ডিমের ভাঙা কুসুমের মতো রং আজ সকালের। কতোদিন পর সূর্য উঠলো। যেন কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি, এমন অপরিচিত লাগে। হিয়ার কামস দ্য সান! করমর্দন করে তাকে স্বাগত জানানো যেতে পারে, হাউ ডু ইউ ডু? পরিষ্কার নীল শরৎকালের আকাশ, আশপাশের গাছপালাগুলো ভেজা গায়ে রোদ খাচ্ছে।
কয়েকদিন টানা বৃষ্টি গেছে। আকাশ ছিলো গাঢ় ধূসর বর্ণের, বৃষ্টি থামেনি এক মুহূর্তের জন্যে। ইলশেগুঁড়ি, টাপুর-টুপুর, ঝিরিঝিরি, ঝমঝম ও ঝমাঝম - বাংলা বইয়ে যতো আছে, পালা করে সবরকম বৃষ্টি হলো এই ক'দিন। কীভাবে কে জানে, মেঘলা আকাশ মন খারাপের উপলক্ষ তৈরি করে দেয়। বৃষ্টি আমার এমনিতে খারাপ লাগে না, সব মৌসুমেই দিনে এক-আধ পশলা হলে ভালোই হয়। গভীর রাতের বৃষ্টি আমার সবচেয়ে প্রিয়, বাইরে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া তখন আর কোনো শব্দ নেই। আমার নিশীথরাতের বাদলধারা। ঘুম ভেঙে কী যেন কী মনে হয়। ভুলে যাওয়া কোনো কথা মনে আসতে চায়, তবু আসে না। বুকের ভেতরে কী এক অনুভব উঠে আসে, নিষ্কৃতি চায়। অল্প অল্প বেদনা ও বিষাদের ছায়া-অনুভব। এমন দুঃখ-দুঃখ সুখ আর কিছুতে নেই।
আমার ভালো লাগবে বলেই সব রাতে বৃষ্টি হয় না। দিনে এক-আধবার, তা-ও না। গত ক'দিনের মতো এরকম টানা বর্ষণে বিশুদ্ধ মন খারাপ, ভালো লাগার মিশেল একদম নেই।
কাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও বাইরে টিপটিপ হচ্ছিলো শুনেছি। আজ জেগে উঠে এই সোনালি আলোর সকাল। আদুরে বেড়ালের বাচ্চার মতো নরম-নরম। এরকম রোদকে হয়তো রোদ্দুর বলা যায়। মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ডিমের ভাঙা কুসুমের কথা মনে এলো কেন জানি না। ডিম আমার দুই চক্ষের বিষ। দেখতে পারি না। ভাঙা ডিমের আস্ত কুসুমটুকু তবু দেখতে তেমন খারাপ লাগে না। কিন্তু ভাঙা কুসুমের হলুদের সঙ্গে স্ববচ্ছ ট্যালটেলে বিবর্ণ অংশটা মিলেমিশে গেলে কী গা ঘিনঘিন! দেখলে বমি আসে। সেই জিনিস খাওয়ার জন্যে মায়ের প্রতিদিনের পীড়াপিড়ি, শরীর-গঠনে ডিমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণ। এড়ানোর জন্যে নাশতার টেবিলে একটা ছোটোখাটো যুদ্ধ লড়তে হয় আমাকে। বারো বছরের ঋষি কিন্তু দিব্যি তৃপ্তি নিয়ে খায়। আমার ভাগেরটা তার পাতে পাচার করে দিলেও আপত্তি করে না। ছেলে বলেই কি? হতে পারে।
বাবাও ডিম খুব ভালোবাসে, তা সে যে কোনো চেহারা নিয়ে টেবিলে আসুক - অমলেট, পোচ, ঝুরি ঝুরি, এমনকী হালুয়া রূপে হলেও। আজকাল বাবার প্রিয় ডিম তার খাদ্যতালিকা থেকে ছাঁটতে হয়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে সপ্তাহে একটার বেশি কিছুতেই নয়। হাই কোলেস্টেরলের রোগীদের জন্যে বিষ। আমারও বিষ লাগে, তবু মা শুনবে না। বুঝবেও না। আচ্ছা, মানুষ ডাক্তারের বারণ বুঝতে পারে, কারো ভালো-লাগা মন্দ-লাগা বোঝে না কেন?
