চোর একটি ভয়ংকর আতংকজনক নাম আবার সেই সাথে রোমাঞ্চকরও বটে। তাদের বুদ্ধিমত্তা, কীর্তিকলাপ, সাহসিকতা নিয়ে শুধু আমাদের দেশে বলি কেন সারা পৃথিবী জুড়েই অনেক কাহিনী, অনেক গল্প প্রচলিত আছে। চোরদের এই চুরি শুধু টাকা পয়সা গয়নাগাটিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাড়ি চুরি, পুকুর চুরি, মাটি চুরি, ইমেজ চুরি, মায় লেখা চুরি পর্যন্ত এই রকম নানা ধরনের চুরি নিয়ে চোরকূল আমাদের বাংলা সাহিত্যেও একটা বিশাল ভুমিকা নিয়ে বসে আছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের রম্য গল্পে চোরের কাহিনী শুনে হেসে গড়িয়ে পরতেই হবে বিশেষ করে নতুন ছেলে নটবর গল্পে, সেখানে লেখিকা দেখিয়েছেন নতুন ছেলে নটবর কি করে হোস্টেলে থাকার সময় চোর ধরেছিল। এছাড়া চোরের মায়ের বড় গলা, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী এই রকম কত যে প্রবাদ প্রবচন আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তাঁর হিসাব নেই।
আমার মনে হয় চোর নামের ভেতরেই এক প্রবল আকর্ষন আছে যা কলম দিয়ে লেখার নয়তো বটেই, এমনকি রূপকথাতেও তা বলার নয়। ছোটবেলায় শুনতাম চোর নাকি অমুক বাসায় তমুক বাসায় সিং (সিদ) খুড়ে ঘরে ঢুকে সব চুরি করেছে। বাপরে শিঙওয়ালা চোর! তো সেকি দৈত্য, নাকি মানুষ তাই ভাবতে ভাবতে আমার দিন সারা হতো।এহেন চোর সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। আজ লিখবো আমার জীবনে দেখা কিছু চোরের কিচ্ছা।
এই গল্প ছোট বেলার, এই ব্লগের বিভিন্ন মন্তব্যেও আমি এই ঘটনার উল্লেখ করেছি তারপরো এটাই আমার জীবনে সর্বপ্রথম চোর দেখা তাই আবারও লিখছি । আমরা তখন সীতাকুন্ড থাকি । এক রাতে চোর এসে আমাদের জানালার ইয়া মোটা রড বাকিয়ে ঢুকতে না পেরে পাশের আরেকটি সরকারী কমপ্লেক্সের এক বাসায় হানা দেয়। সেখানে সে কি চুরি করেছিল তা আজ মনে নাই তবে সেই সরকারী কর্মচারীর স্ত্রীর মাথা মাড়িয়ে সে জানালা গলে পালিয়েছিল এটা পরিস্কার মনে আছে। কারন ভদ্র মহিলা চোরের এই অস্বাভাবিক কান্ডে ভয়েই অজ্ঞান, দে পানি, ঢাল পানি করে তাঁর নাকি জ্ঞ্যন ফেরানো হয়েছিল।
সকালে শুনলাম সেই চোরকে অনেক দুরের এক গ্রাম থেকে ধরে থানায় আনা হয়েছে। আব্বা থানা থেকে লোক পাঠালো আমাদের চোর দেখার জন্য কারন আব্বা জানতো চোরের ব্যাপারে আমি দারুন কৌতুহলী। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে জেরবার তাই চক্ষু কর্নের বিবাদ ভঞ্জনের জন্য আমাদের তিন ভাই বোনের ডাক পরলো থানায়। আমাদের সিপাই ভাই আলী আহম্মদের সাথে বেশ খানিকটা হেটে থানায় ঢুকে দেখি ওসি সাহেব বসা, আব্বা তাঁর সামনে চেয়ারে বসা আর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাধা এক দশাসই মুসকো জোয়ান মাটিতে বসে আছে। আব্বার পাশে গিয়ে দাড়াতেই মাটিতে বসা লোকটাকে দেখিয়ে বল্লো “দেখো এই হলো চোর”। আমার গলা দিয়ে প্রথমেই যে বাক্যটি বের হলো তা হলো “আব্বু সিং কই”! এটা নিয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আব্বার ট্রল শুনতে হয়েছে।
সারা গায়ে কাদা মাখা, ছোট ছোট উস্কোখুস্কো চুল, চোখে গজ দিয়ে ব্যান্ডেজ বাধা, বর্শা দিয়ে খুচিয়ে চোখ নাকি তুলে ফেলেছে গ্রামবাসীরা, সরকারী ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। এই অবস্থায় উনি হেসে হেসে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলছে আর চা খাচ্ছে। এই যে দুটো চোখই উপড়ে ফেলা, সারা শরীরে বর্শার আঘাত তারপরও হেসে হেসে চা খাওয়া সেদিনের সেই দৃশ্য আমার মনোজগতে বিশাল এক ভুমিধ্বসের সৃষ্টি করেছিল চোর। তাকে আমার কাছে সাহসী এক বীরের মতই লাগছিল সেদিন।
