somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি অমলিন (১)

১৭ ই আগস্ট, ২০২৫ সকাল ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(ইহাকে বলা চলে, একটি প্রাগৈতিহাসিক পোস্ট। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে এর কিছু কথা বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কথাগুলো ১৯৬২-৬৭ সালের দিকের আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা।)

খুব ছোটবেলা থেকেই (৭/৮ বছর) আমাদের বাসায় কোন অতিথি এলে আমি খুব খুশি হ’তাম। আমরা যেহেতু ঢাকায় থাকতাম, দেশের বাড়ি থেকে কোন আত্মীয় স্বজন ঢাকায় কোন কাজে আসলে সাধারণতঃ আমাদের বাসাতেই উঠতেন। এতে আম্মার উপর অবশ্য বেশ চাপ পড়তো, সেটা বুঝতে পেরে আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আম্মাকে যথাসাধ্য কিচেনে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতাম। আম্মা খুশি হয়ে আমাকে সামান্য কিছু করণীয় বাৎলে দিয়ে খেলতে যেতে বলতেন। বয়স নির্বিশেষে আমি সকল অতিথির ন্যাওটা হয়ে যেতাম। আর সমবয়সী হলে তো কথাই নেই। তাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম পাড়া বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। মাঝে মাঝে বিকেলে নিয়ে যেতাম আমাদের স্কুলের মাঠে। সেখানে খেলাধুলার অনেক উপকরণ ছিল। প্রাণভরে খেলে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী সান্ধ্য আযানের সাথে সাথে ঘরে ফিরতাম।

মুরুব্বী অতিথিরা আমার নানারকমের প্রশ্নবান শুনে অবাক হয়ে যেতেন। তারা যথাসাধ্য সঠিক জবাব দেবার চেষ্টা করতেন। তথাপি আমি তাদের জবাবে মাঝে মাঝে ভুল ধরতে পারতাম। সমস্যা হতো তাদের বিদায় বেলায়। যেদিন ওনারা বিদায় নিতেন, সেদিন সকাল থেকেই আমার মন খুব খারাপ থাকতো। ওনাদের ব্যাগ গোছানোর সময় আমি তাদের পাশে ঘুরঘুর করতাম। এটা ওটা নেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিতাম। ওনারা ভালোবেসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। কেউ কেউ যাবার সময় আমার পকেটে কিছু নোট গুঁজে দিয়ে বলতেন, “কিছু কিনে খেও”। তখনও আমাদের বাসায় ছোটদের জন্য চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার প্রচলন শুরু হয় নাই। “কিছু কিনে খেও” এর মধ্যে তাই আমার পছন্দের শীর্ষে ছিল এক দৌড়ে পাড়ার মুদি দোকান থেকে কিনে আনা এক ঠোঙ্গা ‘মুরালি’।

ওনারা যাবার সময় আমিই রিক্সা ডেকে দিতাম। সেই রিক্সা দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত আমি অপলক সেই রিক্সাটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দৃষ্টির আড়াল হলে ভগ্নচিত্তে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে গত কয়েকদিনের স্মৃতি মন্থন করতাম। একই সমস্যা হতো যখন আমি (আমরা) প্রতি বছর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে প্রায় এক মাস নানাবাড়ি-দাদাবাড়িতে বেড়ানো শেষ করে নানিবাড়ি থেকে ঢাকা ফিরতাম। তখন পর্যন্ত সড়ক পথে আমাদের নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি যেতে খুব কষ্ট হতো, খারাপ রাস্তার কারণে। তাই আমরা সড়ক পথে বাড়ি যেতাম না, রেলপথেই যেতাম। সে কারণে রেল লাইন, রেলগাড়ি, পুরনো দিনের ভোঁশ ভোঁশ করা সাদা বাষ্প ও কয়লার গুঁড়া মিশ্রিত কালো ধোঁয়া উড়িয়ে কুউউ ঝিক ঝিক করে ছুটে চলা স্টীম ইঞ্জিনের দৃশ্য আমার মনে চিরস্থায়ীভাবে আসীন রয়েছে।

সে সময়ে লালমনিরহাট ছিল একটি বিরাট রেলওয়ে জংশন (এখনও আছে)। এখানে রেলওয়ে ডিভিশন সদর দপ্তর ছিল বলে রেলের বড় বড় অফিসারগণ বড় বড় এলাকা জুড়ে তাদের জন্য নির্মিত বাংলোতে বাস করতেন। ওনারা ট্রলিতে করে তাদের বাসস্থান থেকে লালমনিরহাট জংশনে অবস্থিত তাদের অফিসে যাওয়া আসা করতেন। লাঞ্চ ব্রেকে ট্রলিতে করেই বাসায় যেতেন আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ট্রলিতে করেই অফিসে ফিরতেন। কেবলমাত্র একটি লাইন ছিল বলে এক লাইনে আপ ও ডাউন দুটো ট্রলি চলে এলে যারা অফিসের দিকে যাবেন তারা অগ্রগণ্যতা পেতেন। স্টেশন থেকে বের হয়েই এ ব্যাপারে একটা বিরাট বিলবোর্ডে লেখা পরিষ্কার একটি নির্দেশনা আমার চোখে পড়তোঃ UP TROLLEYS WILL CUT FOR DOWN TROLLEYS। বড় সাহেবরা মটর ট্রলি ব্যবহার করতেন, ছোটরা বেহারা কর্তৃক ঠেলা ট্রলি। গরমের দিনে কাটাকাটির এই সামান্য সময়টুকুতে ক্লান্ত বেহারাগণ কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ পেতেন।