কাঁঠালবাগানের ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে ছয়তলা এই ভাড়া ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় আমরা আছি পাঁচ বছর। আমরা চারজন। দুই বেডরুমের ছোটো বাসা, তার একটা বাবা-মা'র। অন্যটায় আমি আর আমার ছয় বছরের ছোটো ঋষি। দুই ভাইবোন দুটি বিছানায়, পড়ার টেবিল ও আলনা ভাগাভাগি হয়। আগে অসুবিধা হতো না। ঘুমানোর সময় দু'জনে অনেকরাত পর্যন্ত বকবক করা যেতো। এখন দু'জনেই বড়ো হয়ে উঠছি, ঘর আলাদা হওয়া দরকার। পড়ার টেবিল পালা করে ব্যবহার করতে অসুবিধা হচ্ছে। আলনায় আমার কিছু পরিধেয় জিনিস এখন ঋষিকে আড়াল করে রাখতে হয়। ঘর আলাদা না হলে আর চলছে না। দেনদরবার করছি। মা বলেছে, হবে। বড়ো বাসায় গেলেই তোকে আলাদা ঘর দেবো।
একই কথা দুই বছর ধরে শুনছি। আরো কতোদিন শুনবো, কে জানে!
ব্যালকনি আছে এরকম একটা ঘর যদি আমার থাকতো! এই বাসায় ছোটো একটা ব্যালকনি আছে, বসার ঘরের সঙ্গে লাগানো। কেউ যায় না, সেখানে স্তূপ করা আছে ঘরে সবসময় লাগে না এইসব জিনিসপত্র। রোদবৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্যে বড়ো একটা পলিথিনে ঢাকা। ঋষির ছোটোবেলার তিন-চাকার সাইকেল পড়ে আছে একলা, পরিত্যক্ত। আর আছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা দুটো ফোল্ডিং চেয়ার। এমনিতে ব্যবহার হয় না, বাসায় বেশি লোকজন কখনো এলে চেয়ারগুলো ভেতরে আসার অধিকার পায়। সোফার পাশে পেতে বাড়তি বসার ব্যবস্থা। তা-ও আজকাল আর তেমন হয় না। কয়েক বছর আগেও বাবা ছুটির দিনগুলোতে বাসায় থাকতো, তার বন্ধুবান্ধবদের আনাগোনার শেষ ছিলো না। এখন কেউ আসে কালেভদ্রে। এই বাসায় উঠে আসার পর থেকে আমাদের জীবন অনেক বদলে গেছে। হয়তো বদলে গেছে বলেই আমাদের এখানে আসা।
সকালে নাশতা পর্যন্ত বাবার বাসায় থাকা, নয়টার মধ্যে বেরিয়ে যাওয়া, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। তখন তার হতক্লান্ত চোখমুখ দেখে ভারি মায়া লাগে। বাবা যখন ফেরে, তার মুখ থাকে বিষণ্ণ ও চিন্তাক্লিষ্ট। এরকম দিন আমাদের ছিলো না, কয়েক বছরে কতোটা বদলে যেতে হলো বাবাকে। এই মানুষ ব্যালকনিতে যায় কখন, যাওয়ার কথা হয়তো মনেও আসে না।
মা বাইরে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, দরকার না পড়লে ব্যালকনিতেও যায় না। পর্দা করার ঝোঁক হয়েছে আজকাল, ধর্মকর্মে মন দিচ্ছে। বাইরে গেলে হেজাব পরে, তখন তাকে খুব অচেনা লাগে। মনে হয় আমার মা নয়, অন্য কাউকে দেখছি। মাকে একসময় টিভিতে নজরুল আর লালনের গান গাইতে দেখেছি। ঋষিও দেখেছে খুব ছোটোবেলায়, ওর হয়তো মনে নেই। তখনকার উঠতি গায়িকা নীলাঞ্জনা সুলতানা কীভাবে যেন নেই হয়ে গেলো। কী সুন্দর সুর উঠতো তার গলায়। নিয়ম করে রেওয়াজে বসতো, এখন যেমন নামাজে বসে। আমি নিজেও মাঝেমধ্যে গলা মেলানোর জন্যে পাশে বসেছি। আমাকে গান শেখানোর শখ ছিলো, কিন্তু তা পূরণ করা আমার হলো না। সারেগামা শিখতেই ধৈর্য ফুরিয়ে যায়। বাক্সবন্দী হারমোনিয়াম পড়ে আছে মার ঘরে খাটের তলায়। গান-বাজনার কথা মা আর মুখে তোলে না, হয়তো শুনতেও চায় না।
একদিন মা নামাজ শেষ করে উঠেছে তখন বললাম, তুমি না আমাকে গান শেখাতে চেয়েছিলে। ছোটোবেলায় ইচ্ছে করেনি, বুঝিওনি ভালো। এখন শেখাবে?
