somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্লিওপেট্রা শেষ পর্ব

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৩:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শিল্পীর তুলিতে আঁকা টরসাসে ক্লিওপেট্রা
বেগুনী পাল তুলে সোনালী রংয়ের নৌকায়, রুপার বৈঠা বেয়ে ভেনাস তথা মিশরের প্রেমের দেবী আইসিস সাজে সেজে ক্লিওপেট্রা সিডনাস(cydnus) নদী বেয়ে এ্যন্টনীর শিবিরে উপস্হিত হলেন। তার সেই অতুলনীয় রূপরাশি আর ঐশ্বর্যের সাথে তার বর্ণাঢ্য উপস্হিতিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লেন সোনালী চুল আর সমুদ্র নীল চোখের অধিকারী প্রেমের দেবতা ব্যাকাস রূপী রোমের বিখ্যাত সেনাপতি মার্ক এ্যন্টনী। দুজনের চোখে চোখ পড়া মাত্র তারা একে অপরের প্রেমে পরে গেলেন, যাকে বলা যায় প্রথম দর্শনেই প্রেম।

সেখানে এ্যন্টনী ক্লিওপেট্রাকে ডিনারে আমন্ত্রন জানালে ক্লিওপেট্রা ক্লান্তির অজুহাতে তা প্রত্যাখান করে উল্টো তাকেই আমন্ত্রন জানান তার সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। সেই বিলাশ বহুল ডিনার পার্টিতে ক্লিওপেট্রা তার স্বর্নের তৈরী খাবার প্লেট বাসন ও পান পাত্র এবং দামী ও সুস্বাদু খাবার ছাড়াও দামী মদ পরিবেশন করে এ্যন্টনীকে চমকে দিতে সক্ষম হয়। যা ছিল তার পরিকল্পনার একটি অংশ।

নৈশভোজে এ্যন্টনী ও ক্লিওপেট্রা

৪১ খৃঃ পুঃ থেকে ৪০ খৃঃ পুঃ পর্যন্ত এক বৎসর ক্লিওপেট্রা আর এ্যন্টনী সেখানে এক সাথে বসবাস করেন। তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে এক বছর পর ক্লিওপেট্রা জমজ সন্তানের মা হন।
৪০ খৃঃ পুঃ এ্যন্টনী এ্যথেন্স ফিরে গেলে তার স্ত্রী ফুলভিয়া (Fulvia) মারা যান। এরপর তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী অক্টেভিয়াসের বোন অক্টেভিয়াকে বিয়ে করতে সম্মত হন। সেখানে তার একটি মেয়ে জন্মলাভ করে। ৩৭ খৃঃ পুঃ এ্যন্টনী ইজিপ্টে ক্লিওপেট্রার কাছে ফিরে আসেন এবং তার পরের বছর ক্লিওপেট্রাকে মিশরীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে করেন। সে বছরই তাদের আরেকটি ছেলে জন্ম গ্রহন করে, তার নাম রাখা হয় টলেমী ফিলাডেলফাস।

ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়া ফিরে গেলে এ্যন্টনী টলেমী সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো উদ্ধার করতে সফল হন। এর মধ্যে ছিল সাইপ্রাস এবং লেবাননের কিছু অংশ। অভিযান শেষে এ্যন্টনী ক্লিওপেট্রার কাছে ফিরে এসে সীজারিয়ানকে জুলিয়াস সীজারের ছেলে এবং তাকে ক্লিওপেট্রার সাথে যৌথ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তিনি তার বিজিত রাজ্যগুলো তাদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে রোম সাম্রাজ্যের তরফ থেকে উপঢৌকন হিসেবে ভাগ করে দেন।

সন্তানদের এ্যন্টনীর উপহার

এ্যন্টনী আলেকজান্দ্রিয়াতেই বসবাস শুরু করলে রোমে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্লিওপেট্রার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা, তাকে বিয়ে করে সন্তানের পিতা হওয়া এবং জয়লাভ করা দেশ গুলো মিশরকে উপহার দেয়া ব্যাপারগুলো এ্যন্টনীর আনুগত্য সম্পর্কে অক্টেভিয়ানের মধ্যে প্রচন্ড সন্দেহের সৃষ্টি করে।
তারই ফলশ্রুতিতে ৩১ খৃঃ পুঃ আইওনিয়ান সমুদ্রের উপকুলে এক্টিয়ামে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্হান নেয়।স্হলযুদ্ধে পারদর্শী এ্যন্টনী ক্লিওপেট্রার অনুরোধে নৌযুদ্ধে অবতীর্ন হয়। তাদের দুজনের ৫০০ জাহাজ এবং ৭০ হাজার সৈন্য অক্টেভিয়ানের ৪০০ জাহাজ আর ৮০ হাজার সৈন্যের মুখোমুখি হয়। ভালো অবস্হানে থেকেও যুদ্ধের এক পর্যায়ে এ্যন্টনী কিছুটা বিপর্যয়ের সন্মুখীন হলে পেছনে থাকা ক্লিওপেট্রা তার সৈন্যদের নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। এ্যন্টনীও এসময় তার সৈন্যদের শত্রুর মুখে ফেলে ক্লিওপেট্রাকে অনুসরন করতে থাকে। ফলে অক্টেভিয়ান খুব সহজেই যুদ্ধে জয়লাভ করে। এরপর দু একটি ছোটোখাটো স্হল যুদ্ধে জয় লাভ করলে পুরোপুরি ভাবেই আলেকজান্দ্রিয়ার পতন ঘটে।

