আমি কোন লেখক নই, কোন কালেও তেমন ছিলাম না। ছোটবেলায় কখনো কখনো ডায়েরী লেখার ইচ্ছে জাগতো বটে, চেষ্টাও করেছিলাম কয়েকবার, কিন্তু সে ডায়েরী অরক্ষিত থাকতো বলে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো, তাই এক সময় বিরক্ত হয়ে সে ইচ্ছে ও অভ্যেস দুটোই পরিত্যাগ করি। ছাত্রাবস্থায় টুকটাক কবিতা লিখতাম, দুই একটা প্রবন্ধ লিখেও স্যারদের প্রশংসা পেয়েছিলাম, তবে এ নিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারি নি। যৌবনের প্রারম্ভে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে লেখনীতে ছিপি এঁটে দেই। অবসর জীবনে এসে আফসোস হলো, জীবনের বাঁকে বাঁকে অনেক যেসব গল্প লুকিয়ে ছিল, সেগুলো সে সময়ে লিখে রাখলে হয়তো নিষ্প্রাণ শব্দগুলো এক সময় প্রাণ পেয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো। যাহোক, সেটা যখন হয়নি, গতস্য শোচনা নাস্তি!
কর্মক্ষেত্র থেকে অবসরে এসে শুরুতে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে এবং সমাজকল্যাণমূলক কিছু কার্যকলাপে বেশ সক্রিয়ভাবে আত্মনিয়োগ করি। লক্ষ্য করলাম, ঘরের বাইরে বের হলেই, যদি চোখ কান খোলা থাকে, তবে অনেক গল্প শোনা যায়, গল্পের চিত্রপট দেখা যায়। বহু বছর আগে আমাদের সংসার শুরু হবার পর পরই একটা ক্যামেরা কিনেছিলাম। তখন সময় পেলেই রমনা পার্ক, মিরপুর বোটানিকাল গার্ডেন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি জায়গায় গিয়ে প্রচুর ছবি তুলতাম। উল্লেখ্য, তখন সেই স্থানগুলোর পরিবেশ এখনকার মত নোংরা ময়লা ও মানুষ দ্বারা পরিবৃত ছিল না। সময় কিভাবে ফুরিয়ে যেত তা টেরই পেতাম না। একেকটা ফিল্মের রীল শেষ হলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন সেই ছবিগুলোর প্রিন্ট কপি হাতে পাবো! এক সময় সে অফুরন্ত উদ্যমেও ভাটা পড়লো। ক্যামেরা ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। বহুদিন পর নতুন মিলেনিয়ামের শুরুতে হাতে সেলফোন এলো, কিন্তু কার সাথে কথা বলবো? খুব কম সংখ্যক মানুষের হাতে তখন সেলফোন এসেছে, তাই গুটি কয়েক বন্ধুর সাথে তখন সেলফোনে আলাপ হতো, তাও কদাচিৎ। ধীরে ধীরে সেলফোনের প্রসার ঘটতে থাকলো, উন্নততর ভার্সন আসতে থাকলো, সেলফোনের সাথে ক্যামেরা যুক্ত হলো। ব্যস, আবার শুরু হলো যত্রতত্র বেহিসেবি ছবি তোলা। এভাবে ছবি তুলে পরবর্তীতে অবকাশ সময়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে লক্ষ্য করলাম, পথ চলার সময় তোলা এসব ছবিতেও অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে। আবার চলার পথের বৃত্তান্তকে স্মরণীয় করে রাখতেও এসব নির্বাক ছবি গল্প বুকে ধারণ করে রেখে নীরবে গল্প বলে যায়।
২০১৩ থেকে ২০১৯, এ ছয় বছরে দেশ-বিদেশ ভ্রমণে উৎসাহী হই। কোন কোন বছরে একাধিকবার দেশের বাইরে গিয়েছি, দেশের অভ্যন্তরেও ঘুরে বেড়িয়েছি। এ সময়টাতে প্রচুর ছবি তুলেছি এখানে সেখানে- সেগুলো কি শুধুই স্মৃতিচারণের জন্য? না, যা কিছুই দেখতে ভাল লেগেছে, তারই ছবি তুলে রেখেছি। স্মৃতিচারণ লক্ষ্য ছিল না, পরবর্তীতে অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। এখন মাঝে মাঝে সেসব ছবি দেখি, আর সেখান থেকে গল্প তুলে এনে এখানে সেখানে লিখি। কেন