somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঝাউতলা

২৭ শে জুন, ২০১২ সকাল ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তৃনাদের অপরূপ সুন্দর বাড়ীটা যে এলাকায় তার নাম ঝাউতলা । কি সুন্দর নাম মনে মনে ভাবে তৃনা। তাদের এলাকায় প্রচুর গাছপালা কিন্ত সে এখনো অনেক ছোট, সব গাছ চিনে উঠতে পারে না । ওর মনে হয় এগুলোর মধ্যেই কিছু কিছু নিশ্চয় ঝাউগাছ । সে প্রায়ই বিভিন্ন গাছ দেখিয়ে আব্বুকে জিজ্ঞেস করে,
'আব্বু এটা কি ঝাউগাছ'?
আব্বু একদিন জানালো 'শোনো মামনি এই তল্লাটে এখন কোনো ঝাউগাছ নেই। কোনো এক কালে হয়তোবা ছিল'।
তৃনা ভাবে ঝাউগাছ না থাকুক তার বদলে পাশে বিশাল এক দিঘী আর সামনে অবারিত মাঠ নিয়ে গলার হারের মত আকৃতির ওদের বিরাট বাড়ীটি দেখার মত। মাঝখানের বিরাট বড় হল রুমটার দুধার থেকে বাকি রুমগুলো আস্তে আস্তে ক্রমাগত ছোট হতে হতে গোল হয়ে পেছনে এক রান্নাঘরের দুপাশে গিয়ে মিলেছে।দুদিকেই টানা ঘোরানো বারান্দা । ভেতর দিকে ঘাসে ঢাকা এক বড় উঠান।

এত বড় বাড়ির অনেকগুলো রুম ই খালি পড়ে থাকতো। দিনের বেলাও সেইদিকে গেলে ভয় ভয় লাগতো তৃনাদের। ছাদে যাওয়ার লোহার পেঁচানো সিড়িটা ও ছিল অপরুপ সুন্দর জালির কারুকাজ করা । বাড়ির চারিদিকে ঘিরে ফুলের বাগান, সামনে বিশাল সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ।হল ঘরের সামনের বারান্দা থেকে চওড়া লাল সিড়ি ধাপে ধাপে নেমে মাঠের মধ্যে মিশে গেছে।

তবে মাঠটা সারাদিনই ঢাকা থাকে মাখন ধোপার মেলে দেয়া সারি সারি কাপড় দিয়ে। সারাদিন দিঘীর মধ্যে হাটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে কাঠের খাঁজকাটা পাটাতনে আছড়ে আছড়ে কাপড় ধোয় বুড়ো মাখন ধোপা। তারপর মাঠে এনে বড় বড় মাটির চাড়িতে মাড় আর নীল দিয়ে লম্বা লম্বা করে টানানো দড়ির মাধ্যে শুকোতে দেয়। কালো দোমড়ানো শরীর সারাদিন পানি ঘেটে ঘেটে হাত পায়ে হাজা ধরে গেছে মাখনের।

তৃনা ভীষন কৌতুহল নিয়ে বারান্দায় ওর বাবার ইজিচেয়ারের হাতলটায় উপর বসে প্রায়ই মাখন ধোপার কাজ দেখে। মাঝে মাঝে কাছে গিয়েও দাড়ায়। টুকটাক কথা বলে দুজন।
'কেয়া বাত দিদি, ক্যায়সি হো ', মাখন জানতে চায়।
আমি ভালো আছি মাখন দাদা, তুমি এটা কি দিচ্ছ এই শাড়িটায়?
'কৌনসা'?
'এই যে মাটির চাড়িতে এতক্ষন কাচের মত জিনিসটা ঘষলে, চিকচিক করছে', তৃণা জানতে চায়।
ওহ্‌ দিদি ইসকো হামরা আব বলি , মাজী কি শাড়ি মে তুমনে কভি দেখা নেহি'!বিস্মিত মাখনের প্রশ্ন।
এরপর মাখন প্রসঙ্গ বদলে ফেলে;
'সক্কাল বেলার নাসতা পানি শেষ হইলো দিদি' ?
'কখ..ন, ছোট্ট একটু টান দিয়ে উত্তর দেয় তৃণা।
'মাজী নে বহুতই আচ্ছা খানা পাকায় দিদি, গেলো মাসে হামার যখন বুখার হইছিলো, দস দিন চারপাইয়ে লেটে ছিলাম তখন একদিন মাজী হামার জন্য খানা পাঠাইছিল'।
বলতে বলতে মাখনের কোটোরাগত ক্ষুধার্ত চোখ জোড়া সেই আবের চেয়েও বেশি চক্ চক্‌ করে উঠে। ওদের মতন করে কথা বলেনা কেন তৃনা একদিন জিজ্ঞেস করায় মাখন বলেছে, বহু বছর আগে সেই দুর ভারতের বিহার থেকে কাজের সন্ধানে তাদের বাপ দাদারা নাকি এদেশে এসেছিল। অনেক দিন ধরে এখানে থাকতে থাকতে তাদের আচার -সংস্কৃতির সাথে ভাষাও পালটে গেছে। হবে হয়তো, তৃনা ভাবে।

