প্রিয় রৌদ্রমানব,
তুমি চলে গেছো বহুদিন হলো.. তোমার স্মৃতিতে জমতে শুরু করেছে কুয়াশার ধুলো। তার উপর আমার স্বপ্নবাড়ির দরজায় ইদানিং কড়া নাড়ছে অচেনা কেউ।তবুও.. হঠাত্ ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া ভালোবাসার কয়েকশো টুকরো একসাথে জড়ো করে প্রানপণ ইচ্ছে নিয়ে আজ তোমায় লিখছি। কত কথা বলার আছে তোমাকে.. জানি তোমার একটুও সময় হবেনা এই কথামালা শোনার। না থাকুক সময়, নাইবা জানলে তুমি এই চিঠির কথা.. আমার কাছেই ঘুমিয়ে থাক আজীবন।
জানো, সেই কবে শেষবার জীবনানন্দ পড়েছি মনে নেই। তুমি চলে যাবে বলার আগমুহূর্তেও জীবনানন্দের টুকরো কবিতার দল মুঠোফোনে জমা করছিলাম তোমায় পাঠাবো বলে। মাঝখানে কতটা দূরত্ব.. কি বিস্তৃত সমুদ্র, সভ্যতা আর সময়ের ব্যবধান দুজনের মধ্যে! তবুও কবিতারা আমার সবটুকু অনুভূতি নিয়ে নিঃশব্দে পৌছে যেত তোমার মুঠোফোনে। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের শুরুতে ছিল জীবনানন্দের কবিতা.. শেষেও তাই! ভালোবাসা মানে যে বুকের গভীরে কেমন যেন আনন্দ আর বিষণ্নতা মেশানো যন্ত্রনা তা তুমি আসার আগে কখনো অনুভব করিনি। আমায় শিখিয়েছিলে কি করে ভালোবাসার সাদা ক্যানভাসটাকে আমার রঙে, তোমার তুলিতে একটু একটু করে রঙিন করে তুলতে হয়। সেইসব দিনগুলো আজও আমার অবসরের শূন্যতাকে ভরিয়ে দেবে বলে ফিরে ফিরে আসে।
আমার রাত্রিতে তোমার দিন.. চারপাশে বহুদূর থেকে ছড়িয়ে দিতে গান আর কবিতা। তোমার বিচিত্র কথা অথবা অসহ্য উদাসীনতায় রেগে যেতাম খুব, তখন একটুও বিচলিত না হয়ে আবৃত্তি করতে ওমর খৈয়ামের লেখা তোমার প্রিয় রুবাই,
"এইখানে এই তরুর তলে তোমার আমার কৌতুহলে
যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র, অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেকখানি ছন্দমধুর কাব্য হাতে নিয়ে"
কিংবা শান্তকন্ঠে বলতে, 'শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাও তো.. খুব শুনতে ইচ্ছে করছে'! আর নিজের অজান্তেই আমার অভিমানের বরফ গলতে গলতে পানি হয়ে যেতো। আজ মনে হয়, তুমি হয়তো কখনো বুঝতেই চাওনি আমার অভিমান। তোমার কাছে ভালোবাসা মানে হয়তো একসাথে একজীবনের সব কথা শেষে অনন্ত নীরবতা!
কোন কোন বর্ষার রাতে আমাদের ভালোবাসা জলের মত সহস্রধারায় ছড়িয়ে পড়তো। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ.. সেই কতদূর থেকে তুমি গাইতে, 'যত দূরেই থাকো রবে আমারই, হারিয়ে যেওনা কখনো তুমি।' আমি ভেজা চোখে তোমার গান শুনতাম.. একবার দুইবার বারবার। আজ তুমি দূর দূরান্তরের মানুষ, কে জানে এখন হয়তোবা অন্য কাউকে গান শোনাও। ভালোবাসা আমাকে আরো শিখিয়েছে, কি করে সব ভূলে নির্বিকার ভাবে বেঁচে থাকতে হয়.. আমি এই জীবনকে ভালোবেসে বেঁচে আছি। তোমার কথা আজকাল খুব একটা মনে পড়েনা। শুধু যখন কোন কোন ভোরবেলায় রাতের চাঁদটা দ্বিধা নিয়ে জেগে থাকে, তখন মনে পড়ে অনেকদিন আগে তোমার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল ভোরের চন্দ্র দেখতে দেখতে। আজ সকালে বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম, মুখোমুখি আকাশে বোকা চাঁদটা। তাতে কি.. তুমি নেই, ওই চাঁদকে এখন আমার নিছক পাথরখণ্ড মনে হয়। মনে আছে, আমাকে তুমি অলেখা কবিতার একটি লাইন দিয়ে বলেছিলে ওই কবিতার পুরোটা লিখতে। সেই কবিতাটি আমি লিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তোমাকে আর দেওয়া হয়নি। একদিন তোমায় নিয়ে লিখেছিলাম,
"তোমার কবিতার উত্তরে এগারোটি নক্ষত্র দিয়ে
পৃথিবী গড়েছি আমি,
তোমার কবিতার উত্তরে রাতের হাত ধরে জমিয়েছি শিশিরের ফুল..."