মা খর চোখে কতোক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোধহয় আমার মতলব বোঝার চেষ্টা করলো। কী বুঝলো বলা মুশকিল। তারপর আলগা গলায় বললো, তোর বাবাকে বলিস মাস্টার দেখতে।
বাবাকে বলতে হলে আমাকে বলতে হবে। মা বলবে না। তাদের দু'জনের মধ্যে কথা কম হয়, খুব দরকার না পড়লে একদম বন্ধ। চোখে দেখা যায় না, কিন্তু বাসার ভেতরটা কেমন যেন গুমোট হয়ে থাকে টের পাওয়া যায়। বাবা-মা দু'জনেই বাসায় থাকলে ঋষি আর আমি নিজেদের ঘরের ভেতরে থাকি, গান শুনি। ঋষি টিভি দেখার জন্যে মাঝেমধ্যে বসার ঘরে যায়, আমি যাই না। কখনো-সখনো দু'চারদিন আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়, বাবা-মা দু'জনেই বেশ হাসিখুশি। আমরা দুই ভাইবোনও তখন তাদের সঙ্গে বসে গল্প করি। তখনো আমার ভয় ভয় করতে থাকে, এই বুঝি লেগে গেলো আবার। অনেক বছর ধরে এরকম দেখে আসছি। হয়ও তাই, কোনো ব্যতিক্রম নেই।
সবসময় বোঝা যায় না, বুঝতে চাইও না কী নিয়ে গলা চড়ে যায় তাদের। তারাও হয়তো বোঝে না, বুঝতে চায় না - আমরা দুই ভাইবোন কাছাকাছি আছি, শুনতে না চেয়েও সব শুনতে পাচ্ছি। আমরা তখন নিজেদের অদৃশ্য করতে দিতে পারলে, এই বাসার বাইরে কোথাও পালাতে পারলে বেঁচে যাই। এইসব চিৎকার-হল্লা চলে, যতোক্ষণ না বাবা উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায়। মা তখনো একা একা বাতাসের সঙ্গে, হয়তা কল্পনায় বাবাকে সামনে রেখে সরব থাকে। সব বাড়িতে কি এরকম হয়? জানি, হয় না। আমার নিজের জন্যে, ঋষির জন্যে মন খারাপ হয়। আমাদের বাবা-মা এরকম কেন? ভালো লাগে না।
গানের মাস্টারের কথায় মনে মনে মাকে বলি, তুমি বাবাকে বলো না কেন? মায়ের উত্তরও আমার জানা। বলবে, বাপসোহাগী মেয়ে, বাপের জন্যে তো জান দিয়ে দিস, তুই বল।
বাবার জন্যে আমার আলাদা টান আছে, অস্বীকার করি কী করে? অন্য কারো কাছে, মায়ের কাছে তো নয়ই, প্রকাশ করতে চাই না। তবু লুকিয়ে রাখা যায় না, কীভাবে যেন সবাই জেনে যায়। এমনকি ঋষিও জানে। তবে তার পক্ষপাত কার দিকে এখন পর্যন্ত বুঝতে পারি না। এই দিক দিয়ে ও হয়তো আমার চেয়েও পরিপক্ক।
মনের কথা মনেই থাক। মুখে বলি, আমি তোমার কাছে আগে শিখে নিই, তারপর মাস্টার।
আমি তো গান ছেড়ে দিয়েছি।
ছাড়লে কেন মা? কী সুন্দর গলা তোমার।
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো।
ব্যালকনিতে আমার যাওয়া নিষেধ। মা ঠিক মায়ের মতো বলে, ধাড়ি মেয়েকে এতো বাইরে যেতে হবে না। দেখিস না পাড়ার ছেলেগুলো কেমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