সারাদিন ধরে মানুষের কত রং বেরংয়ের কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি করছে মাখন , কিন্ত তার পরনে হাটু পর্যন্ত তোলা খাটো এক মলিন ধুতি।
তৃণাদের বাসা থেকে দু'পা দুরেই বড় রাস্তার ধারে মাখনের লন্ড্রী আর পেছনেই থাকার জন্য ছোট্ট এক খুপড়ি ঘর ।ছয় সাতটা ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানেই তার বসবাস। মাঝে মাঝে তৃণা ওর লন্ড্রীতে যায়, ছেলে মেয়েগুলোর সাথে গল্প করে ।যদিও ওদের অনেক কথা ও বুঝতে পারে না, কিন্ত তাতে কখনো গল্প করায় ছন্দপতন ঘটে না।কখনোবা সামনের লন্ড্রী ঘরটায় ঢুকলেই মাখন বাঁশের বেড়ার সাথে ঠেশ দেয়া তিন পা ওয়ালা ভাংগা চেয়ারটা দেখিয়ে বলে,
বৈঠিয়ে দিদি, বৈঠিয়ে'।
তৃনা সেখানে বসে মাখনের সাথে গল্প জুড়ে দেয়, সেই গল্পের কোনো আগামাথা থাকে না।

তৃনা দেখে এত সব দামী দামী কাপড় চোপড়ের মধ্যে বসবাস করেও ওদের সবার পড়নে মলিন বেশভুষা।তবে কোনো এক দিন সে দেখেছিল ওরা ঝকমকে কাপড় পড়ে তৃণাদের মাঠ পার হয়ে কোথায় জানি যাচ্ছে। আম্মু বল্লো ওসব নাকি মানুষের ধুতে দেয়া কাপড়-চোপড়।শুনে তৃণা অবাক! ভারী মজার তো। ওদের মত সারাবছরে ঈদে পাওয়া একটা নতুন ফ্রকের জন্য চেয়ে থাকা নয়! সবসময় নিত্য নতুন পোশাক!

ইশ ও কেন মাখনের মেয়ে জোৎস্না হয়ে জন্মালোনা ! তাহলে তার ও স্কুলে যেতে হতো না। সারাদিন ওদের মত দিঘীর পানিতে পা চুবিয়ে কাপড় ধোয়া, কি যে মজা ঐ পাটে আছড়ে আছড়ে কাপড় ধুতে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে সে তার নিজের দু একটা ফ্রক ধুতে বসে। কিন্ত আম্মু দেখলে ভীষন রাগ করে, ওটা নাকি ভদ্র লোকের মেয়ের সাজে না। কেন যে ভদ্রলোকের মেয়ে হোলাম তৃণা মনে মনে ভাবে।

'তৃণা, তৃণা কই তুমি' ?
তৃণা চোখ তুলে দেখে আম্মু খোলা বারান্দায় দাড়িয়ে ওকে ডাকছে।
মাখন তার দোমড়ানো মোচড়ানো শরীরটা নিয়ে দাড়িয়ে চোখটাকে হাতের তালু দিয়ে রোদ আড়াল করে বলে উঠে,
আদাব মাজী, আপকি হালত ক্যয়সি হ্যায়?
ভালো আছি মাখন, তুমি কেমন আছো' ? গত কয়েকদিন তৃণার মা একটু অসুস্থ ছিল মাখন সেটা জানতো।
'মেরা খবর মাত পুছিয়েঁ মাজী,আপলোগঁ কি দুয়াও মে জিন্দা হু ম্যায় , তারপর তৃনার দিকে ফোকলা দাতে একটু হাসির চেষ্টা করে বল্লো, '
ও দিদি, তুমকো মাজী নে বুলায়া, জলদি লৌটকে ঘর যাও'।

ঘরে ঢুকতেই মা তেড়ে আসে।
'কি কর সারাদিন রোদের ভেতর মাঠের মধ্যে শুনি! আর ঐ বুড়োটার সাথে তোমার কি এত গল্প '?

