লোকটি তার ছেলেদেরকে হাঁটতে হাঁটতে গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। বড় ছেলেটি তাকে নানা রকমের প্রশ্ন করছে, আর ছোটটি মাথার চুল আঁকড়ে ধরে বাবার ঘাড়ে বসে আছে। লোকটা ঘাড়ের শিশুটির ব্যালেন্স সামলে রেখে এগিয়ে চলেছে।
অপত্য স্নেহঃ
প্রতিটি মানুষের জীবন যেন একেকটি উপন্যাস। এ উপন্যাস রচনা শুরু হয় তার মাতৃগর্ভে জীবনের স্পন্দন শুরু হওয়া থেকে, আর যবনিকা টানা হয় শেষ নিঃশ্বাসটি নির্গত হওয়ার মুহূর্তটিতে। এর মাঝে ঘটে যায় কত শত ঘটনা, যার সাথে জড়িত থাকে প্রেম প্রীতি ভালবাসা, সুখ দুঃখ হাসি কান্না, আনন্দ বেদনা, ক্রোধ হিংসা উষ্মা, আত্মীয় অনাত্মীয় বন্ধুদের নিবিড় আনন্দঘন সান্নিধ্য কিংবা দুঃসহ একাকীত্বের কষ্ট ও যাতনা। এসব নিয়েই আমাদের যাপিত জীবন। এর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট অনুভূতি হচ্ছে প্রেম ভালবাসা আদর স্নেহ ও মায়ার অনুভূতি। যখনই এসব অনুভূতির কোন অভিব্যক্তির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, আমি মনে মনে খুব খুশি হই। আমার ‘ক্ষণিকের দেখা’ সিরিজের লেখাগুলোতে মানুষের এসব সূক্ষ্ম অনুভূতি ও আবেগের কথা বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে। গতকাল হাঁটার পথে দেখতে পেলাম দু’টি শিশুর প্রতি তাদের পিতার অপত্য স্নেহের এমনই একটি অপূর্ব দৃশ্য! আমার সামনে দিয়ে এক যুবক হেঁটে যাচ্ছিল। তার দু’কাঁধের দু’পাশে দু’পা ছড়িয়ে বসে ছিল এক শিশু, এবং তার বাঁ হাতের তর্জনী ধরে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল আরেকটি শিশু। অনুমান করলাম, শিশুদু’টি ঐ ব্যক্তির সন্তান হবে হয়তো। ছোটটির বয়স হবে আনুমানিক দু’বছর, বড়টির চার বছরের মতন। আমি যখন একটু দ্রুত হেঁটে তাদেরকে অতিক্রম করছিলাম, তখন আমার কানে এলো, লোকটি তার ছেলেদেরকে হাঁটতে হাঁটতে গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। বড় ছেলেটি তাকে নানা রকমের প্রশ্ন করছে, আর ছোটটি মাথার চুল আঁকড়ে ধরে বাবার ঘাড়ে বসে আছে। লোকটা ঘাড়ের শিশুটির ব্যালেন্স সামলে রেখে এগিয়ে চলেছে। আমার খুব ভালো লাগল এ দৃশ্যটি দেখে। লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম শিশু দুটোই ছেলে কিনা এবং ওরা তার সন্তান কিনা। লোকটি হেসে দুটোরই হ্যাঁসূচক উত্তর দিল। আমি তার অনুমতি নিয়ে দুটো ছবি তুলে রাখলাম, ক্ষণিকের দেখা অপূর্ব এ দৃশ্যটি আমার আর্কাইভে রাখার জন্য। ছবি তোলার তারিখ ও সময়ঃ পহেলা মাঘ ১৪২৮ মোতাবেক ১৫ জানুয়ারী ২০২২ সকাল ১১টা ৩৫ মিনিট।
বয়স্ক বয়স্কাদের নিঃসঙ্গতাঃ
বয়স্ক বয়স্কারা তাদের ছেলেপুলেদের মানুষ করে কর্মক্ষেত্রে পাঠিয়ে নিজেরা অনেক সময় কর্মহীন, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। এ সময়টা তাদের খুব কষ্টে কাটে, বয়স্কাদের বেশি। আমি আমার হাঁটার পথে প্রতিদিন এমন অনেক বয়স্ক বয়স্কাদের আনমনে হেঁটে যেতে দেখি। অনুমান করতে কষ্ট হয়না, এভাবে একাকী হাঁটতে তাদের খুব কষ্ট হয়। কেউ লাঠি হাতে পা টেনে টেনে হাঁটেন, কেউ ধীর পদক্ষেপে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে এটা ওটার ছবি তুলতে তুলতে। কেউ তাদেরকে একটু হ্যালো হায় বললে তারা গল্প জুড়িয়ে দিতে চান। কেউ হাঁটতে হাঁটতে পথ পাশে রাখা বেঞ্চে বসে খানিক জিরিয়ে নেন, পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। তারা জানেন, যতই অনিচ্ছা হোক, সুস্থ থাকতে হলে তাদের হাঁটতে হবেই! হাঁটার পথে তাদের না জানি কত কথাই মনে পড়ে যায়! জীবনোপন্যাসের নানা চরিত্র হয়তো তাদের মনে উঁকি দিয়ে যায়! এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই একদিন তাদের হাঁটা থেমে যায়। কেউ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, কেউ চলে যান অগস্ত্য যাত্রায়!
