somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রক্তে ভেজা ভাষার মহিমা

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খগ সমঝহি খগকি ভাষ


বর্তমান পৃথিবীতে ভাষাবৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে। কারণ প্রচলিত অনেক ভাষাই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। পৃথিবীতে কতগুলো ভাষা প্রচলিত আছে তা বলা মুশকিল। কারণ ভাষা আর উপ-ভাষার জটিলতায় ভাষার আসল সংখ্যা বলা কঠিন। পণ্ডিতদের মতে দুনিয়াতে ৫ থেকে ৭ হাজার ভাষা আছে। একটি হিসাব মতে আফ্রিকা অঞ্চলে ২০৯২ টি, দুই আমেরিকা মহাদেশে ১০০২টি, এশিয়ায় ২২৬৯টি, ইউরোপে ২৩৯টি আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩১০টি একুনে ৬৯১২টি ভাষা প্রচলিত আছে। (http://www.ethnologue.com) এদের হিসাবে পৃথিবীর ৪০ ভাগ মানুষ মাত্র ৮টি ভাষার যে কোন একটিতে কথা বলে (ম্যান্ডারিন, হিন্দী, স্পেনিশ, ইংরেজী, বাংলা, পর্তুগীজ, আরবি ও রাশান) অন্যদিকে ৪ হাজারটি ভাষা ব্যবহার করে মাত্র ২ ভাগ লোক। ব্যবহারকারীর অভাবে ৫১৬টি ভাষা অচিরেই বিলুপ্ত হবার পথে, কারণ অল্পকিছু বয়স্ক মানুষ এ ভাষাগুলোয় কথা বলছেন। এটা ভাষার একটা বড়ো সমস্যা। কিন্তু যে ভাষায় কথা বলার লোকের অভাব নেই সে ভাষারও বিপদের কমতি নেই। সেসব বিপদ আসে রাষ্ট্র বা সমাজ থেকেই। তাই যুগে যুগে ভাষার বিপদে ভাষার পাশে দাঁড়িয়েছেন মানুষ। কখনো পথে নেমেছেন, ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষায় উন্নীত করতে আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে দুই দফায়। একবার ১৯৫২ সালে, আরেকবার ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে বাংলা ভাষাকে প্রকৃত মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে। রক্তে ভেজা এ ভাষার মহিমার শেষ নেই। ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনায় বাংলা ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাসমূহের পাশে অতিউচ্চ মর্যাদা পাবার দাবী রাখে।

ভাষা কি ?

ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ”মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনি-সকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তাহার নাম ভাষা (Language) ।” - বাঙ্গালা ব্যাকরণ,১৯৩৬

ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ” মনের ভাব-প্রকাশের জন্য, বাগ্-যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনও বিশেষ জন-সমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্র-ভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দ-সমষ্টিকে ভাষা বলে।”-ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ,১৯৩৯

ড.মুহম্মদ এনামুল হকের বিবেচনায়,”মানুষ তাহার মনের ভাব প্রকাশ করিবার জন্য কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, ওষ্ঠ, দন্ত, নাসিক্য, মুখ-বিবর প্রভৃতি বাগ্-যন্ত্রের সাহায্যে অপরের বোধগম্য যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির উচ্চারণ করিয়া থাকে, সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি ভাষা বলা হয়।”-ব্যাকরণ মঞ্জুরী,১৯৫২

রাজা রামমোহন রায়ের ’গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ’ব্যাকরণ কৌমুদী’র পরে উপর্যুক্ত তিন মনীষীর ব্যাকরণ তিনটিই বর্তমান বাংলা ব্যাকরণের ভিত্তি তৈরী করেছে। তিনটি সংজ্ঞাতেই মানুষের মুখের ভাষাকেই ভাষার সংজ্ঞায় প্রধান উপকরণ বিবেচনা করা হয়েছে। লিপি আবিষ্কারের পর মুখের ভাষা লিখিত রূপ পেয়েছে। তবে এখনো বহু ভাষা আছে যার কোনো লিখিত রূপ নেই। মুখের কথায় তার অবস্থিতি। বাংলাদেশেই অনেক গুলো (একটি মতানুসারে ৪৬টি) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আছে । এর মধ্যে চাকমা,মারমা, মনিপুরীসহ কয়েকটি ছাড়া অন্যদের ভাষার লিখিত রূপ নেই। পৃথিবীর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সব দেশেই এ রকম অনেক মুখের ভাষার অস্তিত্ব আছে যাদের কোন লিপি নেই।

আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণও বিশ্বাস করেন ভাষা ব্যবস্থার মূল হচ্ছে মুখের ভাষা তথা ধ্বনিসমষ্টি। লেখার বিষয়টি পরের। কাঠামোবাদী ভাষাতাত্ত্বিকরা বিশেষত: ফার্ডিনান্ড ডি সস্যুর, রল্যাঁ বার্থ প্রমুখ তাঁদের ভাষা দর্শনে মুখে উচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টিকে গুরুত্বসহ গ্রহণ করেছেন। রলাঁ বার্থ ভাষাব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে ভাষার মূল উপাদান হিসাবে কিছু ’অনুধ্বনি’ বা Phoneme-কে নির্ধারণ করেছেন, যা মানুষকে অর্থ যোগান দিতে পারে। এর মাধ্যমে ভাষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। জাক লাকাঁর ভাষাদর্শন অনুযায়ী মানুষ আর সমাজের মধ্যে সম্পর্ক গঠনের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা-দার্শনিক নোয়াম চমস্কির মতে, মানুষ সংখ্যাহীন বাক্য সৃষ্টিতে সক্ষম। মানুষের এ সৃজনশীলতার ওপর ঈমান রেখে তিনি তাঁর রূপান্তরমূলক সৃজনশীল ব্যাকরণ তৈরী করেছেন। মানুষের ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা ও প্রয়োগ সামর্থ্য তাঁর ধারণার কেন্দ্রে অবস্থান করে। তাঁর বিবেচনায় ’ভাষাজ্ঞান’ হচ্ছে একটি ভাষায় অসংখ্য বাক্যে ভাষার অন্তর্গন্থনা সংযোজন এবং তাৎপর্যগত ও ধ্বনিগত ব্যাখ্যা প্রদান ক্ষমতা। চমস্কিও মুখের কথার ওপর জোর দিয়েছেন। সেটাকে ধ্বনিগতভাবে ব্যাখ্যা করেন।

মানুষের ভাষা ’মুক্ত ভাষা’ যা সংখ্যাহীন বাক্য সৃষ্টিতে সক্ষম। মানুষ কথা সৃষ্টি করতে পারে অর্থাৎ বলতে, শুনতে ও বুঝতে পারে। ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ভাষা শিখতে হয়। মানব শিশু কোন ভাষা নিয়ে জন্মে না। সে বড়োদের বিশেষত: মায়ের কাছে শুনে শুনে ভাষা শিখে ফেলে। সেটাই (মায়ের কাছে শেখা বলে) তার মাতৃভাষা।

ব্যবহারিক জীবনে এখন ভাষাদক্ষতা নির্নয়ে মানুষের পঠন, লিখন, শ্রবণ ও কথা বলার (Reading, Writing, Listening & Speaking) দক্ষতাকে বিবেচনা করা হয়।

