পূর্বের লিঙ্কঃ স্মৃতির জোয়ারে ভাসা (২)
(সতর্কবাণীঃ এটি একটি ব্যক্তিগত দিনলিপি। করোনায় আবদ্ধ জীবন কাটাতে কাটাতে একঘেয়েমি দূর করার লক্ষ্যে একদিন রংপুর শহর থেকে বের হয়েছিলাম ৫০ কিলোমিটার দূরে গ্রামের বাড়িটা একবার ঘুরে আসতে। একদিনের যাওয়া আসার সে পথের কিছু অভিজ্ঞতার কথা চার পর্বের এ সিরিজে বিবৃত হচ্ছে, যা নেহায়েৎ পারিবারিক কড়চা হলেও এখানে সেকাল ও একালের কিছু কথা, সমাজের কিছু আবছা চিত্র ফুটে উঠেছে। কিছু আনন্দ বেদনা, সাফল্য ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে, যা পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে নেয়া হলেও, পাঠকের মনে তার কিছু কিছু অনুভূতি এবং অনুরূপ স্মৃতি সঞ্চারিত হতে পারে। তবে এ কড়চা পড়তে পড়তে অনাগ্রহী পাঠকের ধৈর্যচ্যূতি ঘটার সম্ভাবনা প্রবল, সে কারণেই এ সতর্কবাণী।)
কাকিনা রেলওয়ে স্টেশনে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন অবস্থান করে আমাদের হোস্ট এর বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা তিনটা বেজে গেল। আমরা শুকানদিঘীতে থাকাকালেই মনিজা ফোন করে আমাদের অবস্থান জিজ্ঞাসা করেছিল। কিছুটা বিলম্বে পৌঁছানোর জন্য ওদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তাড়াতাড়ি ‘হাত ধুয়ে’ (করোনাকালীন পদ্ধতিতে) খেতে বসলাম। খেয়ে ওঠার পর পরই ওর ছেলে মাহিন চলে গেল প্রাইভেট পড়তে। ওকে বিদায় জানানোর আগে ওর সাথে এবং পরিবারের সবার সাথে কয়েকটা গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম। মনিজার ঘরের পশ্চিমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষণ আকাশটাকে দেখলাম, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম নীচের ঝোপ ঝাড়ের দিকে। শৈশবে আমি ঢাকা শহরে মানুষ হয়েছি, কিন্তু প্রায় প্রতি বৎসরান্তে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি যেতাম। যেটুকু সময়ই আমি গ্রামে কাটিয়েছি, তার মায়াময় স্মৃতি এসব ছবি দেখলে আমার চোখে ভাসে। সূর্যাস্তের মধ্যেই রংপুরে ফিরে আসার তাড়া থাকায় খাওয়া দাওয়ার পর আর মনিজার বাসায় বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হলোনা। সেখানেই আসরের নামায পড়ে নিলাম এবং ওর সংসারের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় নামায শেষে দোয়া করে বিদায় নিলাম।
কাকিনায় আমার ফুফাতো বোন হাফসা বুবু থাকেন। বহু যুগ ধরে তাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ না হওয়ায় দেখা করার ইচ্ছেটা আগেই উৎপলের কাছে প্রকাশ করেছিলাম। এই হাফসা বুবু আমার আপন ফুফাতো বোন, আমার চেয়ে বছর খানেকের বড় হবেন। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, উনি অষ্টমে। এই রকম সময়ে একবার আমরা স্কুলের বৎসরান্ত ছুটিতে মেথী ফুফুর (হাফসা বুবু’র মা) বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই শুনি যে বুবু’র বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তো শুনে অবাক, অষ্টম শ্রেণীতে থাকতেই বিয়ে! ‘টিন এজ’ শুরু হবার পর পরই কাজীর খাতায় একজন পরিণীতা বধূ হিসেবে ওনার নাম ওঠে, ‘বিদায়’ হন অবশ্য এসএসসি পরীক্ষার পর। আমাদের দুলাভাই সে সময়ে কেবল এইচএসসি পাশ করে কারমাইকেল কলেজের বিএসসি কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। উনি বুবুকে খুব আদর করে, তার কল্পলোকের সুখের নীড় বাঁধার স্বপ্নের কথা, ভালবাসার কথা জানিয়ে চিঠি লিখতেন। বুবু সেসব চিঠি পড়ে বিভোর হতেন, খুশিতে আত্মহারা হতেন, এবং কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারতেন না। একজন বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে স্বামীর চিঠি পাওয়া এবং একান্তে তা পড়ার অধিকার তার রক্ষণশীল পরিবারেও স্বীকৃত ছিল, কিন্তু সে চিঠির উত্তর লেখা এবং তা স্বামীর কাছে যেন ঠিকমত পৌঁছে, তা নিশ্চিত করা তার জন্য এক দুরূহ ব্যাপার ছিল। বুবু তার দুই একটা চিঠি সাবধানে, রেখে-ঢেকে অতি সন্তর্পণে আমাকে দেখিয়েছিলেন। আমি বয়সে ছোট হলেও, সে সময়ের এ কিশোরী বালিকার বিরহী মনের নীরব আকুতি বুঝতে পারতাম এবং তা লক্ষ্য করে বেদনাক্রান্ত হ’তাম। তখন যদি এখনকার মত লিখতে পারতাম, তবে হয়তো আমি একটা উপন্যাসই লিখে ফেলতে পারতাম।
যাহোক, অত্যধিক রক্ষণশীলতার কারণে আমার এ বুবু এবং তার বড় ছোট আরও তিন বোন কঠিন পর্দা প্রথা মেনে চলতে বাধ্য ছিলেন। আমার দাদী খুব সুন্দরী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে আমার ফুফু এবং ফুফাতো বোনগুলোও সে সৌন্দর্য অনায়াসে লাভ করেছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীর পর ওনাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে স্কুলের খাতায় নামটি টিকিয়ে রাখা হতো। ওনারা সবাই বাড়ীতে নিজ উদ্যোগে স্কুলের সব বই পাঠ করে শুধুমাত্র পরীক্ষার দিনগুলোতে স্কুলে যেয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতেন। এর পরেও প্রথম পজিশনটা যেন ওনাদের জন্য সংরক্ষিতই থাকতো। ওনারা চার বোনই এভাবে পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি ও অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পেয়ে, এসএসসি ও এইচএসসিতে দু’তিনটা বিষয়ে লেটার মার্কসহ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং উচ্চতর বৃত্তিও পেয়েছিলেন । একটি অজ পাড়াগাঁ থেকে বিনা কোচিংয়ে এমন সাফল্য অর্জন সে যুগে অবিশ্বাস্য ছিল। আমার এ বুবুও তার গর্ভে একইরকম মেধাবী চৌদ্দজন সন্তান ধারণ করেছিলেন এবং তাদের সবাইকে সঠিকভাবে লালন করে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এদের মধ্যে একটি সন্তান প্রতিবন্ধী ছিল। বাকিদের মধ্যে এগারজনই ঢাকা/ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়/বুয়েট/কুয়েট থেকে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে ভাল ভাল চাকুরিতে নিয়োজিত আছে এবং একজন আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসে পিএইচডি করছে। ওনার সবচেয়ে ছোট ছেলেটি বুয়েটে মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং অধ্যয়ন করছে। তবে বুবু’র জীবনে ইতোমধ্যে দুটো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তার একটি মেয়ে, যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে কেবল একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছিল, রংপুরের তীব্র শীতের এক রাতে এশা’র নামায পড়ার জন্য ওযু করে এসে উঠোনে আগুন পোহানোর সময় দুর্ভাগ্যক্রমে পরিচ্ছদে আগুন লেগে অগ্নিদগ্ধ হয়। তাকে সুচিকিৎসার জন্য ঘাটে ঘাটে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। বেশ কয়েকদিন অগ্নিদগ্ধের অসহনীয় জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করার পর সে একদিন সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যায়। একটি সম্ভাবনাময় প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা এভাবেই সবাইকে আঁধারে রেখে হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় নির্বাপিত হয়ে যায়। এরপর একদিন বুবু’র প্রতিবন্ধী সন্তানটিও তার মা’কে চিরমুক্তি দিয়ে স্রষ্টার ইচ্ছায় পরপারে চলে যায়!
