যদিও আমি ড্রাইভারকে বলেছিলাম, ‘থোরাসা জালদি যাইয়ে’ তথাপি সে গাড়ী চালাচ্ছিল নির্দ্দিষ্ট গতিসীমার মধ্যে থেকেই, অর্থাৎ ঘন্টায় অনূর্ধ্ব ৭০ কি.মি. গতিতে। সঙ্গত কারণেই, কেননা সে আমার কারণে পুলিশের কাছে ধরা খেতে চায় না। টার্মিনালটি দৃশ্যমান হয়ে যতই কাছে আসছিল, ততই স্বস্তি পাচ্ছিলাম। এক সময় ড্রাইভার গাড়ী থামালো, আমিই প্রথমে গাড়ী থেকে নামলাম, সবসময় কাঁধে ঝোলানো আমার ট্রাভেল ব্যাগটাকে হাতে নিয়ে। নেমেই দেখতে পেলাম হলুদ জার্সি পরা একজন বৈধ ‘চেক-ইন সহায়তাকারী’ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সে আমাকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, অর্থের বিনিময়ে চেক-ইন কাজে সহায়তা করবে কিনা। এতদিন ধরে ট্রাভেল করছি, কোনদিন এই কাজের জন্য কারো সহায়তা নিতে হয়নি, তাই আমি তাকে বিনয়ের সাথে না করলাম। সে হাসিমুখে বিদায় নিতে নিতে আমাকে আমাদের ফ্লাইট নাম্বার জিজ্ঞেস করলো। কয়েকবার টিকেট দেখতে দেখতে ততক্ষণে ফ্লাইট নাম্বারটা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমি কনফিডেন্টলি বললাম, এসজি ১৩০। সাথে সাথে ছেলেটির মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল, তার বদলে কপালে ভ্রু-কুঞ্চন দেখা দিল। সে উৎকন্ঠিৎ হয়ে বললো, “স্যার, আপকো ফ্লাইট তো ইয়ে টার্মিনাল সে নেহী ছোঁড়েগা। আপকো টার্মিনাল-১ মে জানা পারেগা”। সাথে সাথে আমার ঠোঁট ফসকে বেড়িয়ে গেল, “আর ইউ শিওর?” সে ২০/২৫ গজ সামনে একটি গেটের সামনে কর্তব্যরত এক ইউনিফর্মধারী নিরাপত্তারক্ষীকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, বিশ্বাস না হলে তার কাছ থেকে শিওর হয়ে নিতে। আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাতে ধরা ব্যাগটাকে মেঝেতে রেখেই দ্রুতপায়ে সেই নিরাপত্তা রক্ষীর কাছে গেলাম। সে সেলফোনে আমাদের টিকেট দেখে গম্ভীরভাবে বললো টার্মিনাল-১ এ যেতে। ইতোমধ্যে পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে উবার ড্রাইভারকে গাড়ী সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়ায় সে গাড়ীটিকে বেশ কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে রাখলো। আমি সেটা লক্ষ্য করে নিরাপত্তা রক্ষীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পেছনে না গিয়ে দৌড়ে সামনে গিয়ে গাড়ীতে উঠেই বললাম, জালদি চলো! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম, আছে, এখনো সময় আছে। ড্রাইভারও সেটাই বলছিল।
ইতোমধ্যে রাস্তায় জ্যাম জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল। দশ মিনিটের রাস্তা পঁচিশ মিনিটে অতিক্রম করে অবশেষে টার্মিনাল-১ এ পৌঁছলাম। গাড়ী থামার পর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ী থেকে কেবল বাম পা টা নামিয়েছি, তখনি স্বভাবসুলভ অভ্যাসে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটার খোঁজ করলাম। সাধারণতঃ গাড়ীতে বসা অবস্থায় আমি সেটাকে আমার পাশেই রাখি, অন্যান্য ব্যাগ যেখানেই থাকুক না কেন। দেখলাম, সেটা গাড়ীতে নেই। হন্তদন্ত হয়ে আমার স্ত্রী ও ছেলে সবখানে খুঁজতে লাগলো। ইতোমধ্যে আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, কাশ্মীর ভ্রমণ ছাড়া যাবে, ব্যাগ ছাড়া যাবেনা। ড্রাইভারকে বললাম, ‘টার্মিনাল-২ মে ফের ওয়াপস চালিয়ে’! শুনে ড্রাইভারের চক্ষু ছানাবড়া। সে বললো, ‘স্যার, আপ ফ্লাইট মিস করেঙ্গে’। আমি বললাম, ‘ঠিক হ্যায়, কোই বাত নেই, আপ চালিয়ে প্লীজ’। সে আবার ফেরত রাস্তা ধরলো। আমি কোন স্টেথোস্কোপ ছাড়াই আমার বুকের লাব-ঢাব স্পন্দন ধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। দোষটা আমারই ছিল, কারণ আমি সেই নিরাপত্তা রক্ষীটির কাছে যাওয়ার সময় তড়িঘড়ি করে আমার সেই ব্যাগটাকে আমার স্ত্রী বা ছেলের হাতে না দিয়ে, কিংবা কাঁধে না ঝুলিয়েই মেঝেতে রেখে ত্রস্তপদে তার কাছে গিয়েছিলাম, ওরাও কেউ খেয়াল করেনি যে আমি ব্যাগটাকে সেই হলুদ জার্সি পরা ছেলেটার সামনে মেঝেতে রেখেই নিরাপত্তা রক্ষীর কাছে গিয়েছিলাম। আবার পুলিশের তাড়া খেয়ে ড্রাইভার গাড়ীটাকে সামনে এগিয়ে আনাতে আমারও লক্ষ্য ছিল তাড়াতাড়ি গাড়ীতে গিয়ে ওঠা। পেছনে গিয়ে ব্যাগটা আনার কথা মোটেই খেয়াল ছিলনা। জীবনে এই প্রথম নিজেকে একজন ভিলেন মনে হচ্ছিল।
যখন আমি এরকম কোন অবস্থায় পড়ি যে সামনে ঘোর অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারিনা, তখন আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে রাখা এক আলোবর্তিকার সন্ধান করি। সে আলো বিচ্ছুরিত হতে কিছুটা হয়তো সময় নেয়, তবে তা অবশ্যম্ভাবীরূপে আমাকে পথ দেখায়। আমি মনে মনে সাহস পেতে থাকলাম, কিন্তু সে সাহসেরও তো একটা সীমা আছে!!!
চলবে.... (অল্প কথার পোস্ট, ছবি নেই!)
ঢাকা
১১ মে ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৯ বিকাল ৪:২০