তাঁর কিছু দিন পরেই আবার শুনি চোর চোর । আম্মা চুল আচড়ে দিচ্ছিল, আম্মার হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে পাশের সরকারী কোয়ার্টারের আংগিনায়। মানুষ জন ঘিরে আছে আর তাঁর মাঝখানে এক লোক "বাবা, মাগো" বলে চিল্লাচ্ছে । তাঁর কান্না শুনে আমার গলা আদ্র হয়ে আসলো। আমি ঠেলেঠুলে জটলার ভেতরে ঢুকে দেখি এক শুকনা হাড় জিরজিরে লোক দুটো মুরগী কোলে বসা আর লোকজন একটু পর পরই তাঁর খুসকী ভরা জুল্পির আধাপাকাচুল গুলো টেনে টেনে ছিড়ে আনছে। এর মধ্যেই একজন অতি উৎসাহী তাঁর মাথার চুলগুলো আধাখ্যচড়া করে কেটে দিল। সে নাকি পাশের এলাকার বিখ্যাত মুরগী চোর।নানা রকম শাস্তির পর তাকে ছাড়া হলো আর আমার চোখের পানিও বন্ধ হলো।
সেই সীতাকুন্ড থেকে একবার ঢাকায় নানা বাড়ী বেড়াতে আসলাম, পৌছালাম ভোর সকালে।এসেই শুনি তাদের বাসায় চুরি হয়েছে। আমার নতুন বিবাহিত মামীর সব গয়না চুরি হয়েছে। সবচেয়ে তাজ্জবের বিষয় হলো আমার ডাক্তারী পড়ুয়া খালা মিটফোর্ড হোস্টেল থেকে আগের দিন বাসায় এসেছিল।সে নাকি অনুভব করলো কে একজন মশারীর ভেতর হাত ঢুকিয়েছে, আর হাতটা ঠিক তাঁর কানের কাছে কি যেন হাতড়ে ফিরছে । আমার খালা ভয় ভয় গলায় জিজ্ঞেস করলো ‘কে মা’? চোর বল্লো “হু” বলেই তাঁর কান থেকে পটাস করে দুলটা টেনে নিল, তখন খালার গলা দিয়ে আর আওয়াজ বের হয় না। সে বুঝলো মা না মামা ! যাই হোক মামীর গহনার জন্য যতটা খারাপ লেগেছিল ওনার দুলের জন্য আমার অত্টা খারাপ লাগেনি কারন উনি ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী এক বদমেজাজী মহিলা, সারাক্ষন আমাদের উপদেশ দিতেন আর বকাবকি করতেন। তাকে আমরা যমের মত ভয় পেতাম।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন সবার বাসায় বাসায় টু ইন ওয়ান, থ্রী ইন ওয়ান। আমাদের দুবোনের মাথার কাছে জানালার পাশেই থাকতো আমাদের দুজনার প্রিয় টু ইন ওয়ান, কারন গানের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিল আমাদের বাসার সবারই। একদিন রাতে খুটখুট শব্দে ঘুম ভেংগে তাকিয়ে দেখি এক চোর খোলা জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমাদের শখের টু ইন ওয়ান ধরে টানাটানি করছে।মাথার কাছে চোর দেখে আমি যেমন একেবারে বোবা হয়ে পরলাম। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না কি মুশকিল। মিনিট কয়েক পরে বোনকে আস্তে করে ঠেলা দিলাম সে আমার ছোট হলেও বেশ সাহসী।বোনতো কে কে করে উঠলো চোর ছুটে পালালো আমি তখন লাফ দিয়ে উঠে আব্বাকে জাগিয়ে তুলে আনলাম। আব্বা একদম শান্তভাবে আমাদের ঘরে ঢুকে জানালা আর টুইন ওয়ানের দিকে তাকিয়ে বল্লো “বেটা একটা বুরবক নাকি! গ্রীলের এই ছোট ফাক দিয়ে কি এটা বের করে নিতে পারবে " ! চোরটা যে কত বেকুব আর শুধু শুধু আমার ঘুম প্রিয় আব্বার ঘুমের ডিস্টার্ব করলো সেই কথা বলতে বলতে আমাদের ঘুমাতে বলে নিজের ঘরে গেল ঘুমাতে।
দুই সপ্তাহ আগের কথা ছেলে ফোন করলো, এই কথা সেই কথা। তারপর বল্লো আমার কথা মত সে একজনের সাথে দেখে করতে গিয়েছিল। সে নাকি খুবই নম্র-ভদ্র জেন্টেলম্যান যাকে বলে। সেখানে এক লোককে দেখে সে চমকে গিয়েছে কারন বছর খানেক আগেই তাকে যে দুরবস্থায় দেখেছিল সেখানে আজ সে ফিটফাট পোশাক, দামী সানগ্লাস পরে অনেক দামী গাড়ি চালিয়ে হাজির। অন্য মাধ্যম থেকে জানলো সে নাকি এখন অনেক বড় হুন্ডি ব্যাবসায়ী। বিভিন্ন দেশের বিশাল বিশাল চোরদের টাকা পয়সা সে লেনদেন করে। এই কথা বলে আমার ছেলে আমাকে বল্লো “তুমি শুধু শুধু আমাকে ভালো মানুষদের সাথে পরিচয় করায় দাও কি করতে শুনি! এদের সাথে পরিচয় করে কি লাভ আমার ! পারো তো একটা চোরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিও এরপর”।
আমি থতমত খেয়ে ঢোক গিলে বললাম “বাবা তুমি দেশে আসো, এখানে আসলে আর চোরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া লাগবে না, উঠতে,বসতে, হাটতে, চলতে অনেক চোরের সাক্ষাৎ পাবে”।
শিরোনামটা একটু পালটে দিলাম
ছবিটি নেট থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১০:০৯