আমার হেমন্ত গাঁথাঃ
হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই আমাদের পরিচিত, অনেক স্মৃতির অনেক ভালবাসার।হারিয়ে যাওয়ার এই লিস্টে যেমন আছে সামাজিক মুল্যবোধের মত অমোচনীয় রীতিনীতি তেমনি আছে আমাদের তীব্র অনুভূতির জায়গা প্রকৃতির অপরুপ রুপ।আমার ছোটবেলাটার বড় হয়ে যাবার হাহাকার কেও ছাপিয়ে আজকাল আমার কানে বাজে হেমন্তকালের মৃত্যু ঘন্টা।
হেমন্ত আমার সেই ছোট্টবেলার আপনজন ,আমার প্রিয় ঋতু রচনা লিখতে গিয়ে খুব মন চাইত একবার হেমন্তকালের কথা লিখি, সবাই তখন গ্রীষ্মের আম কাঠাল , শীতের পিঠা পুলি আর খেজুরের রস , বর্ষার কদম আর ভরা নদী খাল বিল আর শরৎের সাদা মেঘের ভেলা নিয়ে ব্যস্ত।নিতান্তই অবহেলায় বছরের কোন এক কোনায় পড়ে থাকে অলক্ষ্যে অনাদরে।সেই অবহেলায় কিনা জানি না আজ সত্যি সত্যি হেমন্তের অনপস্থিতি বড্ড চোখে পড়ে।
হেমন্তকালের প্রকৃতি আষাঢ়-শ্রাবণ কিংবা ভাদ্র মাসের মত বৃষ্টি হবার কথা নয়, কারো মন মন্দির স্যাতস্যাতে থাকার কথা নয়। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-বন বাদাড়। সৃষ্টির সকল জীবের মাঝে মাঝে দেখা মেলে চঞ্চলতা, সখা-সখিদের কলকাকলীতে মুখরিত থাকে আকাশ-বাতাস-প্রান্তর।শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত তীব্র, প্রখর অথবা মুখরা নয় তাই হেমন্তকে আলাদা করে দেখা যায় না, ম্লান, ধুসরিত আর অস্পষ্ট হেমন্তকাল শুধু অনুভবের।বসন্তের তীব্র ফুলের গন্ধ , পাখির গান অথবা গ্রীষ্মের খরতাপ, বৈশাখি ঝড় কিংবা বর্ষার ভরা নদী নালা, ঘন ঘোর বরষায় দিনব্যাপী ঝমঝম বৃষ্টির মত করে হেমন্ত জানান দেয় না আমি আছি ,আমি এসেছি।হেমন্তের এই অন্তর্মুখীতা, এই মৌনতা আমাকে আলাদা করে নাড়া দেয়।আজো নস্টালজিক হয়ে পড়ি , স্মৃতিরা কাতর করে ফেলে আমায় হেমন্তের সেই শান্ত, শব্দ হীন, নীরব দিগন্ত প্রসারিত অব্যক্ত রুপের কথা স্মরন করিয়ে দিয়ে।
হেমন্তের ব্যাপ্তিকাল সঠিকক ভাবে নিরুপন করা যায় না , কার্তিক - অগ্রাহায়ন এই দুই মাস হেমন্তকাল ধরা হলেও হেমন্ত শরৎ থেকে আলাদা নয় কিংবা শীত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।হেমন্ত নিরবে সরব থেকেও উদাসীন, নিমগ্ন নিজেকে নিয়েই।হেমন্ত একই সাথে সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় মুক্তোর মেলা আবার সোনালি পাকা ধানের মাঠের মউ মউ গন্ধ হয়ে ধরা দেয় কবির চোখে। নববধূর নতুন নোলকের গায়ে ঝিকিমিকি করা সোনা রোদের ঝিলিক প্রকৃতিতে, মৃদু হিমস্পর্শ হৃদয়ে শিহরন জাগায়। শিশির স্নাত সকাল, কাচাসোনা রোদ মাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জোস্না ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকালকে যেন আরো রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে, প্রকৃতিতে এনে দেয় আরেক ভিন্নমাত্রা।
হেমন্তের এই মৌনতাকে ছাপিয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরনের গান হয়ে , হেমন্তের একমাত্র সরব উপস্থিতি নবান্ন জানান দেয় হেমন্তের কথা ,মানুষের জীবনে এনে দেয় সার্বজনীন লৌকিক উৎসবের ছোয়া। নবান্ন মানেই নতুন অন্ন , গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এই ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব।সাধারনত অগ্রাহায়ন মাসে নতুন আমন ধান কেটে সেই ধানের চাল দিয়ে রান্না করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই নবান্ন উৎসব। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। একদিন হয়তো এইগুলো গ্রাম্য রুপকথা হিসেবে টিম টিম করে জেগে থাকবে লোকগাথা আর বইয়ের পাতায়।
নতুন ফসল ঘরে তুলে নতুন বছর শুরু করার নিমিত্তেই বুঝি এক সময় বাঙলা বছর শুরু হত হেমন্ত কাল দিয়ে, সম্রাট আকবর ও তার প্রবর্তিত বাঙলা সাল শুরু করেছিলেন অগ্রাহায়ন দিয়ে।
সকালের সোনারঙা রোদ বাড়িয়ে দেয় বাংলার পথঘাট আর মাঠের উজ্জ্বলতা , গ্রামের মাঠে যতদূর চোখ যায়, দেখা মেলে সর্ষে ফুল ৷ মনে হয়, হঠাৎ হঠাৎ ভ্রম হয় আয়েশি প্রকৃতি যেন সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে হলুদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে । চোখে পড়ে লাউয়ের মাচায় যৌবনবতী তরুণীর মতো লিকলিকে প্রতিটি ডগার খিলখিল হাসি, হাওড়-বিলে অতিথি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দও কানে আসে।এটা হচ্ছে হেমন্তে বিদায়ের খানিক আগের চিত্র , আমার হলো সারা আর তোমার শুরু গাইতে গাইতে শীতকে আহবান করে আমার প্রিয় আত্মমগ্ন হেমন্ত।
কুয়াশার ধূসর চাদর গায়ে হুট করে এক ভোরে আমাদের দোরে হানা দেয় কমনীয় শীত, শিশিরে ভিজে লাল টকটকে হয়ে ওঠে বাসার ছাদের টবের লাল গোলাপটাও ৷বিদায় নিয়ে নেয় হেমন্ত।।