ব্ল্যাক ডেজার্টে ব্ল্যাক হিল
আঠাশে সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটায় ঢাকা থেকে কুয়েত এয়ারলাইন্সের
এ ৩০০-৬০০/৬০০সি এয়ার বাস কখনোও একত্রিশ হাজার থেকে ছত্রিশ হাজার ফিট উচ্চতায় ভেসে ভেসে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে কায়রোর উদ্দ্যেশ্যে।
কুয়েত এয়ারপোর্টে যাত্রীরা নেমে আসছে সিড়ি দিয়ে
বিজনেস ক্লাসের জানালা দিয়ে চেয়ে আছি আমি নীচের দিকে।ঢাকা থেকে যখন উড়াল দিয়েছিলাম তখন ছিল মেঘের খেলা। আর চার ঘন্টা ট্রানজিট শেষে কুয়েত সিটি থেকে যখন রওনা দিলাম তখন চেয়ে দেখি ঝক ঝকে আকাশ নীচে আদিগন্ত বিস্তৃত মরুভুমি আর মাঝে মাঝে পাহাড়ের সারি।আমি অবশ্য একটু কনফিউজড ছিলাম ওগুলো কি! কিন্ত আমার ভুগোলবিশারদ স্বামী জানালো ওগুলো মরুভুমি আর পাহাড়ই।
ধু ধু সেই উষর মরুপ্রান্তর
সেই মরুর মাঝে দেখলাম চিকন ফিতার মতন একদম সোজা এক কালো রেখা মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে মিশে গেছে দিগন্ত রেখায়, কখনও বা একশ চল্লিশ বা একশ পয়তাল্লিশ ডিগ্রী বাঁক নিয়ে।আমার স্বামী জানালো ওটা রাস্তা! আমি অবাক হয়ে গেলাম এত সোজা কোনো আকাবাকা নেই!
ও বল্লো বাঁকা করার প্রয়োজন তো নেই এখানে।
এত বাহুল্য কথা বল্লাম একারনেই যে এমন একটি চকচকে সোজা মসৃন রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি সেই গন্তব্যে যা কিনা আড়াইশো কিমি তে গিয়ে শেষ হবে।
জীপের জানালা দিয়ে তোলা রাস্তার ছবি।
অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জীপ, একশ চল্লিশের নীচে নামছেই না কাটা। এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত দক্ষ ড্রাইভার। এদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী হাসি খুশী যে বাচ্চা চালকটি তার নাম মুহাম্মাদ হামাদ।
এখানে প্রসংগত একটা কথা বলি তাহলো ওখানে যত লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের নাম হয় আহম্মেদ নয় মুহাম্মদ। শুধু এক টাংগাওয়ালার টাংগা যেটা আমি একটু চালিয়েছিলাম লুক্সরে তার নাম আবু কারিম!
জীপ চলছে সেই ফিতার মতন সোজা রাস্তায়। দুপুর তিনটা বাজে প্রচন্ড গরমে দম আটকে আসছে ।এসি তে ঠান্ডা না হওয়ায় গাড়ীর জানালাটা একটু খুলে দিয়েছি। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। মুহুর্তে মুহুর্তে সবাই পানির বোতলে মুখ দিচ্ছে।ঠান্ডা পানির বোতলটা এমন গরম হয়েছে মনে হচ্ছে এখন চা পাতা দিলে চা বানানো যাবে।
জীপের জানালার ফাক দিয়ে তোলা ছবি
আমাদের জীপে আমরা ছাড়াও দুজন ইজিপশিয়ান আমেরিকান আর দুজন খাঁটি মার্কিন মেয়ে ছিল আঠারো থেকে বিশের কোঠায় বয়স।ওরা চারজন বন্ধু। ঐ চারজনের মধ্যে একটাই ছেলে তার নাম ওমার।সে সামনের সিটে বসে অনর্গল আরবী ভাষায় কথা বলছে আহমাদের সাথে।বাকি তিনটা মেয়ে আমাদের পেছনের সীটে।
