বিয়ে না-করে কিছুতেই ডিভোর্স করা যায় না, ডিভোর্সের আগে বিয়ে একটা থাকতেই হয়। বিয়ে-ডিভোর্সের লং-ডিসটান্স দৌড়টা ঠিকঠাক সম্পন্ন করার জন্যে, ডিভোর্সের এই পরমুখাপেক্ষী, নির্ভরশীল এবং গৌন অবস্থানটা আগেভাগে মাথায় বসিয়ে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। হ্যাঁ, গৌন। ডিভোর্স গৌন এবং বিয়েটা হল মুখ্য। এই দীর্ঘ-দূরত্ব-দৌড়ে প্রাথমিক এবং উজ্জ্বলতর মাইলস্টোনটা অবশ্যই বিয়ে। এক মাইলস্টোন থেকে আর এক মাইলস্টোনে, দৌড়ও, দৌড়ও, দৌড়ে চল, দৌড়ে চল একটা মাইলস্টোন থেকে আরেকটায়। দৌড়বে কী করে, যদি আগে থেকে না-জানো, কোন মাইলস্টোন কোথায়, কার গুরুত্ত্ব কতটা?
এবং লং-ডিস্টান্স দৌড়ের মতই, এখানেও মূল ইস্যুটা হল ছন্দ, রিদম। দৌড়ের যে কোনো ট্রেনারকে দেখবেন, সবচেয়ে জোর দেয় এই জায়গাটার উপর। রিদম, রিদম-টা খুঁজে পাও — ঠিক রিদমের চেয়ে জোরে দৌড়লে তুমি শেষ করতে পারবে না, ট্র্যাক থেকে ফিরবে অন্যের পায়ে চেপে। আর, ঠিক রিদমের কমেই যদি থেমে গেলে, তুমি তোমার পুরো সামর্থ্যটা ব্যবহার করে উঠতে পারলে না, বিকশিত হল না তোমার পুরো প্রতিভা। বা, বিকশিত হয়ে উঠল না এই দীর্ঘ-দূরত্ব-দৌড়ের পুরো সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা। বিয়ে মানে তার অন্তরালে একটা প্রেমের প্রক্রিয়া, এবং প্রেম তো তাই যার মধ্যে উপ্ত হয়ে আছে জীবন ও সভ্যতার উর্বরতম সম্ভাবনাগুলো।
কেয়া এবং ত্রিদিব, অন্য অনেক অপ্রস্তুততর সহতৃতীয়বিশ্ববাসীর তুলনায় এই জায়গাটায় একটু ভিন্ন ছিল, তারা নিজেদের জীবনকে সচেতন নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণটাকে খুব জরুরি বলে মনে করত, দুজনেই। তাই, এবার যখন সময় এল বাঁকের মুখে বাঁশ আর ব্যানারের স্টল বানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টুপি ও ব্যাচ পরা স্বেচ্ছ্বাসেবকদের হাত থেকে ছোঁ মেরে বরফজলের প্যাকেটটা নেওয়ার, সময় কখন আসে সেটা বোঝা যায় আপনা থেকেই, বুঝতে হয়ই, সময়ই বুঝিয়ে দেয়, কেয়া-ত্রিদিবের মধ্যে একটা নোবল রিজলভ, মহত্ত্বপূর্ণ মনস্থৈর্য জন্ম নিল — তারা এবার নিজেরাই সমাধান করবে, কোনো বহিরাগত বরফজল নয়, নিজেরাই নিজেদের ভিতর জন্মিয়ে নেবে ছন্দটাকে। তারই সূত্র ধরে এল ভ্রমন এবং ভ্রমনের গল্প।
তখনো তারা জানত না, জানা সম্ভবও ছিল না, এই ভ্রমন কী কী আখ্যানের জন্ম দেবে, কী ভাবে তা বদলে দিতে থাকবে তাদের জীবন তথা জীবনোত্তর ইতিহাসকে।
খুব বিসদৃশ রকমের বিচিত্র রকমের আলাদা কিছু একটা যে ঘটে চলেছে তলায় তলায়, তার প্রথম ইঙ্গিতটা ত্রিদিব পেল টিকিট কাটতে গিয়ে। একটা বিদঘুটে চমক। জানতে পারল, রাজস্থানের টিকিটের দাম চারশো নব্বই টাকা থেকে এক লাফে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার আটশো চল্লিশ টাকায়। টিকিট কাউন্টারে এই জনিত বিরক্ত বিস্ময় জানানো মাত্র এল দ্বিতীয় চমকটা : কেন, এটা তো যাওয়ার টিকিট, ফেরার টিকিটের দাম তো কমে গেছে, বত্রিশ টাকা মোটে, আসলে টিকিটের কোনো দামই নেই, ওটা শুধু রিজার্ভেশন চার্জ, সবাই যেতে চাইছে, কেউই তো ফিরতে চাইছে না রাজস্থান থেকে।