ভাষার কথা

ভাষার বয়স কতো তা বলার উপায় নেই। তবে সভ্যতা আর ভাষার ইতিহাস পরষ্পর সম্পর্কিত। পূর্ব আফ্রিকায় আবিষ্কৃত প্রস্তর উপাদান থেকে অনুমান করা হয় মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস ২০ লাখ বছরের। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আলোকে ভাষার বয়স ১০ লাখ বছর হলেও এর বিবর্তনের ইতিহাস পাওয়া যায় না। ভাষার নির্ভরযোগ্য ইতিহাস মাত্র ৫ হাজার বছরের। পৃথিবীতে এতো ভাষা থাকলেও গবেষকরা দেখিয়েছেন অল্প কয়েকটি ভাষা থেকেই এতো ভাষার উৎপত্তি। পণ্ডিতরা ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ইউরোপের অধিকাংশ এবং নিকট প্রাচ্য ও ভারতবর্ষের অনেকগুলো ভাষা পরষ্পর সম্পর্কিত। ঐ সম্পর্ক ভাষাগুলোর সাংগঠনিক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে স্থির করা হয়েছিলো। ফলে তারা যে একটি অভিন্ন প্রাচীন ভাষা থেকে উদ্ভুত তা বোঝা যাচ্ছিলো। এ প্রাচীন ভাষার তারা নাম দিয়েছিলেন ইন্দো-ইউরোপিয়ান। খ্রীস্ট জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে উদ্ভুত হয়ে যে ভাষা একদিকে ইউরোপে এবং অন্যদিকে পারস্য ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম অবস্থায় পারস্য ও ভারতবর্ষে আগত ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষার দুটি শাখার মধ্যে এতই সাদৃশ্য ছিলো যে তাদের ইন্দো-ইরানিয়ান বলা হতো। কালের বিবর্তনে পারস্য ও ভারতবর্ষে আগত ভাষার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটে। ইরানিয়ান শাখার আধুনিক বিবর্তন ফারসী। ভারতবর্ষে আগত ইন্দো-ইউরোপিয়ান বা ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার নাম ইন্দো-আর্যভাষা। আর্য-ভাষার প্রাচীন রূপ বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষায়, মধ্য রূপ পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় আর আধুনিক রূপ পাঞ্জাবী, সিন্ধী, রাজস্থানী, মারাঠী, গুজরাটী, সিংহলী, হিন্দী-উর্দু বা হিন্দুস্থানী, উড়িয়া, বাংলা, অহমিয়া ইত্যাদি ভাষা। প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাষার সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় লিথুনিয়ান ও লেটিশ নামক এক জোড়া উত্তর-মধ্য ইউরোপীয়ান ভাষার। এ দুটি ভাষা নিয়ে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর বাল্টিক শাখা গঠিত। বাল্টিকের প্রতিবেশী ভাষা স্লাভিক। এই স্লাভিক ভাষার শাখাগুলো পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়ানো। পোলিশ,চেক,স্লোভাক ভাষা নিয়ে পশ্চিম স্লাভিক; বুলগেরিয়ান, সার্বো-ক্রোশান নিয়ে দক্ষিণ স্লাভিক এবং বলকান রুশ ভাষা নিয়ে পূর্ব স্লাভিক উপশাখা গঠিত। ইন্দো-ইরানিয়ান ও আর্য, বাল্টিক এবং স্লাভিক শাখা নিয়ে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর শতম শাখা গঠিত।

ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হেলেনিক, পুরাতন এথেন্স নগরীর সভ্যতার ভাষা এটিক এ-ভাষারই অন্তর্গত। হেলেনিক শাখার গ্রীক ভাষা দীর্ঘদিন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যোগাযোগের বাহন ছিলো। সাহিত্য ও সভ্যতার বাহন হিসাবে গ্রীক ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। এ গোষ্ঠীর আরেকটি গুরুত¦পূর্ণ ভাষা প্রাচীন ইটালীর ভাষা কয়েকটি উপভাষা যেমন, ওসকান, উমব্রিয়ান, ল্যাটিন ইত্যাদিও সমন্বয়। রোমান সাম্রাজ্যের সরকারী ভাষা ছাড়াও শিল্প সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাষা হিসাবে ল্যাটিনের খ্যাতি কিংবদন্তীতুল্য। রুমানিয়া, ইতালী, পর্তুগীজ, স্পেন, ফ্রান্স-এর ভাষা রোমান শাখাভুক্ত। স্পেনিশ ভাষা দক্ষিণ বা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আর পর্তুগীজ ভাষা ব্রাজিলে বিস্তৃত।

