মহীপুর ব্রীজ থেকে দেখা বিষণ্ণ আকাশ
“ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে”......
ছবি তোলার সময়ঃ ২৫ জুন ২০২১, সন্ধ্যা ৬-৩৭
কাকিনার গর্ব উনিশ-বিশ শতকের কবি শেখ ফজলল করিম (‘ফজলুল’ নয় কিন্তু; কবি তার নিজের নামটা ‘শেখ ফজলল করিম’ ই লিখতেন)। আদিতমারি যাওয়া আসার পথে রাস্তার উপর ‘কবির বাড়ি’র প্রতি দিকনির্দেশ করে স্থাপিত তিরচিহ্নটি বহুবার দেখেছি, কিন্তু কখনো প্রধান রাস্তা থেকে সামান্য পার্শ্ব-পথটুকু অতিক্রম করে কবি’র বাড়িতে যাওয়া হয়নি। এবারে ভাবলাম, দেখেই যাই কবি’র বাড়িটা। পথে বসে থাকা কয়েকজন অলস আড্ডাবাজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবি’র বাড়ি ঠিক কোনটা’? আলস্যভরে একজন কোনমতে ‘ঐ হোথা’ ধরণের উত্তর দিল। তার উত্তরে মোটেই সন্তুষ্ট না হয়ে অগত্যা এগোলাম, একটা পাকা বাড়ির খুঁটিতে দেখতে পেলাম লেখা আছে ‘কবি বাড়ি’। ইচ্ছে হচ্ছিল কবির কোন উত্তরসূরীর সাথে কথা বলি। বাড়ির ভেতর থেকে মানুষের কথার আওয়াজও পাচ্ছিলাম। কলিং বেল আছে কি না তা খুঁজলাম। দেখতে পেলাম না, তাই ইচ্ছেও হলো না গলা হেঁকে অন্দর মহলের কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করার। আশেপাশে একটু ঘোরাঘুরি করলাম, দেয়ালের ফাঁক ফোকর দিয়ে যতটুকু দেখা গেল, বাড়ীর ভেতরটাকে বেশ ওয়েল মেইন্টেন্ড মনে হলো। একজন পথিক কে জিজ্ঞেস করলাম, কবি’র সন্তানেরা কেউ বেঁচে আছেন কিনা। তিনি জানালেন যে কবি’র একজন মাত্র নাতি বেঁচে আছেন, তবে তিনিও বার্ধক্যের ভারে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী। বাড়ির সামনেই কবি’র ক্ববর দেখতে পেলাম। সমাধি ফলকে কিছু ঝরা পাতা ঠাঁই নিয়েছে। সেখানে উৎকীর্ণ রয়েছে কবির চিরবিখ্যাত কবিতার অজর চারটে চরণঃ
“কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক?
কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক,
মানুষেতে সুরাসুর”।
আব্বা আমাদেরকে বলেছিলেন, কবি ওনার মামা সম্পর্কিত ছিলেন এবং এক সময় তিনি কবি’র ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন। কবি’র বাড়িতেও তার বেশ কিছুকাল পদচারণা ছিল। কবি’র বাড়িটা দেখে তাই মনে মনে আব্বাকেও স্মরণ করলাম এবং এমন নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন একটা পরিবেশে তার পদচারণা ছিল, এ কথা ভাবতেও ভালো লাগলো।
কবি পরিচিতিঃ শেখ ফজলল করিম ১২৮৯ বঙ্গাব্দের (১৮৮২ সাল) ৩০ই চৈত্র বর্তমান লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা বাজার গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আমিরউল্লাহ সরদার এবং মাতার নাম কোকিলা বিবি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ফজলল করিম ছিলেন দ্বিতীয়। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল মোনা।
ছোটবেলা থেকেই কবির লেখা-পড়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল, এমনি কি তার বয়স যখন তিন-চার বছর তখন তিনি বাড়ী থেকে পালিয়ে স্কুলে চলে যেতেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে কাকিনা স্কুলে ভর্তি হন। প্রায় প্রতি বছরেই বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য তিনি পুরস্কৃত হতেন। ফজলল করিম মাত্র ১২ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতার বই সরল পদ্য বিকাশ হাতে লিখে প্রকাশ করেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে তাকে রংপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করা হলে তিনি তা ছেড়ে কাকিনা স্কুলে ফিরে আসেন। সেখান থেকেই ১৮৯৯ সালে মাইনর পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। এরপর তাকে আবারও রংপুর জেলা স্কুলে দেওয়া হলে স্কুলের বাঁধাধরা পড়াশোনায় মন বসাতে না পেরে তিনি সেখান থেকে আবারও ফিরে আসেন এবং জ্ঞানার্জনে উৎসাহী হয়ে প্রচুর বই পড়তে থাকেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বসিরন নেসা খাতুনের সাথে ফজলল করিমের বিয়ে হয়। এরপর অনেক কারণে তার স্কুল জীবনের ইতি ঘটে। দুঃখের বিষয় যে আমরা শিশুদের মানসিক বিকাশে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিতে চাই না। সে কারণেই কবিকে শৈশবে প্রতি ক্লাসে প্রথম স্থান অর্জন করা সত্ত্বেও কাকিনার গ্রামীণ পরিবেশ থেকে রংপুর জিলা স্কুলের শহুরে পরিবেশে স্থানান্তর করে জলের মাছকে ডাঙায় তোলা হয়েছিল। ফলে তার পড়াশুনার যবনিকাপাত করা হয়। রংপুর ছেড়ে দুই দুইবার কাকিনায় ফিরে এসে এ কিশোর কবি রক্ষা পান নি। মাত্র তিন-চার বছর বয়সে যে শিশু বাড়ী থেকে পালিয়ে স্কুলে চলে যেত, সেই আবার কিশোর বয়সে রংপুর জিলা স্কুল ছেড়ে কাকিনায় ফিরে এসেছিল!
সাহিত্যের প্রতি তার প্রচন্ড আগ্রহের কারণে কর্মজীবন ফজলল করিমকে তেমন ভাবে আকর্ষণ করতে পারে নি। ছোটবেলাতেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আয়ত্ত করেছিলেন যা তিনি কাজে লাগাতেন গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবায়। তিনি বাড়িতে বসেই দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা করতেন। সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার প্রতি ফজলল করিমের প্রচন্ড ইচ্ছা এবং আগ্রহ থেকে তিনি নিজ বাড়ীতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