লিখি? মনের আনন্দে। এসব লেখার কোন সাহিত্যমূল্য নেই, তবে আমি মনে করি এসব ছবি ও গল্প কোন না কোন কারণে আমার কাছে প্রেরণার হয়ে আছে, মনোহর মুগ্ধতার উপকরণ হয়ে আছে। নেপালে একটা নিঃসঙ্গ ফুল দেখে, মেলবোর্নে একটা পার্কের পাথর বিছানো সরু রাস্তা ও তার আশেপাশের গাছ-গাছালি, গুল্মলতা ও নিঃশব্দে প্রবহমান ভূঁইফোর একটি শীর্ণ ঝরনার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছিলাম, কয়েকটা বাংলায়, কয়েকটা ইংরেজীতে- যখন যেটা যেভাবে মনে উদিত হয়েছে, সেভাবে। কবিরা জানেন, কবিতা লিখা যায় না, কবিতা ‘আসে’। আমি জানি, আমার মনে এখন যেসব কবিতা মাঝে মাঝে আসে, একদিন তাদের আসা বন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা যেতে পারে। তাই কবিতা-অকবিতাগুলো যখন আসে, তখন সেগুলো লিখে ফেলে আমি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি, ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এবং ব্লগে শেয়ার করি। এগুলো পড়ে কেউ যদি কখনো ভালো কিছু বলেন, আমি অনুপ্রাণিত হই। কেউ সাধারণতঃ খারাপ কিছু বলেন না, কিন্তু তবুও আমি জানি সমালোচনার অনেক কিছুই থাকে আমার অপরিণত লেখায়। ইংরেজীতে কবিতা লিখি বলে অনেকেই খোটা দেয়, তাদের উষ্মা প্রকাশ করে, কিন্তু আমি নাচার। কবিতার লাইনগুলো মনে যেভাবে আসে, সেভাবেই লিখি, সেভাবেই লিখতে হয়।
আমি যা কিছু লিখে চলেছি, তা জীবন থেকে নেয়া। জীবনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। প্রতিটি মানুষেরই জীবনের গল্প থাকে, কেউ সেসব নিয়ে লিখেন, কেউ লিখেন না। তবে এসব গল্প লিখতে ও পড়তে অনেকেই ভালবাসেন। লেখা ভাল হলে তা পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায়, তারা পঠিত গল্পের সাথে তাদের নিজের গল্পগুলো মিলিয়ে দেখতে ভালবাসেন। গল্পে তো গল্প থাকেই, এমন কি কবিতায়ও থাকে। এজন্য কিছু কিছু কবিতা পড়েও আমরা আমাদের জীবনের গল্প মিলিয়ে দেখি। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষের (অর্থাৎ আমাদের) জীবনটা যেমন কোন কোন না কোন সময়ে রূঢ় বাস্তবতার কশাঘাতের সম্মুখীন হয়, এদের অনেকেই তেমনি কোন না কোন সময়ে এমন শুভক্ষণ প্রাপ্ত হয়, যার গরিমা এরা (অর্থাৎ আমরা) সারা জীবনের সুখস্মৃতি হিসেবে উপভোগ করে/করি। সুখ ও দুঃখের সম্মিলিত গল্প নিয়েই আমাদের জীবন। সকল প্রতিকূলতার মাঝেও আমি আমার এ জীবনটাকে ভালবেসে বড় হয়েছি, এখন বুড়োও হচ্ছি। জীবনের প্রতি এই ভালবাসা থেকেই আমার লেখালেখি। একদিন এ লেখা থেমে যাবে। তখন কেউ অপেক্ষা করবে না আমার নতুন কোন লেখা পড়ার জন্য। যা কিছু লিখেছি এখানে ওখানে, সেগুলোও চাপা পড়ে যাবে অজস্র নতুন লেখার অতল তলে। কেউ যদি সেগুলো পুনরায় কিংবা নতুন করে পাঠ করতে চায়, তাকে প্রত্নতাত্ত্বিকের মত অনেক খনন কার্য সমাধা করতে হবে। তবে সেগুলো হয়তো থেকে যাবে এ ল্যাপটপে এবং সেলফোনে। যখন এ দুটো নিত্য-ব্যবহৃত উপকরণ মালিকবিহীন হয়ে যাবে, তখনও এরা আমার লেখাগুলোকে বুকে ধারণ করে রবে, জাঙ্ক হিসেবে বর্জিত হয়ে বর্জ্যস্তুপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। এর পরে ওদের, সেই সাথে আমার লেখাগুলোর গন্তব্য কোথায় হবে, কে জানে!
ঢাকা
২৬ জুলাই ২০২১
শব্দ সংখ্যাঃ ৭৯৯