ইন্দো-ইউরোপিয়ান গোষ্ঠীর জার্মানিক শাখাও বহুল বিস্তৃত। আইসল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে,ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম,সুইজারল্যান্ড, জার্মানী ও অস্ট্রিয়াতে এ শাখার ভাষাগুলো জাতীয় ভাষা। ইন্দো-ইউরোপিয়ান গোষ্ঠীর কেল্টিক শাখা এক সময় চেকোস্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ জার্মানী, উত্তর ইতালী, ফ্রান্স এবং বৃটিশ দ্বীপপূঞ্জে চালু ছিলো। আজো এ ভাষার প্রভাব আছে আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল, স্কটল্যান্ডের উচ্চ ভূমি, ওয়েলস এবং ফ্রান্সের ব্রিটানিতে। ইন্দে-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর আলবেনিয়ান ও আর্মেনিয়ান এ দুটি শাখা এখনো জীবিত। কিন্তু হিট্টি মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ইন্দো-ইউরোপিয়ান গোষ্ঠী বহির্ভূত ফিনিশ, ইস্তোনিয়ান আর হাঙ্গেরিয়ান ভাষা ফিনো শাখাভুক্ত। ল্যাপিস, পারসিয়ান আর উত্তর সাইবেরিয়ার স্যাময়েড ভাষা উগ্রিক শাখাভুক্ত। বাস্ক ভাষা স্পেন ও ফ্রান্সে প্রচলিত।

অন্যদিকে সেমেটিক ভাষা এশিরিয়ান ও ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতার বাহন ছিলো। বাইবেলের পুরাতন টেস্টামেন্টের ভাষা হিব্রু সেমেটিক শাখার। আরবীও সেমেটিক ভাষা। হামিটিক ভাষা প্রাচীন মিশরে, আধুনিক হামিটিক ভাষা উত্তর ও মধ্য আফ্রিকায় প্রচলিত। ইথিওপিয়ার আবিসিনিয়ার ভাষা এ শাখাভুক্ত। মধ্য এশিয়ার আল্টাই পার্বত্য অঞ্চল থেকে উদ্ভুত আল্টাইক ও পোলিও-সাইবেরিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত তুরস্কের তুর্কি এবং মঙ্গোল ভঙ্গুজ ভাষা। সাইবেরিয়ার উত্তর-পূর্বের ইয়াকুত ভাষা, সাইবেরিয়ার দক্ষিণ- পশ্চিমের কাজাক, উজবেক এবং তুর্কমেন ভাষাও এ শাখার অন্তর্গত।

চীনা ভাষা সিনো টিবেটান ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান ভাষা। অবশ্য চীনা ভাষার নানা ধরণ আছে। এক অঞ্চলের লোক অন্য অঞ্চলের কথা বুঝতে পারেন না। তবে লেখ্যরীতি এক হওয়ায় সবাই সবার লেখা বুঝতে পারেন। তিব্বতী ও বার্মিজ ভাষা বংশগতভাবে চীনা ভাষাগোষ্ঠীর অংশ। এ সব ভাষা ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীনের মধ্যাঞ্চলে প্রচলিত। এর সাথে কোরিয়ান ভাষার মিল আছে। লিখন প্রণালীতে চীনা ভাষার সাথে জাপানী ভাষার কিছু সাদৃশ্য থাকলেও জাপানী ভাষার ইতিহাস আলাদা।

মালয় পলিনেশিয়ান ভাষা মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউ জিল্যান্ড এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রচলিত। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ভাষা ভিন্ন গোত্রের। ভারতে আর্য ভাষা বহির্ভূত ভাষাগোষ্ঠী হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী। তামিল, তেলেগু, কানাড়া, মালয়লাম এ শাখার ভাষা। ককেশাস ভাষা ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত। জর্জিয়ান ভাষা এ গোত্রের।

উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার গিনি উপসাগরের বিস্তৃত অঞ্চলের বহু ভাষা সুদানিজ-গিনি শাখাভুক্ত। মধ্য আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলের ভাষাগুলো বান্টু শাখাভুক্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার আঞ্চলিক ভাষাগুলো থেইন নামে পরিচিত। এর দুটি শাখা- বুশম্যান ও হটেনটট।