অভিযোগহীন মন, যাপিত জীবনঃ
‘সাতখামাইর’ রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনটির আগে পিছের স্টেশন দু’টির নাম বোধকরি যথাক্রমে কাওরাইদ এবং ধীরাশ্রম। বাল্যকাল থেকে এ স্টেশনের উপর দিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি যাতায়াত করতাম। পাকিস্তান আমলে ছিল মাত্র দু’টি ট্রেন। ফুলবাড়িয়া/কমলাপুর স্টেশন থেকে সকালে ছাড়তো ১১ আপ দ্রুতযান এক্সপ্রেস, রাত এগারটায় ছাড়তো ৭ আপ নর্থ বেঙ্গল মেইল। ‘সাতখামাইর’ স্টেশনটি জাংশন স্টেশন নয় বিধায় ঐ দুটো ট্রেনের কোনটাই সাতখামাইর স্টেশনে সাধারণতঃ থামতো না। জয়দেবপুর থেকে থ্রু-পাস নিয়ে একেবারে ময়মনসিংহ স্টেশনে গিয়ে থামতো। মাঝে মাঝে গফরগাঁও স্টেশনেও থামতো। সাতখামাইর স্টেশনেও থামতো, যদি সম্মুখবর্তী কাওরাইদ স্টেশনে অপর দিক হতে সেই সময়ে কোন ট্রেন ‘ইন’ হতো। ১৯৭৯ সালের দিকে আরেকটি ট্রেন যোগ হয়, নাম ‘একতা এক্সপ্রেস’। এ ট্রেনটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন সিনিয়র মন্ত্রী, নীলফামারীর খগাখড়িবাড়ি নিবাসী মশিউর রহমান যাদু মিঞা। এখন একই রুটে আরও তিনটি ট্রেন চলে, রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস এবং লালমনি এক্সপ্রেস।
আজ সকালে সেই ‘সাতখামাইর’ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ২/৩ কি.মি. পশ্চিমে ‘টেংরা’ নামক গ্রামে অবস্থিত আমার এক বন্ধুর ‘ফার্ম হাউস’ এ গিয়েছিলাম। ৫/৬ বছর আগেও একবার সস্ত্রীক গিয়েছিলাম, আজ শুধু দু’বন্ধু মিলেই গিয়েছিলাম। সেখানে একটি ‘গোলঘর’ আছে, যেটার ছাদে নতুন করে তাল পাতার ছাউনি দেয়া হচ্ছিল। আমি তাকিয়ে দেখলাম, এক বৃ্দ্ধ ব্যক্তি একাই আনমনে সে ছাউনি বুনছেন। আমি অনুমান করলাম, তিনি ষাটোর্দ্ধ্ব হবেন। এই বয়সেও তাকে জীবিকার তাগিদে ছাদে উঠে একা একা এ কাজটি করতে দেখে তার প্রতি আমি মায়া অনুভব করলাম। কৌতুহলী হয়ে আমি একটু আলাপের সূত্রপাত করলাম এবং এক পর্যায়ে আমি তাকে তার বয়স জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি এক গাল হেসে জানালেন, ‘নব্বই বছর’। আমি চমকে উঠলাম এবং বিস্ময় প্রকাশ করে তা অবিশ্বাস করলাম। তিনি আবারও হেসে বললেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের আগেই তিনি তিন সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। আমি কিছুটা মানসাংক কষে সাব্যস্ত করলাম, তার বয়স নব্বই না হলেও আশির কাছাকাছি তো হবেই। সেটাও এক বিস্ময় বটে!
