এলাকাটি মধ্যবিত্তদের পাড়া বলে চিন্হিত হলেও বিশাল চারতলা বাড়ীটি অত্যাধুনিক ডিজাইনেই তৈরী।তারই এক ঘরে বিধবা আমিনা বেগম শুয়ে আছেন একাকী। সাদা সফেদ শাড়ী পড়া উনাকে দেখলে মনে হয় যেন বিছানার সাথে মিশে আছেন। কারো সাহায্য ছাড়া ইদানীং নিজ হাতে কোন কিছুই করতে পারেন না। এক গ্লাস পানি ঢেলে দেয়ার জন্য হলেও কাউকে ডাকতে হয় ।অবশ্য পায়ের কাছেই বসে আছে সার্বক্ষনিক দেখাশোনার জন্য বেতনভুক এক কিশোরী পরিচারিকা।
দামী পর্দা ঝোলানো ঘরে নামকরা ফার্নিচারের দোকানের ল্যাকার পলিশ করা খাট, আলমিরা, রংগীন এল সি ডি টিভি। আমিনা বেগমের মনে পরে অনেক অনেক বছর আগে সাদাকালো পুরোনো ছোট্ট একটি টিভি কিনে এনেছিল বড় ছেলে। প্রতি সপ্তাহে একটি নাটক আর একটি বাংলা সিনেমা দেখার জন্য কি আকুলতাই না ছিল সে সময়। সেটা দেখাতেও স্বামীর কত বাধা নিষেধ।কত জেদ, কত রাগ। ছেলেমেয়েদের অভিমান আর অনুরোধে কত লুকোচুরি, কত ছলনা আওয়াজ বন্ধ করে দেখা সেই টিভি।আজ তার ঘরের টিভি বন্ধই থাকে বেশীরভাগ সময়। মাঝে মাঝে ছেড়ে দেয় শুধু কাজের মেয়েটার জন্য।
তালের পাখায় স্বামীকে আর ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে বাতাস করতে করতে হাত ভেঙ্গে আসতো।সে সময় ইলেকট্রিক ফ্যানের কথা ভাবাটাও ছিল দুঃস্বপ্ন। আজ মাথার কাছে হাল্কা করে ছাড়া এসি। কোনদিকে কোন আরাম আয়েশের অভাব রাখেনি তার ছেলেরা। কিন্ত একদা বিশাল সংসার এক হাতে সামলানো আমেনা বেগম আজ বয়স আর রোগের কাছে পরাজিত।শুধু শরীরই নয় মানসিক দিক দিয়েও ভেঙ্গে পরেছেন তিনি।
ইদানীং অনেক কথাই ভুলে যান। এক সময় তার স্মৃতিশক্তি ছিল আমাদের কাছে বিস্ময়কর।তার জীবনের কোন ঘটনা সে যদি বহুবার ওঁ পুনঃ উল্লেখ করতো, আমরা অপেক্ষা করতাম এই ভেবে যে এবার নিশ্চয় কিছুটা হলেও অনেকবার বলা কাহিনীটার সামান্য হলেও কিছু পরিবর্তন হবে। না কোনসময়ই সে ঘটনা থেকে একটা দাড়ি কমার ও হেরফের হতো না!
অনেক ছোটবেলায় এক গুরু গম্ভীর, রসকষহীন লোকের সাথে তার বিয়ে বলবো কি না জানি না! নাকি তার ক্রীতাদাসী হয়েছিল । কি ভাবে তার সাথে দীর্ঘ ৫৮ বছর ঘর করেছিল তা ছিল আমাদের কাছে এক বিষ্ময়। বিয়ের পরের বছর থেকেই একে একে ১১ টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন আমেনা বেগম। আবার দু চারটি মারাও গিয়েছিল আতুড় ঘরে। না হলে হয়তো সংখ্যা আরো বাড়তো।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেই বিশাল অভাবের সংসারের ঘানি টানা ছাড়া তার জীবনে চিত্ত বিনোদনের কি বন্দোবস্থ ছিল আমার জানা নেই।সরকারী চাকুরে স্বামী সারাদিন অফিস থেকে সন্ধ্যা বেলায় ফিরলে মনে হয় বাসায় একটা অঘোষিত কার্ফিউ জারী হতো।আমেনা বেগম থেকে শুরু করে কোলের বাচ্চাটিও যেন বুঝতে পারতো এখন কোন টু শব্দটিও করা যাবে না বা করা সম্ভব নয়।
কি ভাবে তার সেবা যত্ন করলে সে খুশী হবে সেই চিন্তায় সারাদিনের হাড় ভাঙ্গা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমেনা বেগম ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়তেন।অপরাধী অপরাধী চেহারা নিয়ে বদনায় করে এগিয়ে দিত তার হাত মুখ ধোয়ার পানি, মুখ মোছার গামছা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতো তার পেছনে, এরপরই চা আর নাস্তার প্লেট নিয়ে দৌড়ে আসতো একটু দুরে থাকা রান্নাঘরের মিটসেফ থেকে। তাতে বেশীরভাগ সময়ই থাকতো দুটো আটার রুটি, ভাজি আর এক কাপ গরম চা।
এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে টানাটানির সংসারে সম্বল ছিল এক ঠিকে ঝি।গুনাগাথা তিন কাজ করে চলে যেত বুয়া। তার ঘাড়ে ছিল পুরো সংসারের কাজ । উঠোনের একমাত্র পানির কল থেকে পানি এনে কাজ সব কাজ নিজ হাতে করতে হতো ।
সকালে দেখতাম লাকড়ীর চুলো ধরিয়ে এক গাদা আটা গুলিয়ে রুটি বানিয়েই যাচ্ছে আমেনা বেগম। আরেক কড়াই ভরা আলু ভাজি। তাই টানা টানি কামড়া -কামড়ি করে খাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। কেউ পেল কেউ হয়তো পেলোই না। কেউ মাদুরে বসেছে কেউ পিড়ি পেতে বসে। কেউ বা এক কাপ চায়ের জন্য দাড়ানো ।
সন্ধ্যায় আমেনা বেগমের স্বামী সাইকেল চালিয়ে অনেক দুরের সেই অফিস থেকে ফিরে আসতো। হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা নামে সেই আটার রুটি আর ভাজি খেয়ে কিছুক্ষন কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিত পুরোনো ঘুনে ধরা খাটটায়। এর পরই উঠে পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসে থাকা সব ছেলেমেয়েদের ডেকে নীচে পাটি পেতে বসতো পড়াতে। এটা ছিল তার প্রতিদিন সকাল বিকালের রুটিন। এর কোন ব্যত্যয় হয়নি কোনদিন।
মাঝখানে একবার আমেনা বেগমের ডাক পড়তো সবার জন্য চা আর মুড়ি কোন দিন বা টোষ্ট বিস্কিট দেবার জন্য। তার বাসার বিলাস ব্যাসনের কথা যদি কেউ চিন্তা করে সেটাও হবে এক বিস্ময়কর ঘটনা। আলাদা খাবার ঘর, বসার ঘর কি জিনিস তা তারা শুধু অন্য বাসায়ই দেখেছে। শুধু একটাই রক্ষা যে এই পাচ কাঁঠা জমি তাদের নিজেদের। নাহলে ঢাকায় ভাড়া থাকা ছিল তাদের জন্য স্বপ্নের অগোচর।
আমেনা বেগমের বাবা মা, ভাই, বোনরা যথেষ্ট স্বচ্ছল। মাঝে মাঝে স্কুটার করে এতগুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে বাবার বাড়ী এক বেলা ঘুরে আসাটাই ছিল তার জন্য বিশাল এক আনন্দের ব্যাপার। যার স্মৃতির রেশ থাকতো অনেকদিন ধরে। বড় ভাবী কি বল্লো, বাবা কি বাজার করে আনলো, মা কি রান্না করলো, হলুদ দিতে গিয়ে মা ভুলে আবার মরিচ দিয়ে ফেল্লো। কি যে মজা হয়েছিল, কত হাসাহাসি হয়েছিল। কত সব খুটিনাটি ঘটনার স্মৃতি।
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যায়। ছেলে মেয়েরা আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠে। কিন্ত সংসারের ঘানি থেকে মুক্তি পায় না আমেনা বেগম। ওনার স্বামী এখন অবসর গ্রহন করেছেন। বাসায়ই থাকেন। বাজারটুকু করা ছাড়া হয়তো টিভি দেখছেন গাছের গোড়া খুচিয়ে পানি দিচ্ছেন। আগে অফিস থাকায় আমেনা বেগম একটু হয়তো নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পেত। এখন সেটুকুও সুদুর পরাহত। মাঝখান থেকে বেড়েছে তার কাজের পরিধি।
অসম্ভব বদমেজাজী স্বামী তার নুন থেকে চুন খসলে বাড়ী মাথায় করে নিত। সামান্য কথাতেই শুনতে হয়েছে বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ।আমেনা বেগম কতবার ভেবেছে চলে যাবে বাবার বাড়ী। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছে পেয়ারা গাছের নীচে কেচি বেড়ার গেটটার দিকে।
গেটটা ঠেলতে যাবে খোলার জন্য তখুনি মনে হয়েছে এতগুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে কার বাসায় উঠবে! যতই বড়লোক হোক তারা কি এত জন মানুষকে সারা জীবনের জন্য আশ্রয় দেবে ! আবার ওদের এখানে ফেলে যাওয়া কি সম্ভব ! মায়ের প্রান কেঁদে উঠে তীব্র বেদনায়। মানুষ কি বলবে! সমাজ কি বলবে! স্বামীর ভাত খেতে পারলোনা ! কেমন মেয়েলোক !
