somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভুলো মন..... (২)

২৩ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৩:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এর আগের পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ ভুলো মন.... (১)

আমার এ সিরিজের আগের পর্বটা পড়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে বয়স্করা ছাড়াও, অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ব্যক্তিরাও ভুলোমনা হতে পারে। হ্যাঁ, তা তো পারেই। ভুলোমনা হওয়া আর মেমোরি ঠিকমত রেসপন্ড না করার মধ্যে একটু পার্থক্য রয়েছে। কোন কারণে আনমনা হয়ে থাকলে মানুষ ক্ষণিকের তরে ভুলোমনা হতে পারে, এজন্য সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে ভুলে যেতে পারে। আর প্রচুর ইচ্ছেশক্তি নিয়েও যখন স্মৃতি হাতড়িয়ে এ যাবত জানা কোন তথ্য স্মরণ করতে পারে না, তখন বলা যায় তার স্মৃতি শক্তি লোপ পাচ্ছে, যদিও এটা অত্যন্ত প্রাথমিক একটা আভাস হতে পারে। খানিক পরেই হয়তো অন্য কোন সংকেতের সূত্র ধরে সেই অন্বেষিত তথ্যটি আপনা আপনিই উদঘাটিত হতে পারে। আমার বাল্যবন্ধু ড. হুমায়ুন কবির আমেরিকার একজন খ্যাতিমান ঘুম বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বাংলাদেশেও তিনি গুলশানে একটি ‘ঘুম ক্লিনিক’ খুলে গেছেন বছর তিনেক আগে। বাংলাদেশের ঘুম বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাই সেটা স্থানীয়ভাবে দেখাশুনা ও পরিচালনা করেন, বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রয়োজনবোধে টেনিসি থেকে তিনি রোগীদের কেস স্টাডি করে পরামর্শ প্রদান করেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, যেমন প্রতি বছর আসেন। কিন্তু আমার অস্ট্রেলিয়া সফরের কারণে এবারে আমি তার সঙ্গ মিস করেছি। আমাদের হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে জানলাম, তিনি সম্প্রতি বন্ধুদের এক আড্ডায় ডিনার শেষে এক সংক্ষিপ্ত ‘টক’ এ ঘুমের উপর খুব জোর দেন। তিনি বলেছেন, একনাগাড়ে দীর্ঘদিন প্রতি এক ঘণ্টার ঘুম বঞ্চনা মানুষের মর্টালিটি রেট ১২% বৃ্দ্ধির কারণ হতে পারে। অপর্যাপ্ত ঘুম কিংবা অসময়ের ঘুম মানুষের স্মৃতিশক্তিকে দুর্বল করে দেয় এবং তা থেকে নানারকমের স্নায়বিক রোগ দেখা দিতে পারে। আমার ঘুমের কোন সমস্যা নেই। দিনে হোক, রাতে হোক, শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে যাই এবং দিনরাত মিলিয়ে কমপক্ষে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুমাতাম ঢাকায় থাকতে। এখন অস্ট্রেলিয়ায় এসে সেটা আট ঘণ্টার ঘুমে পরিণত হয়েছে। তবুও ভুলোমনা হওয়া থেকে আর রেহাই পাচ্ছি কোথায়!

ঘর থেকে বের হতে হলেই, সেটা ৩/৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাসার আশে পাশের এলাকাতে হাঁটার জন্যেই হোক, কিংবা দূরে কোথাও, প্রথম দিন থেকেই আমি চারটে “M” ঠিকমত নিলাম কিনা, বের হবার আগে তা পকেট হাতড়ে, নাকের নীচে হাত দিয়ে যাচাই করে নেই। এই চারটে “M” হলোঃ মাস্ক, মানি ব্যাগ, মোবাইল ফোন এবং “মাইকি কার্ড” (বাসে/ট্রেনে/ট্রামে চড়ার কার্ড)। আর চশমা যেন যত্র তত্র ফেলে না আসি, সে জন্যে ওটাকে খুলতে হলে তা অন্য কোথাও না রেখে থুতনির নীচে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে এসেছি। সেদিন আমরা হাঁটার জন্য বাইরে বের হচ্ছি। মাস্ক লাগালে চশমার কাঁচটা ঘোলা হয়ে যায় বলে ওটাকে নীচে ঝুলিয়ে রেখে নিঃশ্বাস বের হবার পথটা ক্লীয়ার রাখলাম। কিছুদূর হাঁটার পর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস নাক দিয়ে ঢুকে শরীরে কাঁপুনি তুলছিল। আমি গিন্নীকে বললাম,
-একটু থামো, আমি আসছি।
-কেন, হাঁটবা না? কোথায় যাচ্ছো?
-বাসায়।
-কেন?
-নাক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। মাস্কটা নিয়ে আসি।
-থুতনির নীচে ওটা কী ঝুলছে?
হাত দিয়ে পরখ করে একটা নিঃশব্দ হাসি, মাস্কটা ঠিকমত লাগিয়ে আবার পথচলা শুরু!

এখন যদিও বিভিন্ন ট্রেন লাইনের এবং বাসের রুট আমাদের আয়ত্ত্বে এসে গেছে, প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হতো, অযথা কনফিউশনে বিব্রত হ’তাম। তখন একে ওকে জিজ্ঞেস করে কনফিউশন দূর করতাম। এখানকার মানুষগুলো এত, এতই ভালো যে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে প্রথমেই একটা ‘হাই’ বলে মুখে স্মিত হাসি এনে এমনভাবে বুঝিয়ে দেবে যে সন্দেহের আর কোন অবকাশ থাকে না। প্রয়োজন হ’লে আমাদের সাথে দু’কদম হেঁটে এসে পথ দেখিয়ে দেবে। পথচারী, সহযাত্রীদের এসব অসামান্য সৌজন্যমূলক আচরণ নিয়ে আরেকদিন লেখার ইচ্ছে আছে। আমাদের নাতনি’র যখন জন্ম হলো, ছেলে, বৌমা আর নবজাতক ৫/৬ দিন হাসপাতালে ছিল। আমরা দু’জনে বিকেলের ‘ভিজিটিং আওয়ার’ এ ওদেরকে দেখে বাসায় চলে আসতাম। হাসপাতালটি বাসা থেকে বেশ দূরে হওয়াতে বাসে অথবা ট্রেনে যেতে হতো, অথবা উভয়টি মিলিয়ে। তবে কোনটাতেই একবারে যাওয়া যেত না। মাঝখানে পথে Cranbourne এ বাস বা ট্রেন বদল করতে হতোই। তখন রোযার মাস ছিল। গিন্নী দু’জনের জন্য পানির বোতল এবং কিছু ফলসহ অন্যান্য কয়েকটি মেন্যুর একটি হাল্কা ইফতার বক্স ক্যারী করতেন একটা ছোট্ট ব্যাগে, যেন পথিমধ্যে ইফতারের সময় হলে আমরা রোযা ভাঙতে পারি। সেদিন আসার সময় বাসে আমরা গল্প করছিলাম। Cranbourne স্টেশনে বাস এসে পড়লে আমাদের খেয়াল হলো, এখানে নামতে হবে। তড়িঘড়ি করে নেমে এলাম, দু’জনের মাঝখানে রাখা সেই ইফতারের ব্যাগটি নামানোর কথা দু’জনের কারও খেয়াল হলো না। বাসটা ছেড়ে যাবার ঠিক পরে পরেই তা খেয়াল হলো, এবং ইতোমধ্যে পরের রুটের বাস এসে গেছে। ইফতারের তখনো মিনিট দশেক বাকী, কিন্তু এ বাস ছেড়ে দিলে পরের বাস আসতে বেশ দেরি হবে। আমরা তাই বিষণ্ণ মনে বাসে উঠে পড়লাম।

ইফতারের একটু পরেই ছেলে ফোন করে আমাদের অবস্থান জানতে চেয়ে জিজ্ঞস করলো আমরা ইফতার করেছি কিনা। ইফতারের ব্যাগটা হারানোর কথা আমার তাকে জানানোর ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ছেলে যেহেতু ওর মাকে ফোন করেছে, গিন্নী তাকে সবিস্তারে ঘটনার কথা জানাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছিল, আকাশটাও মেঘলা ছিল। আমরা যে স্টপে নামবো, সেটা এসে গেল এবং আমরা তা খেয়াল করতে করতে চলেও গেল! যে দিনটা খারাপ যাবে, সেটা এভাবেই যাবে, মনকে এভাবে প্রবোধ দিয়ে আমরা পরের স্টপে নেমে অতিরিক্ত প্রায় সাত মিনিটের পথ হেঁটে বাসায় ফিরলাম। ঠিক সে সময়ে ছেলের ফোনঃ
- তোমরা বাসায় পৌঁছেছো?
-(এবারে সে আমাকে ফোন করেছিল, আমি আর তাকে আমাদের বেকুবি’র কথাটা না বলে বললাম) হ্যাঁ, এইমাত্র পৌঁছলাম, কেবল তালা খুলে ঘরে ঢুকছি।
-আচ্ছা শোন, ফ্রীজ থেকে কিছু খাবার বের করে গরম করে খেতে খেতে তোমাদের তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। দশ মিনিটের মধ্যে কেউ একজন বাসায় তোমাদের জন্য খাবার ডেলিভারী দিয়ে যাবে। কলিং বেল এর দিকে খেয়াল রেখো, ওটা শুনতে মিস কোরনা।
-সেটার আর প্রয়োজন হবে না, আমরা তো বাসায় পৌঁছেই গেছি।
-অনলাইনে অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। ডেলিভারীম্যান পথিমধ্যে, বাসার কাছেই চলে এসেছে। আচ্ছা রাখি!


অগত্যা আমরা হাতমুখ ধুয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটু পরেই কলিং বেল এর আওয়াজ শোনা গেল। আমরা ধীরে সুস্থে বিলম্বিত ইফতার-কাম-ডিনার করে, বিলম্বিত নামায আদায় করে, আল্লাহতা’লার শোকর গুযার করে শয্যাগ্রহণ করলাম।


মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১৮ জুন ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৮৭৯
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২২ সকাল ৭:৩৭
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×