পরে তার সাথে আরও আলাপ করেছি। তার নাম রহিমুদ্দিন। গ্রামঃ নামা ভিটিপাড়া, ডাকঘরঃ ভিটিপাড়া, ইউনিয়নঃ বরমী, উপজেলাঃ শ্রীপুর, জেলাঃ গাজীপুর। তিনি মাত্র তিন বছর বয়সে তার মাকে হারিয়েছেন। তার বাবা মোহাম্মদ আব্দুল গফুর মোট ৭টি বিয়ে করেন। কোন সৎ মা-ই তার প্রতি সদয় ছিলেন না বিধায় তার স্নেহময়ী নানী শিশু বয়সেই তাকে নিয়ে যান এবং নিজের কাছে রেখে মাতৃস্নেহে তাকে লালন করেন। এই নানীর প্রতি তিনি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। তাকে এত উদারভাবে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে লালন করতে নানীকে সুযোগ দেয়ার জন্য তিনি তার নানার প্রতিও সবিশেষ কৃতজ্ঞ। তার নানা একজন সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন বলে তিনি জানান। নানী তাকে ৩০ বছরের মত লালন পালন করে ইন্তেকাল করেন।
তার বাবার মত তিনি ৭টি বিয়ে করেন নি। এই প্রায় ৮০ বছর বয়সেও তিনি একটি বউ নিয়েই সুখী জীবন যাপন করছেন। তিনি যখন ছাদ বুনার কাজ শেষ করে নীচে নেমে এসে আমার সাথে কথা বলছিলেন, আমি তখন লক্ষ্য করেছিলাম তিনি লাঠি নির্ভর, এবং তার ডান হাতটি নিরন্তর কাঁপছে। অর্থাৎ, তিনি পার্কিন্সন্স রোগে ভুগছেন। লাঠিটা তিনি ব্যবহার করেন হাঁটার সুবিধার্থে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ডান হাতের কাঁপুনি থামানোর জন্য। লক্ষ্য করলাম, লাঠির আগায় হাত রাখার সাথে সাথে তার হাতের কাঁপুনিটা অনেকটাই থেমে গেল। আমার বিস্ময়ের শেষ রইলো না যখন দেখি এর পরেও প্রতিটি কথার তিনি হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছিলেন। অশীতিপর এই সদালাপী ব্যক্তি জীবনের প্রতি তার কোন অভিযোগ নেই বলে জানান। আগে কিছুটা ‘বয়স্ক ভাতা’ পেতেন, এখন অন্য কেউ একজন তার নামে টাকাগুলো উঠিয়ে নিয়ে যায়। তিনি টাকা তুলতে গেলে তাকে জানানো হয়, ‘তোমার টাকা আগেই দেওয়া হয়ে গেছে’। এ নিয়ে তার কোনই অভিযোগ নেই। কাজ করেই এখনো তিনি তাদের দুটি মুখের অন্ন সংস্থান করতে পারেন। তার স্ত্রীর শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি আবারও হেসে উত্তর দিলেন ‘অচল’। অচল মানে শয্যাশায়ী কিনা এটা জিজ্ঞাসা করাতে তিনি জানালেন, ‘না, এখনো কোনরকমে চলাফেরা করে, রান্দে বাড়ে, আমারে খাওয়ায়’।
আমার সাথে কথা শেষ করে তিনি মাটিতে বসে একটা পুটলি বের করে তা থেকে একটা পান বের করে মুখে পুরলেন। আঙুলে চুন মেখে তিনি দাঁতে লাগালেন। আবারও হাসতে হাসতে তিনি বললেন, তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। তাদের ঘরে তার মোট ১৮টি নাতি নাতনি আছে। তিনি তাদের গর্বিত নানা/দাদা। তাদের সবাইকে নিয়ে তিনি সুখি জীবন যাপন করছেন। আমি বুঝলাম, এরই নাম মায়া! এমন একটি মায়াময়, অভিযোগবিহীন মন থাকলে যাপিত জীবন অবশ্যই সুখের হয়।
ঢাকা
০২ মাঘ ১৪২৮
১৬ জানুয়ারী ২০২২
শব্দ সংখ্যাঃ ১০৭৬
পা চলতে চায় না, তবুও লাঠি ভর করে পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়!
"তাকিয়ে দেখলাম, এক বৃ্দ্ধ ব্যক্তি একাই আনমনে সে ছাউনি বুনছেন" - অশীতিপর, সদালাপী রহিমুদ্দিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:২৯