মিশরে সাধারন মানুষের মধ্যে ইংরেজী ভাষার চল বেশ কম তবে ট্যুরিজমের সাথে যারা জড়িত তারা মোটামুটি কাজ চালানোর মত ইংরাজী জানে। গাইড কাম ড্রাইভার মাঝে মাঝে আমাদের সাথেও কথা বলছে সেই ঝড়ের বেগে গাড়ী চালানোর ফাকে ফাকে।
কালো মরুভুমি
ডানে বায়ে চেয়ে দেখছি হলুদ মরুভুমি কালচে হয়ে আসছে। ছোটো ছোটো টিলার মতন ।দেখতে অনেকটা আগ্নেয়গিরির মত লাগছে।জানলাম এটাই ব্ল্যাক ডেজার্ট। মাইলের পর মাইল এরকম দৃশ্য।
হটাৎ রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে এক বাঁক নিয়ে মরুভুমির দিয়ে চলতে শুরু করলো জীপগুলো। উচু নীচু খানা খ্ন্দক আর পাথরের টুকরোর উপর দিয়ে যাচ্ছি মনে হচ্ছে কোনো কার র্যালীর আমরা অংশগ্রহনকারী।
রাস্তা ছেড়ে কালো মরুভুমিতে প্রবেশ
কিছুদুর এভাবে চলার পর এক জায়গায় চারটি জীপই থামলো। নেমে দেখলাম মরুভুমির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হলুদ পাথরের টিলার উপর কয়লার চেয়েও অত্যন্ত কঠিন কালো পাথরের ছোটো ছোটো টুকরোয় আবৃত চারিদিক।জানতে পারলাম সেগুলো ব্যাসল্ট আর গ্রানাইট সাথে কয়লার টুকরো ও আছে । কিন্ত পাথরগুলো আলগা হয়ে বিছিয়ে আছে।
কালো যে কত সুন্দর হতে পারে সেটাই দেখছি মনপ্রান ভরে। খুব সুন্দর সেই দৃশ্য সবাই ছবি তুলতে লাগলো। টিলা বেয়ে উঠা নামা সবই চল্লো। বাহারিয়া থেকে ৫০ কিমি দুরত্বে এই অত্যাশ্চর্য কালো মরুভুমির শুরু।
আমাদের চারটি জীপ দাড়িয়ে
জার্মানদের মধ্যে একজন ছিল তরুন ধর্মান্তরিত মুসলমান।সে ওখানে তৈয়াম্মুম করে নামাজ আদায় করলো। এখানে অনেক গুলো ছবি তোলার কারনে আমাদের ক্যামেরার ব্যটারী কমে এসেছিল যার ফলে পরে প্রচন্ড অনুশোচনায় ভুগেছিলাম। যাক বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে সেখানে আবার রওনা দিলাম। বিকাল হয়ে আসছে খরতাপটা কমে আসছে।
সুর্য অস্তাচলে
কালো মরুভুমি শেষ হয়ে এখন এক হলুদ মরুতে প্রবেশ ঘটলো আমাদের। দু জায়গায় চেক পয়েন্ট অতিক্রম করতে হলো। কর্তৃপক্ষকে বাহারিয়া থেকে পারমিশন আনতে হয় এখানে প্রবেশের জন্য ।
কিছুক্ষন পর রাস্তা ছেড়ে অদুরেই যেখানে গাড়ী থামলো তার নাম কৃস্টাল মাউন্টেন।
ক্রিস্টালে পরিনত হওয়া পাহাড়
এখানে পাহাড়ের কিছু অংশ প্রচন্ড সুর্যের তাপে কৃস্টালে পরিনত হয়েছে।বেশ কস্টই হলো বেয়ে উঠতে খাড়া টিলাটায়।
এখনও অবশ্য সুর্য অস্ত যায়নি।একটা জীপের চাকার সমস্যা দেখা দেয়ায় চাকা বদলানো হলো।মিশেলিন কোম্পানির চাকা, যে কোম্পানী ফরমুলা ওয়ান রেসিং স্পন্সর করে ব্রীজস্টোনের সাথে।
আবার রওনা হোলাম এবার আমাদের গন্তব্য পিচ্চি একটা মরুদ্যান তারপর সেই স্বপ্নের তুষার মরুভুমি।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে অনেকেই আমার গত পোস্টে বিভিন্ন তথ্য জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাদের জন্য আমার এবার যথাসাধ্য প্রচেস্টা।আর আমাদের এই মরুভ্রমনে খরচ হয়েছিল দুজনের সাতশ মিশরীয় পাউন্ড ।এক পাউন্ডে বিডি টাকা দশের কিছু বেশী।
চলবে...।
সাদা আর কালো মরুভুমি তৃতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব