এবারে আমাদের আদরের নাতনিটা চল্লিশ দিনের মত বেড়িয়ে গেল দেশ থেকে। এই চল্লিশ দিনের মধ্যে ওর জন্মদিনটাও পড়েছিল। সেদিন ওর মা, বাবা ও ছোটভাইটা সহ ওরা সুন্দরবনে ছিল। সেখানে ছোট্ট করে শুধুমাত্র পরিবারকে নিয়ে ওর জন্মদিন স্মরণ করা হয়েছিল। ফিরে আসার পর একটি অনুষ্ঠান করে ওর জন্মদিনটাকে পালন করা হয়। অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে সে উৎফুল্ল মনে ওর গিফটগুলো খুলে খুলে দেখছিলো। নগদ টাকা হাতে পেয়েও সে খুব খুশি! একটু পরে সে একটা ডায়েরি আর কলম নিয়ে এসে বসলো। সেখানে সে তালিকা করছিল ওর উপহারের টাকা দিয়ে কাকে কাকে উপহার কিনে দিবে। তালিকার এক নম্বরে দেখলাম ওর প্রাণপ্রিয় ছোটভাই আরহামের নাম, যদিও চব্বিশ ঘণ্টা জুড়েই ওদের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকে। দেখলাম, তখন পর্যন্ত করা তালিকার মধ্যে আমার নামটি নেই। তার পরের কিছু কথোপকথনঃ
- লিস্টে আমার নাম নেই কেন?
-ওয়েট করো।
- আরহামকে তুমি কী কিনে দিবা?
-গাড়ী।
-আমাকেও একটা গাড়ী দিও।
-না, তুমি গাড়ী পাবা না।
-কেন?
- কারণ তুমি অনেক বুড়া! (You are too old for toy cars!)
-তা'হলে আমাকে তুমি কী দিবা?
-পরে দেখবা।
এর পরে আর বলার কীই বা থাকে! তাই কথা আর গড়ালো না, শুধু মুখ টিপে হাসলাম। পরেরদিন বিকেলে সে তার মাকে নিয়ে ইউনিমার্ট থেকে সবার জন্য গিফট কিনে এনে যার যার হাতে তুলে দিল। আমাকে দিল একটা কলম। বুঝলাম, বুঝে শুনেই সে আমার গিফটটা কিনেছে।
ইতোমধ্যে কানাডায় ওর স্কুল খুলে গেছে বেশ কয়েকদিন হলো। কানাডায় ওদের সাথে ছিলাম ৯৫ দিন। আমরা ফিরে আসার দুইদিন পর ওরা ঢাকায় এসে থেকে গেল একনাগাড়ে ৪০ দিন। একসাথে প্রায় ১৩৫ দিন থাকার ফলে বুকের মাঝে মায়ার বৃক্ষ দিনে দিনে অনেক ডালপালা ছড়িয়েছে। ওদের যাবার সময়টা যতই নিকটে আসছিল, ভেতরে ভেতরে ততই শূন্যতার অনুভূতি ঘনিভূত হচ্ছিল।
বুড়ি ফিরে গেছে। বাসার আনাচে কানাচে রেখে গেছে অনেক, অনেক ছোট ছোট স্মৃতি! ও ফিরে যাবার পর ঘরটা যেন শূন্য খাঁচায় পরিণত হয়েছে, আমরা হয়ে গেছি empty-nesters। আমরা এদিকে ওদিকে ঘুরি ফিরি, কখনো দু'জনে এককভাবে, আবার কখনো দীর্ঘদিনের বন্ধুদের সাথে যূথবদ্ধ হয়ে। দিনশেষে ঘরে ফিরে এলে, ঘর ফাঁকা!
এই তো জীবন! যুগ যুগ ধরে এভাবেই মানুষ প্রিয়জনদের সান্নিধ্য লাভ করে উষ্ণ হয়েছে, উৎফুল্ল হয়েছে; একসময় তাদেরকে দৃষ্টির অগোচরে বিদায় জানিয়ে বিষাদগ্রস্ত হয়েছে, বুকে ও চোখে ধারণ করা তাদের স্মৃতিগুলোকে অবসরে স্মরণ করে আপন মনে ভারাক্রান্ত হয়েছে। ওর দিদিকেও দেখি, ওর কথা বলতে বলতে উঠে গিয়ে আড়ালে চোখ মুছে আসে। এই যে মায়া, এ মায়ার বাঁধন থেকে মানুষের যেন কোন নিস্তার নেই!
ঢাকা
০৬ অক্টোবর ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ৩৮৯