আজ ঢাকার তাপমাত্রা ২৪/১৪, এবারের শীতকালের এ যাবত শীতলতম দিন। এ টুকুতেই পায়ে মোজা, গায়ে কয়েক পরতে কাপর চোপর এবং গলায় মাফলার জড়িয়েও যেন রক্ষা নেই। এর পরেও যেন আমার বুকে ত্রাহি-ত্রাহি রব, এই বুঝি ঠাণ্ডা বাতাস নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে লাংসসহ কলজেটাকে খামচে ধরে! গত কয়েকদিনে ফজরের নামাযের পর প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছিলাম। সেটা করতে গিয়ে কিছুটা অসাবধানতা বশতঃ একটা বিশ্রী রকমের ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হয়েছি। এ ধরণের সর্দ্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে আমি সাধারণতঃ হট স্যালাইন ওয়াটার গার্গলিং করি এবং নাপার বাইরে কোন ঔষধ সেবন করি না। কিন্তু এবারে মনে হচ্ছে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
গতকাল 'সামহোয়্যারইনব্লগ' এ ব্লগার শেরজা তপন রচিত চমৎকার একটি পোস্ট পড়লাম এস্কিমোদের জীবনধারা নিয়ে। পোস্টটা পড়ার সময় ভাবছিলাম, আমার যদি ১৪+ প্লাস তাপমাত্রায় এ অবস্থা হয়, এস্কিমোরা মাইনাস ৬০- এর মধ্যে উন্মুক্ত মেরু প্রান্তরে বরফের ব্লক দিয়ে বানানো ঘরে হু হু শৈত্য প্রবাহের মাঝে কী করে বেঁচে থাকে! পোস্টটা পড়ে আরও জানতে পারলাম, পশ্চিমে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে যেমন নিগ্রো বা নিগার বলা একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত ও ঘৃণিত হয়, উত্তরের মেরুবাসীদেরকে এস্কিমো বলাটাও তেমনি একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত ও ঘৃণিত হয়। এখন তাদেরকে 'এস্কিমো' এর পরিবর্তে 'ইনুইট' নামে ডাকা হয়। আমিও এখন থেকে ওদেরকে 'ইনুইট' নামেই ডাকবো।
যাহোক, পোস্টটা পড়তে পড়তে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পেশীবহুল 'ইনুইট'দের জীবনের শেষ পর্যায়ে ক্ষয়ে যাওয়া বা প্রকৃতির বুকে চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার করুণ একটা কাহিনী পড়ে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলাম। বয়স্ক ইনুইট নরনারীরা কি করুণ এবং সাহসী একটা পরিণতিই না স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়! এ বিষয়ে আমি লেখকের পোস্ট থেকেই নীচের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছিঃ
"আকস্মিক রোগ শোকে কিংবা দুর্ঘটনায় যে কোন সময় মানুষ মারা যেতে পারে। এস্কিমোরা খুব কম ক্ষেত্রেই রোগে আক্রান্ত হয়। ওরা কিছু ক্ষেত্রে শিকার করতে গিয়ে শিকারের আক্রমণে মারা যায়। একজন ইনুইট সুদীর্ঘ সময় সুস্থ সবল দেহে বেঁচে থাকে। ইনুইট সমাজে অকর্মণ্যদের কোন স্থান নেই! হোক সে বয়স্ক কিংবা নারী। ইনুইট বৃদ্ধরা শারীরিকভাবে এত বেশী সুস্থ থাকে যে, তাদের বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন অর্গ্যান দুর্বল হয়ে পড়লেও মৃত্যু এসে সহজে হানা দেয় না। একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা যখন বুঝতে পারে যে সে প্রায় অক্ষম হয়ে যাচ্ছে, তখন সে কারও জন্য বোঝা হয়ে ওঠার আগেই স্বেচ্ছা মৃত্যু বেছে নেয়।
কোন এক কঠিন শীতের রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে- সে ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয় কম্বলখানা ছেড়ে উঠে পড়ে। শেষবারের মত 'তিমির তেলে'র পিদিমের আলোতে ইগলু ঘরখানা আর তাঁর অতি প্রিয় ও আপনজনদের ভাল করে দেখে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে লাঠি হাতে বের হয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে... তাঁর এই শেষ প্রস্থান কেউ হয়তো দেখে- কিন্তু আটকায় না। এইটাই ওদের নিয়তি! যে দেখে সে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে তাকেও বেঁচে থাকলে একদিন নিশ্চিত এমন নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে হবে!"
চিন্তা করা যায়, জীবনের মায়া সাঙ্গ করে এমন নির্মম একটা স্বেচ্ছামৃত্যু বরণের পেছনে কতটা সাহস আর কতটা নীরব বেদনা অদৃশ্য রয়ে যায়! সেইসব বয়স্ক নরনারীরা জানে যে নিশীথ রাতে নিজের ইগলু থেকে বের হয়ে তারা বেশি দূর যেতে পারবে না। হয় ক্লান্ত হয়ে বরফের উপরেই শুয়ে থেকে, তুষারাবৃত হতে হতে তুষারগর্ভে বিলীন হয়ে একদিন জীবাশ্মতে পরিণত হবে; নয়তো কোন মেরুপ্রাণীর খাদ্য হয়ে হজম হয়ে যাবে। তারপরেও তারা এভাবেই সাহসের সাথে বের হয় তাদের অগস্ত্য যাত্রায়, পরিবারের সদস্যদের কারও মাথার বোঝা না হয়ে তাদেরকে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে দিয়ে। বিষয়টি নিয়ে আমি আরেকটু ঘাঁটাঘাটি করে জানলাম, কয়েক শতক পূর্বে কোন এক দুর্যোগের সময়ে চরম খাদ্যাভাবের কারণে অপেক্ষাকৃত কম বয়স্করা যেন সঞ্চিত খোরাক থেকে অল্প অল্প করে কিছু খেয়ে পরে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে, সে লক্ষ্যে পরিপক্ক বয়সী ইনুইটরা স্বেচ্ছায় অনন্তের উদ্দেশ্যে তাঁবুত্যাগ করেছিলেন। তখন থেকেই ইনুইটদের মাঝে বয়স্কদের এ আত্মত্যাগ প্রথা প্রচলিত হয়। উত্তর প্রজন্মের জন্য পূর্বসূরী বয়স্ক নরনারীদের চরম আত্মত্যাগ সভ্যতার আলো ছড়ানোর অনেক আগে থেকেই মানুষের মাঝে প্রচলিত ছিল। একেই বলে রক্তের টান!
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ব্লগার শেরজা তপন
ঢাকা
০৯ জানুয়ারি ২০২৪
শব্দ সংখ্যাঃ ৫৩৪
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০