আমি ভূলেই গিয়েছিলাম তুমি কোনদিন আমায় নিয়ে কবিতা লেখোনি! কি যে ভয় পেতাম বোকার মতন.. বারবার মনে হতো তোমায় হারিয়ে ফেলবো। তুমি আশ্বাস দিতে কোনদিন আমায় ছেড়ে যাবেনা। আমি ভাবতাম, সত্যিই হয়তো আমার হাতের আঙ্গুলগুলোর জন্ম শুধু তোমার আঙ্গুলের মাঝখানে শূন্যস্থান পূরণের জন্য। রৌদ্রমানব, কেন এমন করলে? এই আমি তোমাকে প্রিয় প্রকৃতির চেয়েও বেশী ভালোবেসেছিলাম। তারপরও তুমি একটু একটু করে অনেক দূরে সরে গেছো। যাবার আগে লিখেছিলে, চলে যাওয়া মানেই ভূলে যাওয়া নয়। কেন বলেছিলে আজো বুঝতে পারিনি আমি। তোমায় প্রানপণে ভূলে যাচ্ছি আমি। ভূলে যাচ্ছি তোমার প্রিয় রঙ, প্রিয় ফুল, প্রিয় মুহূর্ত.. সব। তোমার অসম্ভব মায়াময় কণ্ঠ, নিষ্পাপ দৃষ্টি, সর্বনাশা হাসি, ছেলেমানুষী রসিকতা আর অর্থহীন বিষণ্নতা.. সবকিছু ভূলে যেতে চাই আমি। আমার নিজস্ব পৃথিবীতে কেটেই তো যাচ্ছে ব্যস্ত সময়। তারপরেও মনের গহীন কোনে কিসের যেন শূন্যতা..আমি জানি এ তোমার জন্য হাহাকার। নিয়তিকে মেনে নিয়েছি, মানিয়েও নিয়েছি.. শুধু মনটা কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা। সাধে কি আর বলে, অবুঝ মন!
আগের মতই কবিতা লিখি, এখনো বাংলাদেশ নিয়ে শিশুসুলভ পাগলামী করি, হাসিমুখে একনাগাড়ে অনর্গল কথা বলে যাই। তবে এখন আর কাউকে বোকার মত না দেখেই ভালোবেসে ফেলিনা, অন্তর্জালের একজনকে সবটুকু বিশ্বাস উপহার দেইনা।
তোমার কথা জানতে ইচ্ছে করে.. কেমন আছ সত্যি করে বলতো? যদি ভালোই থাকো, তবে মিথ্যে করে হলেও বলো ভালো নেই! নিশ্চয়ই আগের মতই অনিয়ম করো সবকিছুতে। অর্থের বিনিময়ে অন্ধকার কেনার অভ্যাস এখনো আছে? আমায় যেসব গল্প বলতে তা হয়তো এখন অন্য কেউ শোনে।
এই চিঠি হয়তো কোনদিন পড়বেনা তুমি, আজীবন অবহেলায় পড়ে থাকবে আমার ব্লগের এককোনে। নির্মলেন্দু গুণের মত আমিও বলছিনা ভালোবাসতেই হবে। আমি শুধু চাই যে মুহূর্তে বারান্দায় দাড়িয়ে ভেজা চোখ বুজে তোমায় ভাবি, তুমিও ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে বাইরে যেখানেই থাকো একবার চোখ বন্ধ করো। হাজার লোকের ভীড়ে থমকে দাড়িয়ে একটিবারের জন্য হলেও একা হয়ে আমায় ভেবো.....
-বর্ষামানবী
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:০৬