উত্তর আমেরিকার কানাডা থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের আদিবাসী রেড ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত অসংখ্য ভাষা ৬টি শ্রেণীতে বিন্যাস্ত। এস্কিমো-এলিউশিয়ান শাখা এলিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর কানাডা এবং গ্রীণল্যান্ডে প্রচলিত। এলগোনকুইন-ওয়াকাশ শাখা দক্ষিণ কানাডা ও উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত ছিলো। হোকা-সিউ শাখা উত্তর আমেরিকা থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত। না- দেনে শাখা পশ্চিম কানাডা ও আমেরিকার পশ্চিম উপকলের ভাষা। পেনুশিয়া শাখা বৃটিশ কলম্বিয়া, ওরিগন এবং কালিফোর্নিয়া অঞ্চলের ভাষা। উটো-আজটেক শাখা পশ্চিম আমেরিকা, মধ্য মেক্সিকো এবং পানামা পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এ গোষ্ঠীর নাহুয়াটল ভাষা আজটেক সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিলো। দক্ষিণ মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভাষা মায়া-সোকো ছিলো মায়া সভ্যতার ভাষা। আরওয়াক শাখা এন্টিলেসে প্রচলিত ছিলো, যা এক সময় দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চল জুড়ে প্রচলিত ছিলো। কারিব ছিলো আমাজনের উত্তরাঞ্চলের ভাষা আর কিচুয়া ছিলো পেরুর ইনকা সভ্যতার ভাষা।

বিশ্বের এ ভাষাবৈচিত্র্য কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে, কিছু ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে, কিছু ভাষা বিস্তৃত হয়েছে। এক ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ যখন অন্য ভাষাভাষী অঞ্চল দখল করেছে তখন বিজয়ীর ভাষা বিজিত অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, বিজিতের ভাষা বিলুপ্তির শিকার হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস কোন ভাষার আনন্দ আর অনেক ভাষার বেদনার ইতিহাস। ভাষার সাথে সংস্কৃতি আর আর্থ-সামাজিক অবস্থার সম্পর্ক নিবিড়। তাই ভাষা রক্ষার সংগ্রাম মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে।

যুগে যুগে ভাষার আগ্রাসন আর ভাষার লড়াই

ভাষাতাত্ত্বিকগণ গবেষণার আলোকে বলছেন, একই ভাষাভাষি মানুষ যখন জীবনের প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়েছে তখন কালের বিবর্তনে ভাষায় ভাষায় পার্থক্য তৈরী হয়ে গেছে। কিছু কিছু মিল থেকে গেছে এককালে যে এক ভাষা ছিলো তার চিহ্ণ হিসাবে। সে পার্থক্যকে মানুষ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাই নিজের ভাষার প্রশ্নে মানুষ চিরকাল ভালোবাসা দেখিয়ে আসছে। তাতে আবেগের সাথে ভাষা ব্যবহারের আপেক্ষিক সুবিধাও জড়িয়ে গিয়েছে। সে জন্য কেউ কারো ভাষা ব্যবহার করতে চায় না। কিন্তু এক জাতি আরেক জাতির ওপর ভাষা চাপিয়ে দিয়েছে বারবার। তাই মাতৃভাষা বাঁচিয়ে রাখার লড়াইও চলেছে ঐতিহাসিক কাল ধরে। কোন জাতি যখন আর্থিক আর সামরিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ওঠে তখন সে জাতি পাশের দেশ দখল করে সাম্রাজ্য বাড়াবার লোভে পড়ে যায়। সে অভিযানে ব্যবসা বাণিজ্য প্রধান বাহন হলেও ভাষা সংস্কৃতির জোরালো আধিপত্য তৈরী করে। প্রাচীন মায়া, ইনকা বা আজটেক সভ্যতার পরিধি সীমিত ছিলো বলে ভাষাভিত্তিক আধিপত্যের সংবাদ খুব বেশি মেলে না। গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলোর পারষ্পরিক যোগাযোগ ভাষাগত ঐক্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রীক ভাষার উন্নত কাঠামো গ্রীক সামরিক শক্তির মতোই প্রবল প্রতাপশালী ছিলো তা সহজেই ধারণা করা যায়। তবে মেসিডোনিয়ার সম্রাট দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্ডার দা গ্রেট তাঁর সাম্রাজ্যে ( ভূমধ্য সাগরের পূর্বাঞ্চল ও এশিয়া মাইনর) গ্রীক ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময়ে অন্য ভাষাভাষীরা মাতৃভাষার অস্তিত্ব বজায় রাখার সংগ্রামে নেমেছিলেন কিনা তার হদিশ মেলে না।