নানিবাড়ি ভিজিট করতে আমার খুব ভালো লাগতো, কারণ সেখানে আমাদের ভিজিট উপলক্ষ্যে অন্যান্য খালারাও সপরিবারে আসতেন। এতগুলো নাতি-নাতনি সামলাতে গিয়ে নানি রীতিমত হিমসিম খেতেন। তদুপরি তিনি সবসময় আমার উপর বিশেষ সযত্ন দৃষ্টি রাখতেন। কারণ, আমরা ছিলাম দূরে (ঢাকায়) এবং বছরে দুইবছরে একবার করে যেতাম। এজন্য আমাদের কদরটা ছিল একটু বেশিই। অন্যান্যরা থাকতো কাছাকাছি এবং তারা ঘনঘন আসতেন। আমার প্রিয় খাবার ঘন দুধের মোটা সর, নিজস্ব বাগানের শবরি কলা (আমাদের ওখানে বলে মালভোগ কলা) আর ইলিশ মাছের ডিম ও মোটা পেটি অন্যান্যদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে নানি আমার জন্য সংরক্ষিত রাখতেন এবং সুযোগ বুঝে আমাকে খেতে দিতেন। নানির ফোটানো দুধ থেকে এক ধরণের বিশেষ সুঘ্রাণ বের হতো। নানীর একটা সাদা রঙের গাভী ছিল। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঐ গাভীটির দুধ ছেঁকে আমাদেরকে খাওয়াতেন। নানা গাভী ছেঁকার সময় নানি পাশে দাঁড়িয়ে বাছুর সামলাতেন। নানির তোলা খাঁটি দুধের স্বরের উপর একটা হলদে রঙের আস্তরণ থাকতো এবং সেটা খেতে খুবই সুস্বাদু হতো। যেদিন ঢাকা ফিরে আসবো, তার একদিন আগে থেকে নানি খাওয়ার সময় একটি হাতপাখা দিয়ে আমার মাথায় বাতাস করতেন, আর কিছুক্ষণ পরপর মাথায় হাত বুলিয়ে ভগ্নস্বরে শুধু বলতেন, “ভাই, খাও!”

আমার নানি খুব নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন। তার নাম করিমা খানম। তিনি যেমন ক্ষিণাঙ্গী ছিলেন, তেমনি ছিলেন স্বল্পবাক। আমি অনুভব করতাম, তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু মুখে তিনি কখনোই তা প্রকাশ করতে পারতেন না। আমি খুব করে চাইতাম যে বিদায়ের সময় নানি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুক, কিন্তু সেটা করতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না, হয়তো লজ্জিত হতেন। তখনকার দিনে অনেক মুরুব্বী নানি-দাদীদেরকে দেখতাম, মেয়ে নাইওরি খেয়ে চলে যাবার সময় উচ্চঃস্বরে বিলাপ করতে করতে পাড়া মাতিয়ে দিতেন। আমার নানি চাইলেও সেরকম কিছু করতে পারতেন না, বুকে যতই কষ্ট গুমরে কাঁদুক। তার শোক প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ছিল কাছে এসে নীরবে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া আর তার সাদা শাড়ির কালো পাড় দিয়ে নীরবে নিজের চোখ মুছতে মুছতে চোখ লাল করে ফেলা। এটুকু লেখার পর আমি নিজেও চোখ না মুছে আর কিছু লিখতে পারছি না।

হাড়িভাঙ্গাস্থ আমার নানিবাড়ি থেকে লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনে যেতে হলে রিক্সায় অনেকটা পথ সোজা উত্তর দিকে যেতে হতো। “সদরের কাঁঠালের তল” নামে একটি জায়গায় এসে ঘন জঙ্গল শুরু হতো। সদর আলি নামের কোন এক কাঁঠালপ্রেমিক ব্যক্তির নামানুসারে ঐ জায়গাটি লোকমুখে এই নামে পরিচিত ছিল, কারণ সেখানে তার লাগানো একটি সুউচ্চ কাঁঠাল গাছ ছিল এবং সেই গাছের কাঁঠালগুলো অত্যন্ত সুমিষ্ট ছিল। সেই গাছের তলা বলে নাম হয়েছিল “সদরের কাঁঠালের তল”। তখন রাস্তার আশেপাশে কোন ঘরবাড়ি কিংবা ঝোপঝাড় ছিল না বলে নানিবাড়ি থেকে এই নাতিদীর্ঘ পথটুকুর পুরোটাতেই চলমান রিক্সাটাকে দেখা যেত। যতক্ষণ দেখা যায়, নানি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর আমিও বার বার রিক্সার হুডের পেছন দিক দিয়ে নানির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। “সদরের কাঁঠালের তল” পার হবার সাথে সাথে আমি হুডের পেছন থেকে দৃষ্টিটাকে ফিরিয়ে এনে রিক্সার সামনে মেলে ধরতাম। পেছনের মায়ার বাঁধন ভুলে সম্মুখের বাস্তবতার দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করতাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম, আম্মার চোখও অশ্রুসিক্ত, কারণ হৃদয় ভারাক্রান্ত। আমি শুনেছি, ভালোবাসার দৃষ্টিও নাকি এক ধরনের দোয়া। যদি তাই হয়, তবে আমি আমার জীবনে নানির অনেক দোয়া পেয়ে ধন্য হয়েছি বলে আমার বিশ্বাস। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন আমার নানা-নানিকে ক্ষমা করুন এবং তাদের উভয়কে জান্নাত নসীব করুন!

ঢাকা
১৭ অগাস্ট ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ৯৭৬

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৪:০১
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×