নাজমা বেগম তার প্রতিবন্ধী সন্তানকে মূলতঃ সাদা ভাতই খাওয়াচ্ছেন।
ছবি তোলার সময় ও তারিখঃ ১৩ মার্চ ২০২২, ১১ঃ৪১ পূর্বাহ্ন।
অপত্য স্নেহঃ নাড়ি ছেঁড়া ধন, সে যে মানিক রতন, হোক না যদিও সে ধন যেমন তেমন!
আজ মধ্যাহ্নে গুলশানে একটা কাজ সেরে বাড়ী ফিরছিলাম। একটা ছোটখাটো যানযটে আটকা পড়ায় গাড়ী খুব ধীর লয়ে এগোচ্ছিল। হঠাৎ পথপাশে নজর পড়লো। দেখি, ফুটপাথের একটা পাশে জড়সড় হয়ে বসে এক নারী হুইলচেয়ারে বসা, মাথা একদিকে কাৎ হয়ে থাকা এক বালককে পরম মমতায় একটা প্লাস্টিকের পাত্র থেকে ভাত খাওয়াচ্ছেন। তার পাশ দিয়ে সারি সারি গাড়ী, রিক্সা, ভ্যান এবং অন্যান্য যানবাহন ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে, সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার গাড়ী তাকে অতিক্রম করে গেল, কিন্তু দৃশ্যটা মনে গেঁথে র’লো। মনটা খুঁত খুঁত করতে থাকায় কিছুদূর গিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিয়ে আমি নেমে পড়লাম, সেই নারী আর তার সন্তানের কাছে ফিরে এলাম। দেখলাম, তিনি তার সন্তানকে মূলতঃ সাদা ভাতই খাওয়াচ্ছেন। পাত্রের একটু কোণার অংশে সামান্য একটু ঝোল মাখা, সাথে মুরগি’র মাংসের অতি ক্ষুদ্র একটি টুকরো (সেফটিপিন)। ছেলেটা সেই শুকনো ভাতটুকুই কত তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে! তিনি জানালেন, ঐ এলাকার কোন একজন সহৃদয় ব্যক্তি তাকে ডেকে ওটুকুই দিয়েছেন, এ রকম অনেকেই দেন। কেউ না দিলে তিনি ভিক্ষার টাকা থেকে কিছু কিনে খান। রাতে বাসায় ফিরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সামান্য যা কিছু জোগাড় করতে পারেন, তাই রান্না করেন। সারাদিনে একবেলাই রান্না করেন, ভাত বেঁচে গেলে জলে ভিজিয়ে রাখেন, পরদিন সকালে লবণমাখা পান্তা ভাত খেয়ে সন্তানকে নিয়ে বের হন। যেদিন কিছু জোগাড় করতে পারেন না, সে রাতে উপবাস থাকেন।
ভাবছিলাম, আমরা অবলীলায় কত খাবার অপচয় করি, নষ্ট করে ফেলে দেই। এই দৃশ্যটা দেখে সে কথাটাই বার বার মনে হচ্ছিল। আলাপচারিতায় জানলাম, মহিলার নাম নাজমা বেগম, বাড়ি নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলায়। তার দুই ছেলের মধ্যে এ ছেলেটা বড়, তার বয়স ১২ বছর। অপরটা ওর চেয়ে কয়েক বছরের ছোট, থাকে নানীর বাড়িতে। প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেয়ার ‘অপরাধে’ তার স্বামী তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে। কোথায় গেছে, কোথায় থাকে তা তিনি জানেন না। পরিপার্শ্বের লোকজনের অপবাদ ও গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে তিনি স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় নেত্রকোণা থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন। থাকেন শ্যাওড়াবাজার এলাকার নিকটস্থ এক ব্যক্তির আশ্রয়ে। ভিক্ষা করে তার ছেলের এবং নিজের অন্ন সংস্থান করতে হয়, এবং সেই আশ্রয়দাতা ব্যক্তিকেও মাসিক কিছু ভাড়া মেটাতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ছাড়া তার প্রতিবন্ধী ছেলেটির জন্য তিনিই যেমন একমাত্র সহায়, তারও দুঃসময়ে একমাত্র সহায় হিসেবে এগিয়ে এসেছেন তার মা জননী, দ্বিতীয় ছেলেটিকে লালনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে। দুটোই হয়েছে নাড়ি ছেঁড়া ধনের মায়ায়। মহিলার বয়স এখন তার নিজের হিসেব মতে ৩৫ বছরের মত। তিনি এখনো শক্ত সমর্থ, কায়িক পরিশ্রম করে উপার্জনে সক্ষম। কিন্তু তার বিলাপ, তিনি ছেলেটিকে রেখে কোথাও যেতে পারেন না, কারণ সে মূলতঃ শয্যাশায়ী, কোন রকমে হুইলচেয়ারে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারে। মলমূত্র ত্যাগ সব করে শয্যায়, সেজন্য কেউ তার ধারে কাছে আসে না। মা ছাড়া তার মুখে এক কাৎরা জল তুলে দেয়ার কেউ নেই। কোন কথা বলতে পারে না, তবে ক্ষুধার কথাটা অভিব্যক্তির মাধ্যমে সে বোঝাতে পারে, যদিও কোন সন্তানকেই তার মায়ের কাছে ক্ষুধার কথা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।
আমি অবাক হ’লাম, যখন এই মহিলা তার এই করুণ অবস্থার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে তার কোন অনুযোগ নেই বলে জানালেন। অন্য কারো বিরুদ্ধেও তার কোন অভিযোগ নেই। তার এ পরিস্থিতিকে তিনি অদৃষ্টের পরিহাস বলে মেনে নিয়েছেন। তবে জীবন চালিয়ে নিতে তিনি আত্মপ্রত্যয়ী। যতক্ষণ তার শ্বাস আছে, ততক্ষণ তিনি তার এ প্রতিবন্ধী বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরেই নিত্যদিনের জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলে জানালেন। বিড়িবিড় করে একটা সংক্ষিপ্ত বাক্য উচ্চারণ করলেনঃ “আমার জন্য শুধু দোয়া কইরেন, যেন সুস্থ থাকি”। সংগ্রামী এই মহিলার সাথে দেখাটা হয়েছিল ক্ষণিকের তরে, কিন্তু তার কথাটা মনে রয়ে যাবে অনেক দিন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তার সহায় হউন, তাকে সবর দান করুন। তাকে ও তার স্নেহময়ী মাকে এবং তার দু’সন্তানকে সুরক্ষা করুন!
ভরদুপুরে বাকিটা পথ আমি হেঁটেই ফিরে এলাম।
ঢাকা
১৩ মার্চ ২০২২
শব্দ সংখ্যাঃ ৫৮১
তার গভীর মনোনিবেশ এই সন্তানের প্রতি। পৃথিবীর আর কোথায় কী ঘটছে, কে দেখছে না দেখছে, সেসব জানার তার কোন প্রয়োজন নেই।
ছবি তোলার সময় ও তারিখঃ ১৩ মার্চ ২০২২, ১১ঃ৪০ পূর্বাহ্ন।
মায়ের অপত্য স্নেহ।
ছবি তোলার সময় ও তারিখঃ ১৩ মার্চ ২০২২, ১১ঃ৪০ পূর্বাহ্ন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ৯:৫৫