ভাষার বাবদে ব্যাপক আধিপত্য বিস্তারে সফল হওয়া প্রথম পরাশক্তি রোমানরা। রোমান সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা ছিলো ল্যাটিন। সকল যোগাযোগ, শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য.ধর্ম সব কিছুর বাহন ছিলো ল্যাটিন। ল্যাটিনের দাপটে ইউরোপের বাকী সব ভাষার নাভিশ্বাস উঠে যায়। ইউরোপের অন্যান্য ভাষা আলাদাভাবে বিকশিত হলেও ল্যাটিন প্রভাব থেকেই যায়। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত ল্যাটিন ছিলো বিজ্ঞানচর্চার অপরিহার্য ভাষা। ইংরেজীসহ ইউরোপের প্রায় সব ভাষার বর্ণমালার ভিত্তি তৈরী হয়েছে রোমান বর্ণমালা থেকে। ফরাসী, স্পেনিশ, ইতালিয়ান, পর্তুগীজ, রোমানিয়ান ইত্যাদি ভাষা ল্যাটিন থেকে গড়ে উঠেছে। তবে গ্রীক ভাষার বিকাশ আগেই ঘটেছিলো বলে গ্রীকদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রয়েছে। তাছাড়া রোমানরা প্রথমে গ্রীক আর ল্যাটিন দুটি ভাষাই ব্যবহার করতেন। তারপর ধীরে ধীরে গ্রীককে হটিয়ে দেয়া হয়। রোমান রাজা ক্লডিয়াস রোমান ভাষা না জানা লোকদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতেন। এরপরও জনগণের সাহসী প্রচেষ্টায় নিজস্ব ভাষা টিকে যায়। যেমন: কপটিক (মিশর), গুলিক, পিউনিক, আরমানিক।

রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর রোমান ক্যাথলিক চার্চ ল্যাটিন ভাষার আধিপত্য বজায় রাখে ধর্মের দোহাই দিয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মাতৃভাষাকে বাঁচাবার সংগ্রাম ধর্ম দিয়ে আটকানো যায়নি। মার্টিন লুথারের সংস্কারের ফলে ল্যাটিনের প্রভাবই শেষ হয়নি, রোমান ক্যাথলিক ধর্মমত থেকে সরে গিয়ে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতও চালু হয়ে যায়। ভাষার প্রতি ভালোবাসার এমনই জোর।