তৃণা জানে মা বুঝবে না এসব।কিন্ত আব্বু বুঝে। ছুটির দিনে আব্বু মাখন ধোপাকে সামনে দিয়ে হেটে যেতে দেখলেই ডাক দিয়ে নানা রকম কথা জিজ্ঞেস করবে।তৃণা ইজিচেয়ারের হাতলে বসে এসব কথা শোনে।

'আরে মাখন, কেয়া খবর, তুমহারা কোই পাতা নেহী, ক্যায়সে হো তুম' ?

'ম্যায় আচ্ছা হু বড়ে সাহাব, আপ কি দুয়াও মে সব কুছ আচ্ছা হ্যায়, কোই বুরা নেহি, মাগার আপকা তাবিয়ত ক্যায়সা হ্যায় বাবুজী?'।

'ম্যায় আভি ভি ঠিক হু মাখন, আভি তক্ সবকুছ ঠিক হ্যায়'।
তৃণার আব্বু জবাব দেয়।

'খুদা আপকো সহি সালামত রাখখে'।
বলতে বলতে মাখন কুজো হয়ে এগিয়ে যায় মাঠের মাঝখানে। দুটো দড়ির ফাঁক থেকে শুকনো কড়কড়ে কাপড় খুলে খুলে স্তুপ করে রাখে মাঠের এক কোনায়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।একটু পরেই সেগুলো কয়লা ভরা বড় লোহার ইস্ত্রি দিয়ে একটা একটা করে টেবিলে রেখে ইস্ত্রি করবে মাখন।তারপর ভাঙ্গা একটা কাচের শোকেসে থাকে থাকে সাজিয়ে রাখবে।


তৃণা চেয়ে দেখে ওর বাবার চোখে হতাশার কালোছায়া ,সন্ধ্যার অন্ধকারে মাথাটা ঝুকে পড়ে বুকের উপর। তৃণা শুনেছিল আব্বু কাকে যেন বলছে দুদিন পর আসবে আম্মুর টিউমারের বায়াপসি রিপোর্ট।এই বিষয়টি যে ওদের জন্য অনেক ভয়ংকর আব্বুর চেহারা দেখেই সেটা বুঝতে পারে তৃনা।

কিন্ত কি সে ভয়ংকর তা বুঝতে পারার মত বয়স হয়নি ওর। সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা চওড়া বারান্দা ঘেরা সেই অপরূপ বাড়ী, লোহার ঘুরানো সিড়ি বেয়ে উঠা ছাদ, রকমারী ফুল ফলে ভরা বাগান, সাথেই বিশাল দিঘী, মাঠ ঘাট, গাছপালা, মাখন ধোপা সবকিছু ছেড়ে আকাশ না দেখা তিন রুমের এক নিরেট ইট কাঠের দেয়াল ঘেরা ছোট্ট বাসায় এসে ওঠা ।
জায়গা হবে না জেনে কত ফার্নিচার মানুষকে বিলিয়ে দিয়েছিল আম্মু। মাখনকে দিয়েছিল প্রায় নতুন কাচের এক শোকেস।কিযে খুশি হয়েছিল মাখন।কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়ে পড়েছিল।এখন নিশ্চয় মাখন সেটার মধ্যে তার ইস্ত্রী করা কাপড়গুলো সাজিয়ে রাখে থরে থরে।

মায়ের দীর্ঘ অসুস্থতা আর চারিদিক দম বন্ধ করা এই পরিবেশে তৃনা কেমন আছে? মনে পড়ে মাখন ধোপার আব্বুকে করা সেই আশীর্বাদ, 'খোদা আপকো সহি সালামত রাখখে হুজুর'।
'না মাখন আমরা কেউ সহি সালামতে নেই, আমরা এখন অনেক প্রিয় একজন মানুষের মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, মনে মনে ভাবে তৃনা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:০৪
৮৩টি মন্তব্য ৮৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×