কোথায় কী দেখে মা, কে জানে। মোটেই কেউ আমাদের ব্যালকনিতে তাকিয়ে বসে নেই, দূরবীণে চোখ লাগিয়েও কেউ দেখছে না। রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে একটা মেয়েকে কেউ চোখ তুলে দেখতেই পারে। তাতে কী দোষ হলো? আমিও তো বাইরে গেলে কোনো ছেলেকে লক্ষ্য করতে পারি। কী এসে যায়? মেয়ে বড়ো হয়ে উঠতে থাকলে সব মা-ই মনে হয় এরকম বোকা বোকা কথা বলে, বানিয়ে বানিয়ে ভয় পায়। সোজাসাপটা পরিষ্কার চোখে দেখে না, সবকিছুতে শুধু দোষ খুঁজতে থাকে।
কোনো কারণে রেগে না থাকলে মায়ের সঙ্গে হালকা মজা করা যায়। মেজাজের সর্বশেষ খবর সবসময় রাখতে হয়, দৈনিক পত্রিকায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখার মতো। বিপদসংকেত ধরতে না পারলে পরিণতি খুবই খারাপ হয়। পরিষ্কার মেঘমুক্ত মন-টন দেখে একদিন বললাম, আমি তো কাউকে কোনোদিন এদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি না। তুমি দেখো কেমন করে?
চোখ থাকলে ঠিকই দেখতে পাবি।
আমার কিন্তু মা মনে হয় ওরা তোমাকেই দেখতে আসে। আমাকে দেখলে পালায়।
ফাজলামো হচ্ছে, না?
আসলে এই ব্যালকনিতে এখন আমার নিজেরও আর যেতে ইচ্ছে করে না। রাস্তার ওপারে ডোবাসহ ছোটো একটা ফাঁকা জায়গা ছিলো। সেসব ভরাট হয়ে গেছে, দশতলা অ্যাপার্টমেন্ট উঠছে সেখানে। তিনতলা পর্যন্ত হয়ে গেছে, দিনভর খাটছে একদল ঘামে ভেজা মানুষ। নানারকমের ব্যস্ততা, হৈ চৈ, হাঁকডাক। ফাঁকা জায়গা কোথাও আর ফাঁকা থাকবে না মনে হয়। সামনে চোখ আটকে দেওয়া নির্মীয়মান দালানে দেখার কিছু নেই। তবু একা কখনো-সখনো গেলে ফোল্ডিং চেয়ার দুটো দেখে মন খারাপ হয়।
একদিন বিকেলে ইন্দিরা রোডে মিতালিদের বাসায় গিয়েছিলাম। স্কুল থেকে একসঙ্গে আমাদের ওঠাবসা। সন্ধ্যার আগে দেখি তার বাবা-মা ব্যালকনিতে বসেছে। হাতে চায়ের কাপ, চোখেমুখে আনন্দের দীপ্তি। কী কথা হচ্ছিলো জানি না, কিন্তু মুখ দেখেই মন ভরে যায়। মন খারাপও কি কম? আমার বাবা-মাকে এরকম কখনো দেখিনি। মায়ের কাছে শোনা, তারা নাকি দু'জনকে চিনেশুনেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো। বাবার অবশ্য দ্বিতীয়বার।
রাতে ঘরের জানালা বন্ধ ছিলো, বৃষ্টির ছাঁট যাতে ঢুকতে না পারে। জানালা খুলে বাইরে সকালের রোদ দেখে ডিমের ভাঙা কুসুমের কথা কেন যে মনে এলো! সবার হয় কি না জানি না, আমি দেখেছি অনেক সময় অসম্ভব আজগুবি একেকটা কিছু যেগুলি মনের ভেতরে কোথায় লুকিয়ে ছিলো, আচমকা লাফিয়ে পড়ে সামনে। এমনকি অপছন্দের কিছু, যা ভাবতে চাই না, ইচ্ছেও করে না, সেইসব ভেবে বসি। কোথাও পড়েছিলাম, যা কিছু তোমার অপছন্দের, তা তুমি চাইলেও কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। কোথাও কোনোভাবে, চোখের আড়ালে হলেও, তারা আছে। দুই চোখ তুমি বন্ধ করে রাখতে পারো, ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এরকম রাস্তা এড়িয়ে ঘুরপথে যেতে পারো, তবু তুমি জানো কাছেই কোথাও তারা ওৎ পেতে আছে। সময়ে ঠিক এসে উপস্থিত হবে।