আবার ধীর পায়ে মাথানীচু করে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফিরে আসেন আমেনা বেগম। এগিয়ে গিয়ে চালের টিন থেকে পট দিয়ে চাল মেপে নিয়ে ধুতে বসে।কলের পানি আর চোখের পানি একাকার হয়ে কখন যে টপ টপ করে ঝরে পরতে থাকে হাড়ির ভেতর কারোই নজরে পরে না তা।
আস্তে আস্তে দিন কেটে বছর যায়, ছেলে মেয়েরা সবাই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। টিনের বাড়িটা ভেঙ্গে এই চারতালা বাড়িতে সবার আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট।সবার সবকিছুই হয়েছে, সবাই যার যার সংসারে সুখী । কিন্ত আমেনা বেগমের জীবন সেই আগের মতই গৃহবন্দী এক গৃহিনী। গেলেই দেখা যেত হলুদের ছোপ লাগানো শাড়ী, পান খাওয়া ঠোটে মাথা নীচু করে বাজার গুছাচ্ছেন।কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট নয় স্বামী।
'এত লবন কেন ? এত তেল কেন ? এত ঝোল কেন ? এত শুকনা কেন! আজ কি তরকারীতে লবন দিতে ভুলে গেছ নাকি ? এত ঝাল কেন ', বেগুন আনছিলাম না ! মাছের মধ্যে একটু বেগুন দিলে কি হতো '? মাছের মধ্যে তরকারী কেন ! মাছে কি কেউ তরকারী খায়! একটুও মজা হয় নাই'।
তার সেই অযুত পরিমান অভিযোগের কোন শেষ নেই। কেউ ওনার কোন কাজ করতে চায় না এই ভয়ে। ফলে রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে তার মুক্তি মেলে না।
ছেলেমেয়েরা কত দেশ বিদেশ ঘুরে কত জায়গায় যায়, তার আর কোথাও যাওয়া হয়না। বিয়ের পর থেকে সারাটি জীবন নিজের পছন্দে একটা শাড়ীতো দুরের কথা সামান্য প্রয়োজনীয় জিনিসও কিনেনি সে।বলা যায় সেই সুযোগ পায়নি। স্বামী যা এনে দিয়েছে তাই পরছে, তাতেই খুশী থাকতে হয়েছে।তা পছন্দ হোক আর না হোক।
মনে পড়লো আমার এক আত্মীয়ার কথা যার দামী দামী সব কাতান বেনারশী শাড়ীর সম্ভার দেখলে আমরা থ হয়ে যেতাম।উনার স্বামী মারা যাবার পর উনি প্রায় কলকাতা যেত আর সাধারণ কতগুলো সুতি শাড়ী কিনে এনে আমাদের ডেকে দেখাতো খুব খুশী খুশী মুখে। একদিন জানতে চাইলে বলেছিল, 'আসল কথা কি জানো, সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল । এতটি বছর আমিতো কখনো নিজে কিছু কিনতে পারিনি। সব তোমার মামাই কিনে আনতো।আমাকে কখোনো সাথে নিতোনা।এখন আমি নিজে নিজে যাই কিনি, সস্তা দামের হলেও আমার অনেক ভালোলাগে'।
অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তার সরল উত্তরে।
যাক বলছিলাম সেই আমেনা বেগমের কথা যার বাড়ী ছেড়ে কোথাও যাবার উপায় নেই। একবার তার মেঝ ছেলে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে বাবাকে বুঝিয়ে নিজের ছেলে মেয়ে আর বৌ এর সাথে মাকে নিয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার। সমুদ্রের সেই অপার্থিব সৌন্দর্য যা আমরা অহরহ দেখেও মুগ্ধ হয়ে যাই, তা দেখে উনি বিস্ময়াহত হয়ে পড়েন। এত সুন্দর ! এত সুন্দর যায়গায়ও দুনিয়াযতে আছে! দেয়াল ঘেরা টিনের তিন রুম নিয়েই যার সমগ্র পৃথিবী , চোখের সামনে সমুদ্র তার বিশাল সৌন্দর্য্য মেলে ধরলে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পরেন ।
তিন দিন ছিলেন সেখানে ছেলে, বৌ, নাতি নাতনী নিয়ে। যা ছিল তার সত্তর বছরের জীবনের শ্রেষ্ঠ তিনটি দিন। ফিরে এসে সবার সাথে কতদিন পর্যন্ত সমুদ্র নিয়ে তার কত বাখানি, কত বর্ননা, কি তার সৌন্দর্য্য, কি বিশাল মহিমাময় সেই সমুদ্র, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয় এবং সত্যি উনি ভাষা খুজেও পাচ্ছিলেন না ।
এক দিন সিড়ি বেয়ে উঠছি কানে এলো আমেনা বেগমের গলার আওয়াজ, আরেকটু উঠতেই দেখি মেঝ ছেলের নাতি যার সাথে সমুদ্র দেখে এসেছিল তাকে বুকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলছেন ঃ
'চল দাদু আরেকবার সমুদ্দুরে যাই'
রিপোস্ট । যারা আমার এই গল্পটি পড়েন নি তাদের জন্য ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৬