পা কোনভাবেই ব্রেকটা খুঁজে পাচ্ছে না!
-মাহীইইইন …
আম্মু এখনো তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে, সেসব কিছু আমার ব্রেইন প্রসেস করতে পারছে না। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, ব্রেকটা কোথায়? ব্রেকটা কোথায়?
-মাহীইইইন…
আম্মু প্যানিকড হয়ে গেছে, কোনভাবেই শান্ত হয়ে নিজের সীটে বসতে পারছে না।
ইয়েস, পাইছি।অবশেষে পাওয়া গেছে তাকে, পায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিলাম ব্রেকে।
এইবার থামবে গাড়ীটা।
কিন্তু এ কি?
গাড়ীর থামার বদলে স্পিড আরো বাড়ছে কেন?
তবে কি ব্রেকের বদলে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে ফেলেছি?
এই চিন্তাটা আসতেই মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেল, পা দুটো উন্মাদের মত খুঁজতে লাগল গাড়ীর ব্রেকটাকে। ব্রেক কোথায়?
-মাহীন, কি করতেছিস বাপ?
আমার ব্রেন তখন আর আম্মুর কথা প্রসেস করার মত অবস্থায় নেই। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, এই গাড়ী থামাতে না পারলে আজ আমাদের মা-ব্যাটার মৃত্যু নিশ্চিত।
অবশেষে সিদ্ধ্যান্তটা নিয়েই ফেললাম। গাড়ীটাকে বাড়ি খাওয়াতে হবে ডিভাইডারের সাথে। এটা ছাড়া গাড়ীটা থামানোর আর কোন রাস্তা নেই। ব্রেক চেপে এই গাড়ী থামানো আমার পক্ষে থামানো সম্ভব না।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।
আমি ভেবেছিলাম গাড়ীটাকে একবার ডানদিকে ঘোরাতে পারলেই ডিভাইডারের সাথে বাড়ী খেয়ে থেমে যাবে।কিন্তু গাড়ীটা বাড়ি খেয়ে থামল না, বরং লাফ দিল একটা। সেই এক লাফেই গাড়িটা ডিভাইডার পার হয়ে চলে এল রাস্তার অন্য প্রান্তে, রঙ সাইডে।
ডিভাইডার পার হওয়া এতই সোজা?
মাথায় এসব ঘুরছিল, তখনো বুঝতে পারিনি আমরা রাস্তার উলটো সাইডে চলে এসেছি, বিপরীত দিক থেকে ফুলস্পীডে আমাদেরকে সব গাড়ী অতিক্রম করে যাচ্ছে!
এতক্ষণ ভয় আর টেনশনে আম্মুর দিকে তাকাতে পারিনি, এবার তাকালাম। আম্মু জ্ঞান হারিয়েছে আগেই, মাথায় আঘাত পেয়েছে কিনা কে জানে, কপাল কেটে রক্ত পড়ছে। ভাগ্যিস সীটবেল্ট লাগানো ছিল, নাহয় কি হত কে জানে।
-আম্মু।আমি ডাকলাম।
কোন সাড়া নেই।
-এই আম্মু।
এবার আম্মু চোখ খুলে তাকাল।
-মাহীইইন, সামনে দেখ। আম্মু চিৎকার করে উঠল।
আম্মুকে নিয়ে এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম, তাই বুঝতে পারিনি। ডিভাইডার পার হওয়ার পরও গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ হয়নি, বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা গাড়ীগুলোকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে ফুলস্পীডে। আমি রোবটের মত স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে ‘আম্মু, আম্মু’ করে চিৎকার করছি আর আমার গাড়ীটা ছুটে চলেছে এক উন্মাদ দানবের মত।
আমি স্টিয়ারিং চেপে ধরে প্রানপণ চেষ্টা করতে লাগলাম গাড়ীটা সোজা করার জন্য, সেই সাথে সমানে বাজিয়ে চলেছি হর্ন। চোখে দেখে হোক, শব্দ শুনে হোক, যেভাবেই হোক-লোকজন আমার সামনে থেকে সরে যাক।
যাক, অবশেষে মনে হয় ব্রেকটা খুঁজে পেয়েছি।গাড়ীটা স্লো হতে শুরু করেছে।
প্যা… প্যা… প্যা...
কোলে পড়ে থাকা ফোনটা হঠাৎ বাজতে শুরু করল। আব্বুর সাথে কথার মাঝখানে ফোন কেটে গিয়েছিল, মনে হয় আব্বুই আবার ফোন করেছে। ফোনটা তুলতে যাব, হঠাৎ…
বুমমম …
মনে কোন খানাখন্দে পড়েছিল পেছনের চাকাটা, প্রচন্ড শব্দে তার টায়ার ফাটল।
গাড়ীটা প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলাম, আবার গাড়ীটা বাঁকা হয়ে পাশের লেনের দিকে যেতে শুরু করল। গাড়ীটা এখন রঙ সাইডে দুই লেনের মাঝখানে কোণাকুণি পথ ধরে ছুটে চলেছে…
বিপরীত দিক থেকে প্রচন্ড গতিতে একটা প্রাইভেট কার ছুটে আসছে।মাঝবয়সী একটা লোক ড্রাইভ করছে, পাশের সীটে বছর পাঁচেকের ছোট্ট একটা বাচ্চা। নিজের পুতুলটাকে জড়িয়ে সীটে হেলান দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে বাচ্চাটা।
লোকটার চোখেমুখে আতংকের ছাপ স্পষ্ট। বারবার হাত নেড়ে আমকে সরে যেতে বলছে।
লোকটা তখনও জানে না, এই গাড়ী কিংবা রাস্তা-কোনটার ওপরই আমার আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই …

{Theodore Thomas এর Test গল্প থেকে অনুপ্রানিত হয়ে}
-আমি তুমি আমরা
১৭.১২.২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:২৮
১৪টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×