হয়তো তাই, মানলাম। কিন্তু যেসবে আমার ভালো লাগা, তা-ও চোখের সামনে না থাকলেও কোথাও আছে। আমার নাগালে না থাকতে পারে, তবু আছে তো। আমার পছন্দে সব হয় না, হবে না। যেমন ব্যালকনিসহ নিজস্ব একটা ঘর। হবে কি হবে না, জানা নেই। নিশুত রাতের বৃষ্টি, তা-ও হবে হঠাৎ হঠাৎ কখনো, আমার ইচ্ছায় নয়। বৃষ্টিভাঙা সকালে সোনা রঙের রোদ দেখে ডিমের ভাঙা কুসুমের উপমা মনে পড়বে, তা-ও আমার অনিচ্ছায়।
দিনটা কাটবে কী করে, এখন ভাবতে হবে। ইউনিভারসিটি বন্ধ, কবে খুলবে তার ঠিক নেই। মাঝেমধ্যেই কী সব গোলমালে এরকম ছুটি পাওয়া যায়। রোজা আসছে সামনে, এই ছুটিটা মনে হয় এমনিতেই রোজা পর্যন্ত গড়াবে। তাহলে ঈদের আগে আর ক্লাসে যাওয়া নেই। বৃষ্টিতে ক'দিন অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে ঘরবন্দী হয়ে থাকা হলো। বৃষ্টি মাথায় প্যাচপেচে কাদাপানি এড়িয়ে হাঁটো রিকশার জন্যে গ্রীন রোডের মোড় পর্যন্ত, তারপর রিকশায় বসে বৃষ্টির ছাঁট থেকে কাপড় সামলাও। কে যায়? ক্লাস থাকলে অবশ্য যেতেই হতো। নেই বলে বাইরে না গিয়ে বৃষ্টির দিনগুলো পার হলো। আজ কোথাও যাওয়া যায়? কী করা যায়? আপাতত হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার টেবিলে যেতে হবে।
মা সেদিন জিজ্ঞেস করছিলো, এবার আমি রোজা রাখবো কি না। এই বাসায় শুধু মা রোজা রাখে। আমি একদম পারি না, খিদে সহ্য হয় না, পাগল হয়ে যাই। এমনিতে হয়তো কখনো অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকা হয়ে যায়, কিন্তু ইচ্ছে হলেও সারাদিনে কিছু খেতে পারবো না ভাবলে পেটের মধ্যে সারাক্ষণ খিদে-খিদে। গ্যাস্ট্রিকের লক্ষণ আছে বলে ডাক্তারের নিষেধ, সেই নিষেধাজ্ঞা আমাকে রক্ষা করে। এবারও হয়তো করবে, মা কিছু বলতে পারবে না। না হলে রোজার দিনে আমার খাওয়া জুটতো কোথায়? মা ঋষিকেও রোজা করাতে চায়। বলে, এতো বড়ো ছেলে, নামাজ-রোজার নাম নেই, যাবি তো দোযখে।
বাবা তাকে রক্ষা করতে বলে, বারো বছরের বাচ্চারা দোযখে যায় না।
মা গজগজ করতে থাকে। বাবা-মায়ের সরাসরি কথা না বলাবলির সময়টা হয়তো ঋষির সমান বয়েসী, বা তার চেয়েও বেশি। মাঝেমধ্যে মা-বাবার মধ্যে কখনো হাসিঠাট্টা হতে দেখলে ভাবি, নকল নয় তো! নাকি অভিনয়! বহুদিনের অভ্যাসে সত্যি ও অভিনয়ের তফাৎ দেখতে পাই না। তবু ভাবি, সুসময়টা স্থায়ী হোক। প্রাণপণে চাই, হয় না।