বিখ্যাত এ্যক্টিয়ামের যুদ্ধ
বহু যুদ্ধের বিজয়ী বিখ্যাত বীর রোমান সেনাপতি মার্ক এ্যন্টনী ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত এবং জীবনে প্রথম পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে আসেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। ফিরে এসেই সে খবর পায় তার ভুবনবিখ্যাত রূপের রানী প্রিয়তমা স্ত্রী ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছে। এই মর্মান্তিক খবরে নিজেকে আর স্হির রাখতে না পেরে এ্যন্টনী নিজ তরবারী দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে । কিন্ত মৃত্যুর আগে সে জানতে পারে ক্লিওপেট্রা বেচে আছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে আহত অবস্থাতেই সে প্রেয়সী স্ত্রীর সাথে শেষ দেখা করার ইচ্ছা পোষন করলে তাকে ক্লিওপেট্রার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

মুমুর্ষ এ্যন্টনী তাকে অক্টেভিয়ানের সাথে একটি সমঝোতায় আসার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন। এর কিছুক্ষন পরেই সে ক্লিওপেট্রার হাতের উপরেই তার শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।এরই সাথে শেষ হয়ে গেলো এক ঐতিহাসিক প্রেমের করুন অধ্যায়।

এ্যান্টনীর অনুরোধে ক্লিওপেট্রা ইজিপ্টের সিংহাসনের উপর তার সন্তানদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অক্টেভিয়ানের শিবিরে কয়েকবার দুত পাঠান। কিন্ত অক্টেভিয়ান তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। অক্টেভিয়ানের হাতে লান্ছিত ও অপমানিত হওয়ার আশঙ্কায় শেষপর্যন্ত ক্লিওপেট্রাও স্বেচ্ছা মৃত্যুকে বেছে নিলেন ।

তিনি তার নিজের জন্য নির্মিত সমাধিসৌধে সমস্ত ধন সম্পদ এবং বিশ্বস্ত দুই সহচরীকে নিয়ে স্বর্নমন্ডিত পোষাক আর অলংকারে অবর্ননীয় ও অপরূপ সাজে সেজে শেষ শয্যায় শায়িত হন। বলা হয়ে থাকে নীলনদের এক ধরনের প্রচন্ড বিষাক্ত ছোটো ছোটো ভাইপার জাতীয় সাপের কামড়ে তার ও সহচরীদের মৃত্যু হয়েছিল যা সে নিজেই ডুমুরের ঝুড়িতে করে লুকিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে । আবার কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন অত ছোটো সাপের কামড়ে তিনটি পুর্ন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হতে পারেনা, কেউটে সাপের বিষ ছিলই তাদের মৃত্যুর কারণ।


সাপের কামড়ে ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা

ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর তার পলাতক বড় ছেলে সিজারিয়ানকে ধরে এনে অক্টেভিয়ানের নির্দেশে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ্যন্টনীর ঔরসজাত বাকী তিন সন্তানকে অপমানজনকভাবে রোমের রাস্তায় সবার চোখের সামনে দিয়ে সোনার শিকল পায়ে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এ্যন্টনীর স্ত্রী পালক হিসেবে তাদেরকে গ্রহন করেন।
এরপর ইতিহাসে সেই ছেলেদের আর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। শুধু মেয়েটি আফ্রিকার কোনো এক অখ্যাত রাজাকে বিয়ে করে এটুকু জানা যায়।

অর্থাৎ ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সাথে সাথেই মিশরে টলেমি বংশের তথা বিখ্যাত ফারাওদের দীর্ঘ গৌরবময় শাসনের অবসান ঘটে। ফলে পৃথিবীতে সভ্যতার অন্যতম সুচনাকারী ও পরাক্রমশালী স্বাধীন দেশ ইজিপ্ট রোম সাম্রাজ্যের একটি সামান্য প্রদেশে পরিনত হয় মাত্র।
পরবর্তী যুগে কিছু কিছু ঐতিহাসিক রোমান দৃষ্টভঙ্গীতে ক্লিওপেট্রাকে দুঃশ্চরিত্রা, স্বার্থপর,যাদুবিদ্যা তথা ডাকিনী বিদ্যায় পারদর্শিনী, কুটকৌশলী, ধন-সম্পদ ও ক্ষমতালোভী ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত করতে কার্পন্য করেনি।বিখ্যাত রোমান কবি হোরাস তাকে পাগল এবং লুকান তাকে ইজিপ্টের লজ্জা বলে অভিহিত করেছে।
রোমানদের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হওয়ার পর, বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্লুটার্ক তাকে এ্যন্টনীর একনিষ্ঠ প্রেমিক এবং ট্র্যাজিক নায়িকা হিসেবে উপস্হাপন করেছেন।
ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য নিয়েও বহু মতবাদ প্রচলিত আছে।বলা হয়ে থাকে যত সুন্দরী তাকে বলা হয়ে থাকে তত সে সুন্দরী সে ছিলনা। তবে প্লুটার্কের ভাষায় 'যে কোনো স্হানে ক্লিওপেট্রার উপস্হিতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। সে যা করতো সেটা ছিল যাদুস্পর্শী। আর তার কথা বলার ভঙ্গীমা তার কাজল বরণ চোখের চেয়েও আকর্ষনীয় ছিল'।
ক্লিওপেট্রা ছিলেন বহুমাত্রিক চরিত্রের অধিকারী, পৃথিবীতে যার আবির্ভাব একবারই মাত্র হয়েছিল।

প্যাপিরাসে আকা প্রাচীন শিল্পকর্ম।
শেষ।

তথ্য ও ছবি নেট।
২য় পর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/June/29305685
১ম পর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/June/29302785
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:১৪
৯৯টি মন্তব্য ৯৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×