আগের পর্ব - Click This Link
ঢা.বি. সাংবাদিকতা বিভাগ: অনেক তারার ঝলকানি !
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিলিমিনারীতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম বাংলা, ইংরেজী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সে পর্যায়ে তখনো বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতি চালু ছিলো। ৫টি বিষয়েই টিকে গেলাম। আমাদের সেকালে সাধারণের চেয়ে সামান্য একটু এগিয়ে থাকলেই টিকে যাওয়া সম্ভব ছিলো। যেমন চাকরীর পরীক্ষা। ৫টি চাকরীতে পরীক্ষা দিয়েছি। সব কটিই পেয়েছি।
৫ বিভাগে টিকে বিপদে পড়লাম। কোনটায় ভর্তি হই। আমার পছন্দ ছিলো বাংলা। বাবা মা চাচ্ছিলেন আমি ইংরেজী বা অর্থনীতিতে পড়ি। কিন্তু আমার সেটা পছন্দ না। ছোট বেলা থেকে নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিলো বলে ওর প্রতি একটা অঅকর্ষণ ছিলো। তাই ব্যতিক্রমী বিষয় হিসাবে সাংবাদিকতাকেই পছন্দ করলাম। এখন মনে হয় এটা আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তগুলোর একটা। এটা আসলেই খুব আকর্ষণীয় বিষয়। যে চারটি বিষয়ে টিকেও ভর্তি হইনি সে চারটি বিষয় (বাংলা, ইংরেজী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি) সাংবাদিকতা বিভাগে বেশ বড়ো অংশই পড়তে হয়েছে। অর্থাৎ টিকে যাওয়া পাঁচটি বিষয়েএকত্রে পড়েছি আমি। এ বিষয় পড়লে চাকরীর ইন্টারভিউতে ঠেকানো মুশকিল। দেশ বিদেশের বর্তমান অতীত পরিস্থিতি, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, পরিসংখ্যান- কি নেই সিলেবাসে ? গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার নিজস্ব বিষয়তো আছেই।
আমাদের কালে বিভাগের নিজস্ব শিক্ষক ছাড়াও অন্যবিভাগের শিক্ষক এবং সাংবাদিকতার শীর্ষ পর্যায়ের অনেক খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিভাগে এতো তারকা শিক্ষকের উপস্থিতি ছিলো না। ভবিষ্যতেও থাকবে বলে মনে হয় না। কারণ সাংবাদিকতা বিভাগে এখন নিজস্ব শিক্ষকই বেশী। খণ্ডকালীন খুব বেশী নেই।
অধ্যাপক ক.আ.ই.ম. নূর উদ্দিন
তৎকালীন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালে ঢাকা ও লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ খোলা হয়। লাহোরে চালু হবার কয়েক বছরের মধ্যে বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। (পরে আবার চালু হয়) কিন্তু ঢাকারটি টিকে যায় প্রথমত এদেশে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষার পথিকৃত অধ্যাপক আতিকুজ্জামান খান এবং তার শিষ্য ক.আ.ই.ম. নূর উদ্দিনের উন্মত্ত ভালোবাসাভরা শ্রম আর নিষ্ঠার জন্য। শুরুতে ছিলো সান্ধ্যকালীন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা। ১৯৭০ সালে চালু হয় প্রিলিমিনারী ও মাস্টার্স কোর্স। ১৯৭৬-৭৭ শিক্ষা বর্ষে এই উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম অনার্স কোর্স চালু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনই সাংবাদিকতা বিভাগের নাম হয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। ৩১ বছর একা পথ চলার পর এ বিভাগের সাথী জুটতে শুরু করে বাংলাদেশে। ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষা বর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ বিভাগ চালু হয়। ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় গণযোগাযোগও সাংবাদিকতা বিভাগ। এখন বেসরকারী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিভাগ আছে। পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য আছে প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এই ভূমিকাটুকু অত্যাবশ্যক এদেশে সাংবাদিকতা শিক্ষার সূচনা ও বিকাশে আতিকুজ্জামান খান ও নূর উদ্দিন স্যারের অবদান অনুধাবনের জন্য। জনসংযোগ ও বিজ্ঞাপন (যোগাযোগ আঙ্গিকে) শিক্ষায়ও নূর উদ্দিন স্যার পথিকৃত।
আমরা আতিকুজ্জামান খানকে পাইনি। কিন্তু নূর উদ্দিন স্যারকে পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্যারের স্নেহধন্য। এটাকে আমার বিরল সৌভাগ্য বলে গন্য করি। স্যারকে ডাকা হতো বর্ণমালা নূর উদ্দিন। নামের আগের বর্ণমালার দীর্ঘ সারির জন্য- ক.আ.ই.ম. মানে কাজী আবু ইমাম মোহাম্মদ নূর উদ্দিন। আমি যখন ভর্তি হই স্যারই তখন চেয়ারম্যান।
তিনি আমাদের পড়াতেন জনসংযোগ, গনযোগাযোগ তত্ত্ব আর বিজ্ঞাপন। আজ সরকারী বেসরকারী অফিসে জনসংযোগের যে বিশাল সেট আপ তার পেছনে নূর উদ্দিন স্যার আর তাঁর ছাত্রদের অবদান আছে। জনসংযোগের প্রধান মানুষদের বেশীরভাগ স্যারের ছাত্র/ছাত্রী। স্যারের পাশাপাশি রাষ্টবিজ্ঞানের প্রফেসন ড. শামসুল হুদা হারুনও জনসংযোগ পড়াতেন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে। ড. হারুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জনসংযোগে মাস্টার্স করেছিলেন।
বিজ্ঞাপনের ক্লাসে আমাদের পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেডিও ও টিভির জন্য নানা ধরনের বিজ্ঞাপন তৈরীর বিষয়, পোস্টার লিখন, লিফলেট লিখর ইত্যাদি পড়ানো হয়েছে। নূর উদ্দিন স্যার আর সেলিম স্যার এসব পড়াতেন। বাংলাদেশে আধুনিক মননশীল বিজ্ঞাপন লিখনেও নূর উদ্দিন স্যার পথিকৃত। বহুজাতিক কোম্পানীসহ বড় বড় অনেক কোম্পানীর জন্য বিজ্ঞাপন লিখেছেন স্যার। যাকে বলা হয় কপি রাইটং। স্যার ক্লাসে গল্প করেছিলেন। বাংলাদেশ বিমানের জন্য কপি লিখনের জন্য সত্তরের দশকে স্যারকে ১৫ না ২০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয়েছিলো। বিমানের বিখ্যাত বিজ্ঞাপন আকাশে মান্তির নীড় আর ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী নূর উদ্দিন স্যারের লেখা বলে আমরা শুনেছি।
বিভাগের প্রতি নূর উদ্দিন স্যারের মমতা ছিলো বিস্ময়কর। ভোর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত স্যার বিভাগের নানা কাজে মজে থাকতেন। এসব নিয়ে তাঁর সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের বিস্ময়ের শেষ ছিলো না। এ নিয়ে অনেকে মজাও করতো। স্যারের স্ত্রী ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী। স্যারের মেয়েকেও দিখেছি। এক কথায় অপরূপা। আমরা বলতাম দম বন্ধকরা সুন্দরী। সামনে পড়লে নি:শ্বাস ফেলার কথাও ভুলে যাবার দশা হতো। সবাই বলতো স্যার এমন সুন্দরী বউ ফেলে ডিপার্টমেন্টে পড়ে থাকেন কি করে !
অবসরগ্রহণের পর স্যার কিছুদিন সূপার নিউমারারী প্রফেসর ছিলেন। বর্তমানে স্যার বেঁচে নেই। স্যারের রুহের মাগফিরাতা কামনা করছি।
(চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