মোবাইল বাজছে। এতো সকালে কে? জানালা থেকে সরে আসি। এসএমএস। মেসেজের রচয়িতা এবং প্রেরক ইরফান। লিখেছে, তোর ঘুম ভেঙেছে? না ভাঙলে সাতসকালে ঝাড়ি দিবি, তাই ভয়ে ভয়ে ফোন না করে এসএমএস বাবাকে পাঠিয়ে দিলাম। ঝাড়ি-নাশতায় আমার খুব অরুচি। জেগে থাকলে এক্ষুণি ফোন কর।
ঘড়িতে সাতটা চল্লিশ। ইরফানের এখন মাঝরাত হওয়ার কথা। রাতভর কমপিউটারে বসে থাকে, রাশি রাশি ইমেল, আইএম চ্যাট। পারেও। আর আছে তার সঙ্গীত রচনা। দেশের বাইরে কোথা থেকে একটা ইলেকট্রনিক কীবোর্ড আনিয়েছে, সেটা কমপিউটারে জুড়ে দিয়ে কম্পোজ করে। এই দুই যন্ত্র মিলে গীটার, ড্রাম, সিনথেসাইজার এইসব শব্দ প্রস্তুত করে, সঙ্গীতকারের কাজ সেগুলিকে সুসংবদ্ধ করে ছাঁচে ফেলা, সুর তৈরি করা। এইসব কারিগরি সে প্রচুর উৎসাহ নিয়ে সবিস্তারে বোঝানোর চেষ্টা করে। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়, ধরতে পারি না। নিজের কয়েকটা কম্পোজিশন বন্ধুবান্ধব সবাইকে একদিন শুনিয়েছিলো। তার ঝিং-চাক যন্ত্রসঙ্গীত মন্দ লাগে না শুনতে।
তার মানে বান্দা রাতভর ঘুমায়নি। পাঁঠা একটা। ইরফান নাম বলে মেহরীন হঠাৎ তাকে ইরফান পাঠান ডাকতে শুরু করে। একদিন সাব্বির তাকে পাঠান থেকে পাঁঠায় রূপান্তরিত করে দেয়। অবিলম্বে তা গৃহীত ও প্রচলিত হয়ে গেলো সর্বসম্মতিক্রমে। ইরফান এইসব একদম গায়ে মাখে না। পাঠান বললে বলবি, পাঁঠা বললেও আপত্তি নেই, ইরফান তবু ইরফানই থেকে যাবে - এই তার ঘোষণা। এইরকম প্রবল আত্মবিশ্বাস তার। হওয়ার কথা অবশ্য। এতোসব নিয়ে যে দিনমান কাটায়, পড়াশোনা সে করে কখন? সুযোগ পেলে ক্লাসও ফাঁকি মারে। অথচ পরীক্ষায় বরাবর সবাইকে ছাড়িয়ে যায়।
আমার হঠাৎ রাগ হয়। এঃ, কে আমার এসে গেলেন, কোথাকার গোঁসাই। বললেন এক্ষুণি ফোন করবি। আমি তোর হুকুমে চলি? আমাকে এখন হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার টেবিলে যেতে হবে। বাবা বসে থাকবে, মা তাড়া লাগাবে। কাজের লোকের অভাব আজকাল, মা একহাতে সব করে। আলাদা আলাদা সময়ে খেতে বসার নিয়ম এই বাসায় নেই। নাশতা সেরে তখন ইচ্ছে হলে ফোন করবো। ততোক্ষণ তুই বসে থাকবি, ঠিক আছে?
দাঁত ব্রাশ করে চোখেমুখে পানি দিতে দিতে বুঝি, আমি আসলে অতোটা শক্ত নই। যা করবো ভাবি, তা আঁকড়ে থেকে পালন করা হয়ে ওঠে না আমার। মাঝপথে এসে আগের সিদ্ধান্ত ভুলে যাই, পাল্টে ফেলি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফোন তুলে নিই। মা ডাকাডাকি করলে তখন দেখা যাবে।
একবার রিং হতেই ইরফানের গলা, মহারানীর ঘুম ভাঙলো?
