somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীল জল শৈশব-৭ (শেষ)

২৪ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Click This Link

দবিয়ল, বাসা ঘোরে কেন ?

আমাদের বাসায় রবিউল নামের এক গৃহকর্মী ছিলো। কাজের ফাঁকে আমাকে দেখাশোনা করা বিশেষত: বাইরে ঘুরাতে নেয়া তার কাজ ছিলো। তাই তার সাথে আমার বেশ খাতিরও ছিলো। একদিন আমাকে বেলুনসহ একটা বাঁশি কিনে দেয়া হলো। আমি মনের আনন্দে সেই বাঁশি ফুলাচ্ছিলাম। আর পোঁ পোঁ শব্দে বেশ আনন্দও প্রকাশ করছিলাম। এক সময় অনেক্ষণ একটানা বাঁশি বাজানোর দরুন আমার মাথা ঘোরাতে শুরু করে। আমার মনে হচ্ছিলো পুরো বাসাই বুঝি ঘুরছে। মাথা চক্কর খাওয়ার মাজেজাতো তখনো জানিনি। তাই পাশে কর্মরত রবিউলকে বললাম, দবিয়ল, ও দবিয়ল, বাসা ঘোরে কেন রে ? বলেই পড়ে গেলাম মেঝেতে। তারপরতো দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো আমাকে নিয়ে।

কড লিভার অয়েল

কী কারণে আমার অসুখ হলে ডাক্তার আমাকে একটা ক্যাপসুল খেতে দিলেন। তৈলাক্ত। স্বচ্ছ্ব খোলের ভেতর সয়াবীন তেলের রঙের তরল পদার্থ দেখা যেত। এটা নাকি কড মাছের লিভারের তেল দিয়ে তৈরী ( কড লিভার অয়েল)। কী বিকট গন্ধ আর বিস্বাদ ছিলো সেটা বলার মতো না। প্রতিদিন নিয়ম করে সেই অখাদ্য ক্যাপসুল আমাকে গেলানো হয়েছে। বমি করেও রেহাই পাইনি। আবার গেলানো হয়েছে। সেই কালের ডাক্তাররাও খুব ডাকসাইটে ছিলেন। জোর করে হলেও তাঁদের বিধানমতো রোগীকে ওষুধ খেতে বাধ্য করতেন।

খাটের তলের পাঠক

আমাদের বাসায় পত্রিকা রাখা হতো ২টি।একটি দৈনিক অন্যটি মহিলাদের ম্যাগাজিন ''বেগম''। প্রথমে রাখা হতো দৈনিক আজাদ। পরে দৈনিক ইত্তেফাক। ওসব ভারী ভারী দৈনিকে আমার কোন শিশুতোষ আগ্রহ ছিলো না। সব আগ্রহ ছিলো ''বেগম'' ঘিরে। কারণ ওতে প্রচুর ছবি ছাপা হতো। হকার কাগজ দেবার পর ''বেগম'' দেখলেই ওটা নিয়ে চুপিচুপি খাটের নীচে ঢুকে যেতাম। তারপর খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি দেখতাম। আম্মা যখন দেখতেন আমার কোন সাড়াশব্দ নাই কিংবা আমাকে আম্মার আসেপাশে দেখা যাচ্ছে না তখন বুঝতেন হকার ''বেগম'' দিয়েছে। অবধারিত ভাবেই ''বেগম'' এবং তার পাঠককে খাটের তলে পাওয়া যাবে।

সুস্বাদু মহিষা দই !?

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষত: চরাঞ্চলে মহিষের দুধের দই খুবই জনপ্রিয় ও দামী। সবাই একে ''মহিষা দই'' বলে। মাটির পাত্রে পাওয়া যায়। চিনি দেয়া হয় না। খুবই টক ও তৈলাক্ত। শুরুতে এক প্যারাগ্রাফ সুনাম করে আমাকে ভাতের সাথে মহিষা দই মেখে খেতে দেয়া হলো। আমিও ওবিডিয়েণ্ট পিউপিলের মতো গপাগপ দু'তিন গ্রাস মুখে পুরলাম। সম্বিত ফিরতেই মুখের মানচিত্র দ্রুত বদলে গেলো। এবং অবিলম্বে বমি করে সুস্বাদু মহিষা দইযুক্ত ভাত বিশ্বজননীর বুকে ফিরিয়ে দিলাম। ( চুপিচুপি বলে রাখি, আমিই এখন গ্রামের বাড়ীতে গেলে মহিষা দইয়ের সন্ধান করি।)

বিদায় হাতিয়া ! বিদায় নীল জল !

১৯৬৮ সালে আব্বা হাতিয়া থেকে বদলী হয়ে মূল ভূখণ্ডে ফিরে এলেন। আমরাও হাতিয়াকে গুড বাই জানিয়ে চলে এলাম সোজা গ্রামের বাড়ীতে। অবশ্য আব্বা বাড়ী থেকে দূরবর্তী কর্মস্থলে একাই থাকতে শুরু করলেন। সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ী আসতেন।

হাতিয়া থেকে লোক দিয়ে জলপথে সব মালামাল পাঠানো হলো। আমরা আসার কথা ছিলো হেলিকপ্টারে। কিন্তু এক সপ্তাহের ব্যবধানে দু'টি হেলিহপ্টার বিধ্বস্থ হওয়ায় সেই যে হেলিকপ্টার সার্ভিস বন্ধ হলো। আর কোন দিন সেই সার্ভিস চালু হয়নি। একটা হেলিকপ্টার বিধ্বস্থ হয়েছিলো খারাপ আবহাওয়ার জন্য, আরেকটা বিধ্বস্থ হয়েছিলো উড়ন্ত শকুন বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে। অগত্যা জলপথেই ফিরে এলাম নিজ বাসভূমে। নীল জলে দুলতে দুলতে নীল জলকে বিদায় জানিয়ে এলাম। কিন্তু নীল জলেরা সেই বিদায়ের ভিন্ন মানে বুঝেছিলো। আমার শৈশবের স্মৃতিময় সব মাটি সেই নীল জল একে একে উদরস্থ করে ফেলেছে। আর কোন দিন আমি চাইলেও শৈশবের প্রিয় মাটি আর ছুঁতে পারবো না। আসার সময় টুটু আর শম্পাপা নৌকা ঘাট পর্যন্ত এসেছিলো। টুটুর জন্য তেমন কিছু মনে হচ্ছিলো না। টুটুও ছিলো চুপচাপ। সেই দার্শনিক মনে হয় জীবনের অনিত্যতার তত্ত্ব ল্যাংটা বেলাতেই বুঝে গিয়েছিলো। বুঝতে পারেননি শম্পাপা। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি আর তখন পিচ্চি দার্শনিক টুটুর দলে নির্মোহভাবে থাকতে পারলাম না। শম্পাপার দলে যোগ দিয়ে ভেউভেউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। (অথচ কলেজ বেলায় শম্পাপা আর আমি আবার দার্শনিক হয়ে উঠেছিলাম। ছোট বেলার সেই কান্না নিয়ে প্রায়ই দুজনে হাসাহাসি করতাম।)

এখনো খুব একা হয়ে গেলে শৈশবের নীল জলের ডাক শুনতে শুরু করি। জানি না নীল জল আমার কোন ডাক শুনতে পায় কি না।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:৫৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×