কিন্তু ফরাসীদের শক্তিমত্তার ফলে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই ফরাসী ভাষা ল্যাটিনের জায়গা দখল করে নেয়। ফরাসী ভাষা গ্রীস, স্পেন, জার্মানী, রাশিয়া এমনকি ইংল্যান্ডেও প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। টানা তিন শ’ বছর ফরাসীই ছিলো ইংল্যান্ডের রাজকীয় ভাষা। ইংল্যান্ড যদি এখনো দ্বি-ভাষিক (ফরাসী,ইংরেজী) দেশ হিসাবে থেকে যেতো তাতেও অবাক হবার কিছু ছিলো না। ইংল্যান্ডের রাজা এডোয়ার্ড কোন উত্তরাধিকারী না রেখে মারা যাবার পর হ্যারল্ড ইংল্যান্ডের রাজা হন। কিন্তু ১০৬৬ খ্রীস্টাব্দে নর্মান্ডির ডিউক উইলিয়াম বিখ্যাত হেস্টিংস যুদ্ধে রাজা হ্যারল্ডকে পরাজিত করে ইংল্যান্ডের রাজা হন। রাজা উইলিয়াম ফরাসী ভাষী ছিলেন। তিনি ফরাসীকে রাজকীয় ভাষায় পরিণত করেন। কিন্তু নিম্নবিত্তের ইংল্যান্ডবাসীগণ পুরনো ইংরেজীতে কথা বলতেন। শত বর্ষের যুদ্ধের ফলে ( ১৩৩৭-১৪৫৩ খ্রীস্টাব্দ) ইংল্যান্ডে ফরাসী ভাষার প্রভাব কমে যায়। ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে প্লিডিং আইন পাশের পর (আইনটি ফরাসী ভাষায় প্রণীত) ইংরেজী রাজদরবারের কথ্য ভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৩৮৫ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ স্কুলগুলোতে ইংরেজী ভাষায় শিক্ষাদান শুরু হয়। ১৩৫০ থেকে ১৪০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বিখ্যাত জিওফ্রে চসারসহ লেখকরা ইংরেজীতে বই লিখলেও বইয়ের ভূমিকায় ক্ষমাপ্রার্থনা করে নিতেন ফরাসীর বদলে ইংরেজীতে লিখেছেন বলে। মূলত:মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত ইংল্যান্ডবাসীর অলিখিত সংগ্রামের কারণেই ইংরেজী ইংল্যান্ডের রাজদরবারসহ সার্বজনীন ভাষায় পরিণত হয়। তবে ইংরেজী ভাষার শব্দসম্ভারে ফরাসী ভাষার প্রভাব বিপুল। একইভাবে জার্মান আর রাশিয়ানরা দীর্ঘ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ফরাসী ভাষার খপ্পর থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছেন।

এশিয়া মাইনরে গড়ে ওঠা ফরাসী উপনিবেশগুলোর ভাষাও ফরাসী। ফরাসী উপনিবেশের কারণে এখনো আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশে ফরাসী ভাষা প্রচলিত আছে। ফরাসীরা উপনিবেশ হারালেও তাদের ভাষা রয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্য, কানাডার কিবেক প্রদেশ, হাইতি, ভূমধ্য সাগর অববাহিকায়, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাংশে।

স্পেনিশ ভাষার জন্ম প্রায় ৫ হাজার বছর আগে কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে। খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর খ্রীস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে জার্মানভাষী ভিজিগোথরা স্পেন শাসন করে। ৭১১ খ্রীস্টাব্দে স্পেন জয় করে আরবরা। ফলে স্পেনিশ ভাষায় আরবী প্রভাব পড়ে। একাদশ শতাব্দীতে কাস্টিলিয়ন অঞ্চল এবং ১৪৯২ খ্রীস্টাব্দে গ্রানাডা আরবদের হাতছাড়া হয়। রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা স্পেনের সিংহাসনে বসেন। এরপর থেকে স্পেন নিজেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। রানী ইসাবেলার অর্থ সাহায়্যে কলম্বাস এশিয়ার নতুন জলপথ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করার পর আমেরিকায় স্পেনিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ সুগম হয়। মাত্র ৬শ’ বছর আগে যে স্পেনিশ ভাষা ছিলো শুধু ক্যাস্টিলিয়ান অঞ্চলের একটি ভাষা তা এখন স্পেনিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সুবাদে জনসংখ্যার পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা (প্রথম-চীনের ম্যান্ডারিন)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের মধ্যে দক্ষিণ আমেরকিানদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে স্পেনিশরা সাম্রাজ্য হারায়, ১৯০০ সালে ক্যারিবীয়রা স্বাধীন হয়। শুধু থেকে যায় আফ্রিকার উপনিবেশগুলো। ১৯৭৫ সালে শেষ উপনিবেশ হাতছাড়া হয় তাদের। কিন্তু স্পেনিশ ভাষা থেকে যায়। এখন ২১টি দেশের সরকারী ভাষা স্পেনিশ। এরমধ্যে আছে স্পেন, কলম্বিয়া, পেরু, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডরম গুয়েতেমালা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি ইত্যাদি। এটি জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা। কিন্তু খোদ স্পেনেই স্পেনিশ ভাষা প্রতিরোধের মুখে রয়েছে। পিরেনিজ পর্বতমালার পাদদেশে বসবাসকারী বাস্ক ভাষাভাষীরা গত চার দশক ধরে ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। মাঝে মাঝে সশস্ত্র প্রতিবাদও করছেন বাস্করা। অন্যদিকে কাতালান উপভাষাভাষী বার্সেলোনাও ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতা চাচ্ছে। রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার ফুটবল সমর্থকদের দ্বন্দ্ব শুধু খেলার মাঠের দ্বন্দ্ব নয়, ভাষাভিত্তিক স্বাধীনতারও দ্বন্দ্ব।