মহারানী হলাম আবার কবে থেকে? এতোদিন তো ঘুঁটেকুড়ানি পেত্নী বলেছিস।
বলতে হয় তাই বলা। আমার কথায় তুই পেত্নীও হবি না, মহারানীও না। মেসেজ পেয়েছিলি?
না হলে তোকে এই সাতসকালে ফোন করতে যাবো কোন দুঃখে? তুই না মাঝে মঝে সত্যিই পাঁঠা হয়ে যাস।
হাঃ হাঃ করে গলা খুলে হাসে, পাঁঠার হাসিটা দরাজ। বলে, তোর মুখে পাঁঠা শুনলে আমার সবচেয়ে বেশি মজা লাগে।
আবার প্রমাণ দিলি। আমি কী এমন আলাদা? আর সবার মতোই তো বলি।
কী জানি, অন্যরকম শোনায়।
বুঝলাম। এখন বল, কেন ফোন করতে বলেছিস? সারারাত জেগে কী উদ্ধার করলি?
প্লুটোর সর্বনাশ হয়ে গেছে।
কার সর্বনাশ হয়েছে বললি?
প্লুটোর। সৌরজগতের সেই সবচেয়ে ছোটো গ্রহটা।
তো তার কী হয়েছে?
তার জাত গেছে। এতোদিন সবাই জানে প্লুটো ন'টা গ্রহের একটা। এখন ইউরোপের বিজ্ঞানীরা বলছে, প্লুটো আসলে গ্রহ নয়। এদিকে আমেরিকার নাসা বলছে, তারা সেটা মানে না, প্লুটো এখনো গ্রহ।
আমার এখন মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা, হাত থেকে ফোন পড়ে যায় আর কি। ইরফান একটু ছিটগ্রস্ত সে, আমরা সবাই জানি। এখন দেখছি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তুই কি পাঁঠা থেকে পাগল হলি? সেটা প্রমোশন, না ডিমোশন?
মনে মনে ভাবা, বলা হয় না। বললেও তার কানে উঠতো, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে, যেন ঘোরগ্রস্ত। এইরকমই সে, যে বিষয়ে উৎসাহ তার শেষ দেখা চাই।
ইরফান বলে, ১৯৩০ সাল থেকে প্লুটো গ্রহ হিসেবে স্বীকৃত। ভাবতে পারিস ইউরোপীয়দের সিদ্ধান্ত টিকে গেলে আমাদের এতোদিনের জানা সৌরজগৎ পাল্টে যাবে? পৃথিবীর যাবতীয় পাঠ্য বই সংশোধন করতে হবে?
তাতে তোর কী ক্ষতি হবে?
ছোটোবেলা থেকে প্লুটো আমার সবচেয়ে প্রিয়, তা তো তুই জানিস না।
কেন, যে পৃথিবীর বাতাস খাচ্ছিস সে প্রিয নয়? চাঁদই বা কী দোষ করলো?
তুই বুঝতে পারছিস না।
পাগলকে থামানো দরকার। বলি, ঠিক আছে। পরে বুঝিয়ে দিস। এখন মা ডাকছে, যেতে হবে।
আসলে মা ডাকেনি। প্রলাপ থামানোর জন্যে বানিয়ে না বলে উপায় ছিলো না। ফোন রেখে দিয়ে আমার খারাপ লাগতে থাকে। পাগল এই নিয়ে রাতভর ইন্টারনেট ঘেঁটেছে, আমি ঠিক জানি। সেই কথা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায়। প্লুটো নিয়ে ওর এই আবেগে আমার কোনো অংশ নেই। তবু কী এমন হতো আরেকটু সময় দিলে? কতো অদরকারি কথা তো শুনি, না চাইলেও শুনতে হয়। ওগুলোতেই বা আমার কী প্রয়োজন? একটু পরে ফোন করে পুষিয়ে দেবো ঠিক করি।
এতোক্ষণে আমার মাথায়ও ঘুরতে শুরু করেছে, প্লুটো আর গ্রহ নয়। ইরফানও পাঠান নয়, পাঁঠাও নয়, সে পাগল!
নিশির সৌজন্যে

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