জীবনকালেই তিনি বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। ‘বাসনা’ সম্পাদনার সময় রোমিও-জুলিয়েট সম্পর্কিত তার একটি কবিতা পাঠ করে তৎকালীন প্রখ্যাত সাহিত্যিকেরা তাকে বাংলার শেক্সপিয়র আখ্যা দেন। ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্যপদক লাভ করেন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাকে ‘সহিত্যবিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘চিন্তার চাষ’ গ্রন্থের জন্য তিনি নীতিভূষণ পদকে ভূষিত হন। কাশ্মীর শ্রীভারত ধর্ম মহামন্ডল তাকে রৌপ্যপদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাকে কাব্য ভূষণ, সাহিত্যরত্ন, বিদ্যাবিনোদ, কাব্যরত্নাকর, ইত্যাদি উপাধিতে ও সম্মানে ভূষিত করে।
১৯৩৬ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবি’র মাজারের অপর পার্শ্বস্থ কবরস্তানে একটি বাঁধানো প্রস্তরফলকে এই স্মরণিকাটা দেখে মনটা একটু কেমন করে উঠলোঃ
“হে পথিক--- একটু দাঁড়াও, আমাদের জন্য আল্লাহ’র নিকট দোয়া করে যাও, আজ তোমরা যেভাবে আছো, গতকাল আমরা সেভাবে ছিলাম। আজ আমরা যেভাবে আছি, আগামীকাল তোমরা সেভাবে থাকবে”। অজানা অচেনা, নাম না জানা উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য এবং প্রয়াত কবি’র জন্য খানিকক্ষণ মৌন প্রার্থনা জানিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
আদিতমারি যাওয়ার সময় মহীপুর ব্রীজে নামার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শুরুতেই যাত্রায় বিলম্ব ঘটানো সমীচীন নয়, এই ভেবে নামি নাই। ফেরার পথে নানা কারণে মনটা বিষণ্ণ ছিল। মহীপুর ব্রীজের সন্নিকটে যখন, তখন আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখি পশ্চিমাকাশের মেঘে মেঘে যেন আমার বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে। উৎপলকে বললাম একটু থামতে। এই করোনার মাঝেও ব্রীজের উপর তরুণ যুবাদের মটর সাইকেলের প্রচুর ভিড়। বিনোদনহীন দেশে একটি ব্যস্ত ব্রীজের উপর সন্ধ্যার প্রাক্কালে মটর সাইকেল হাঁকিয়ে তরুণ তরুণীদের হাওয়া খাওয়াটাও একটা বিনোদনে পরিণত হয়েছে। এমন ভিড় ভাট্টার মাঝে বেশিক্ষণ থাকতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া আমরা ব্রীজের উপর থাকতেই ফোন এলো, আম্মার জরুরি পরিচর্যা দরকার, আমাদের প্রয়োজন। আমরা একটানে আধ ঘন্টার মধ্যে বাসায় ফিরে এলাম।
চার পর্বে বিবৃত মাত্র একদিনের একটা জার্নি, সকাল সাড়ে দশটা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত, সেটার কথা লিখতেই তো প্রায় পৌণে পাঁচ হাজার শব্দের চার চারটে পর্ব হয়ে গেল! চলার পথে এবং যাত্রাবিরতিতে দেখা কিছু দৃশ্য আর তৎসম্পর্কিত কিছু স্মৃতি নিয়েই চার পর্বের এ সিরিজটা লিখেছি। বিভিন্ন পর্বে দেওয়া ছবিগুলো দেখে অনেকেই হয়তো বা মনে করছেন, এই করোনা এবং 'লকডাউন' এর মধ্যে আমি বোধ হয় বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসলে তা নয়। রংপুরে আসার পর গত এক মাসে মাত্র একদিনই ঘর হতে বের হয়েছি, আর সেটাও 'লকডাউন' শুরু হবার আগে। সব ছবি ও স্মৃতিচারণ- ঐ একদিনেরই!
এ পথচলার বিবরণী “স্মৃতির জোয়ারে ভাসা” সিরিজটি এখানেই সমাপ্ত হলো। যারা আমার সাথে এ স্মৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন, তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ভ্রমণঃ ২৫ জুন ২০২১
লিখনঃ ০৯ জুলাই ২০২১
স্থানঃ রংপুর
শব্দ সংখ্যা ৯৬৪
কবি’র সমাধি ফলকে আশ্রয় পাওয়া কিছু ঝরা পাতা
ছবি তোলার সময়ঃ ২৫ জুন ২০২১, বিকেল ৬-০৪
‘কবি বাড়ি’ টা দেখে আব্বার কথা মনে হচ্ছিল।
ছবি তোলার সময়ঃ ২৫ জুন ২০২১, বিকেল ৬-০২
কবরস্থানের প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ একটি আবেদন
ছবি তোলার সময়ঃ ২৫ জুন ২০২১, বিকেল ৬-০৬
মহীপুর ব্রীজ থেকে দেখা বিষণ্ণ আকাশ
ছবি তোলার সময়ঃ ২৫ জুন ২০২১, সন্ধ্যা ৬-৩৭
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:১৪