বুবু’র বাড়িতে গিয়ে শুনি আমাদের দুলাভাই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় বেশ কয়েক বছর ধরে অচল জীবন যাপন করছেন। শয্যা এবং হুইল চেয়ারে এখন তার জীবন সীমিত। তাকে দেখে ভীষণ মায়া হলো। আমাদের এই দুলাভাই সম্পর্কে দুটো কথা না বললেই নয়। আগেকার দিনে স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য একজন করে বিএসসি শিক্ষক থাকতেন। তারা মুখে মুখে ‘বিএসসি স্যার’ নামে অভিহিত হতেন। দুলাভাইও ছিলেন কাকিনা উচ্চ বিদ্যালয়ের সেরকম একজন ‘বিএসসি স্যার’। একজন স্কুল শিক্ষকের সামান্য আয়ে তিনি আজীবন দরিদ্র থেকেছেন, কিন্তু তিনি খেয়ে না খেয়ে ছেলে মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষা দানের ব্যাপারে আপোষহীন ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি পুত্র ও কন্যা সন্তানের মাঝে কোন বৈষম্য করেন নি, তাদের মাঝে উচ্চশিক্ষার উচ্চাকাঙ্খার বীজ সমভাবে রোপন করেছিলেন। সে কারণেই ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং গ্রামীণ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তার মেয়েদের সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছে। তিনি উদারমনা ছিলেন, অত্যন্ত ধার্মিকও ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। এসএসসি’র পরপরই তিনি কে কী বলে বলুক, ছেলেমেয়েদেরকে হয় ঢাকায় না হয় রংপুরে রেখে এইচএসসি পাশ করিয়েছিলেন। তারা উচ্চশিক্ষাও লাভ করেছে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, না হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, না হয় বুয়েট/কুয়েট থেকে। তবে এ সাফল্য অর্জনের জন্য তাদের ছেলেমেয়েরাও শিক্ষাব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ভীষণ কষ্ট করে হোস্টেল জীবন পার করেছে। এজন্য দুলাভাই এবং বুবু’র সাথে সাথে আমি তাদের ছেলেমেয়েদের কষ্ট ও ত্যাগস্বীকারকেও স্বীকৃতি দেই এবং গোটা পরিবারের ছোট বড় সব সদস্যকে অভিবাদন জানাই। বড়গুলো ঠিক পথে চলেছে বিধায় পরেরগুলো আর বিপথগামী হবার সুযোগ পায় নাই।
বুবু’র ছোট ছেলেটি, যেটা এখন বুয়েটে মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং অধ্যয়ন করছে, এসে আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। আমি ওর কাছে ওদের ভাই বোনরা কে কোথায় আছে, কী করছে, ইত্যাদি খোঁজ খবর নিলাম। বিশেষ করে ওদের সবচেয়ে বড়ভাই লাভলু সম্পর্কে বেশি করে জিজ্ঞেস করলাম, কারণ বুবু’র প্রথম সন্তান হওয়ায় তাকেই আমি অন্যান্যদের চেয়ে বেশি দেখেছি। ওদের বাড়িতে বসে ভাবছিলাম, যোগাযোগের অভাবে রক্তের সম্পর্কও কিভাবে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়! বেলা পড়ে আসছিল বিধায় উঠতে হচ্ছিল। আমি বুবু’র সাথে স্মৃতি হিসেবে একটা ছবি তুলতে চাইলে উনি হাসিমুখে রাজী হয়ে গেলেন। এটা দেখে ওনার ছোট মেয়ে মিতু হেসে বলে উঠলো, মামা, এই প্রথম দেখলাম মা’কে, যে এত স্বাচ্ছন্দ্যে ছবি তুলতে রাজী হয়ে গেলেন! আমার মনে পড়ছে বুবু’র সেদিনের সে প্রশান্ত হাসিমুখটা, আর তার ঠিক দশ/এগার দিন পরেই আজ যখন এ লেখাটা আমি লিখছি, কত বড় একটা মর্মান্তিক শোকের কালোছায়া সেই হাসিমুখটাকে ঢেকে দিয়ে গেল! কোথা থেকে হঠাৎ কী হয়ে গেল! গতকাল বুবুর বড় ছেলে আবুল ‘আলা মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান (লাভলু) কে তাদের পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হলো। করোনাক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪/৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে লাভলু তার আগের দিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যুর সময় সে ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহের বিভাগীয় প্রধান (অতিরিক্ত পরিচালক)। মা বাবা বেঁচে থাকতে তার এ মৃত্যুর ভার তাদের জন্য দুর্বহ। এ চিরবিদায়ের তীব্র শোক হয়তো তার বোধশক্তিহীন বাবাকে স্পর্শ করতে পারবে না, তবে দু’জনের যৌথশোকের ভারটাকে তার সর্বংসহা মাকে একাই এখন থেকে বাকিটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে! আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন মরহুমকে ক্ষমা করে দিন, তাকে জান্নাত নসিব করুন এবং তার রত্নগর্ভা কিন্তু বড় অভাগা মাকে এ শোকের তীব্র দংশন সহ্য করার তৌফিক দিন! তাদের সকলকে শান্তি দিন, সুরক্ষা করুন!
ভ্রমণঃ ২৫ জুন ২০২১
লিখনঃ ০৮ জুলাই ২০২১
স্থানঃ রংপুর
শব্দ সংখ্যা ১২৭৩