এই প্রত্যেকটা চমকই ছিল খুব অদ্ভুত, বিচিত্র। কিন্তু গা-ছমছমে অনুভূতিটা শুরু হয়েছিল আরো অনেকটা পরে, ট্রেনে ওঠার থেকে। দাম্পত্য পুনর্নির্মাণের রোমান্টিক আবহ, তাই নৈকট্য, তাই যৌনতা — এমনকি দু-একবার এরকমও মনে হয়েছিল, রাজস্থানের জায়গায় খাজুরাহো টাজুরাহো হলেই কি ভালো হত, ওখানকার ট্যুরিজম তো হানিমুন কনসেশন দেয় বলেও শুনেছে — তাই, সহরোমান্টিক হামসফর খুঁজে চলেছিল ওরা। অন্যান্য আরো মিষ্টি, নখরা-পরায়ণ, ঘনিষ্ঠ, খুনশুটিরত জোড়-দের। সবাইকেই দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তখনই লক্ষ্য করেছিল, গোটা কামরা জুড়ে পারিবারিক মানুষ কি অসম্ভব রকমের কম। চোখের সামনে প্রতিটি মানুষই একক, চুপচাপ, তাড়িত, ভিড় এড়িয়ে চলেছে। কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলছে না, বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। আর তাদের প্রায় প্রত্যেকেই পুরুষ। এবং, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা হল, তাদের অনেকেরই একটা দুটো করে আঙুল নেই হাতের, সকলের হাত দেখাও যাচ্ছে না। একটু নার্ভাস হয়ে গেল ত্রিদিব। ডাকাতি টাকাতি কিছু হবে না তো? নিজেকে যুক্তি দিল, সব লোকই যদি ডাকাত হয়, ডাকাতি করবে কার? কেয়াকে বলল না আর, পাছে বেড়ানোটাই মাটি হয়।
মাথায় কাজ করছিল, প্রোজেক্টটা যেন টিক করে, ফিরে গিয়ে আবার যেন একই অবস্থায় পড়তে না-হয়। সময়, টাকাপয়সা, পরিশ্রম — খরচ তো কম হল না, সেটা যেন নিষ্ফলা না-যায়। ট্রেনে আর খুব বেশি কিছু কী হবে — তাও সামান্য একটু সময় একটু পরস্পরের কাছাকাছি আসা গেল। জানলার বাইরে প্রচণ্ড ঝমঝম সশব্দে পিছনে ছিটকে যাচ্ছে রাত্তির, কখনো এক আধটা আকস্মিক আলো, কখনো না-থামা না-জানা ঘুম-ঘুম স্টেশনের নিঃসঙ্গ বেঞ্চির পাশে রাতধূসর কুকুর, কখনো এক লহমার একটা লেভেল-ক্রসিং-এর গায়ে চায়ের দোকানের বিষণ্ণ হলদে আলোয় দু-তিনটি মানুষ। চুল উড়ছে হুহু করে জানলার হাওয়ায়, মুখের আরাম ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে। ত্রিদিব দু-চারবার ভাবল, কোনটা বেমানান হবে এখানে, কেয়াকে তার কাছে আসতে বলাটা, না, না-বলাটা। খুব বেশি রকমের বানানো লাগবে না তো? তারপর, যেমন হয়, গভীরতর একটা স্বতস্ফূর্ততা এসে মানুষের হ্যাঁ বা না-এর প্রশ্নটাকেই উড়িয়ে দেয়, আবেগের ঢেউয়ের মাথায় ছিটকে ওঠে ফেনা, বুদ্বুদ, পাকসাট খেয়ে ডানার ঝাপট দেয় জলের পাখি, অপ্রশ্নেয় অধিকারের গলায় ত্রিদিব বলেছিল, এই, কী হচ্ছে, এখানে এসো। কেয়াও, সময়ের গতি এভাবেই মানুষকে নিয়ে যায় তার নিজের বাইরে, বলেছিল, কেন, শোব না? আর, অনেকটা এগিয়ে এসেও থমকে গেছিল কেয়া, ত্রিদিব নিজের ভিতরকার ওঠানামা দিয়ে স্পষ্ট পাঠ করতে পেরেছিল কেয়ার থমকে যাওয়াটা, কোনটা এখানে বেশি মানাবে, আধকাতে ত্রিদিবের কাঁধে হেলান দিয়ে বসাটা, নাকি, ওর কোলে মাথা রেখে — সেটা একটু ওভার হয়ে যাবে না তো?
ত্রিদিব সেনগুপ্তদার সৌজন্যে-%
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