সপ্তম শতাব্দী থেকে আরবরা এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ মহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে ধর্ম ও আরবী ভাষার প্রসারও ঘটায় তারা। ফলে মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকাজুড়ে আরবী এখন সরকারী ও জনগণের মুখের ভাষা। যেমন: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত, আলজেরিয়া, বাহরাইন, মিশর, বাহরাইন, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সিরিয়া, তিউনিসিয়া ইত্যাদি। আরবদের ভাষার আগ্রাসনে বাধা এসেছিলো দুই প্রতিবেশীর কাছ থেকে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত আবু বকর (রা:)-এর সময় আরবরা ইরান জয় করে। ইরানীরা ইসলাম গ্রহণ করে। প্রাচীন ফারসী পাহলবীর বদলে সবক্ষেত্রে আরবী হয়ে পড়ে ইরানের ভাষা। মাত্র ৩শ বছরের মধ্যে নবরূপে ফিরে আসে ফারসী ভাষা। পারস্যের জালাল উদ্দিন মালিক শাহ, গজনীর সুলতান মাহমুদ আর তুর্কিস্থানের কাদির খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ফারসী সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আসন লাভের উপযুক্ত হয়। তাঁদের আনুকূল্য আর তার ধারাবাহিকতায় ফারসি ভাষায় অমর সাহিত্য রচনা করেন মহাকবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী, নাসির খসরু, নেজামী, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, মৌলানা রুমি, কবি হাফিজ, মোল্লা জামী আর দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চা করেন ইবনে সিনা, আল গাজ্জালী। এর সূচনা করেন ফেরদৌসী আরবীর বদলে ফারসীতে তাঁর মহাকাব্য ’শাহনামা’ রচনার মাধ্যমে। জনচিত্ত মাতৃভাষার জন্য তৃষিত হয়ে উঠলো। ফারসী হয়ে গেলো ইরানের রাষ্ট্রভাষা। আরবদের আরেক প্রতিবেশী তুরস্কও আরবীকে মেনে নেয়নি। তুর্কীদের বাধার মুখে তুর্কীই থেকে গেলো তুরস্কের ভাষা। এরপর তা হয়ে গেলো রাষ্ট্রভাষা।

নরওয়ের ভাষা-বিবাদ বহুদিন ধরে চলছে। ১৫৩৬ থেকে ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত নরওয়ে ছিলো ডেনমার্কের অধীনে। সে সময় ডেনিশ ছিলো নরওয়ের সরকারী ভাষা। ১৮১৪ সালে নরওয়ে পৃথক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন ড্যানো-নরওয়েজিয়ান (নরওয়েজীয় উচ্চারণে ডেনিশ) হয় নরওয়ের সরকারী ভাষা। এটা ছিলো ডেনিশ শাসনকালের শহরের ধনীদের ভাষা। কিন্তু নিরন্তর নানা সংস্কার চলতে থাকে সে ভাষার। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ড্যানো-নরওয়েজিয়ান ভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে ’রিস্কমল’ ভাষা নামে পরিচিত হয়। ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে ভাষার নাম হয় ’বোকমল’। পরে আরো সংস্কারের মাধ্যমে ’বোকমল’ আর ’নায়নোরস্ক’ এ দুই রকমের ভাষা চালু আছে নরওয়েতে। তবে সেখানে ভাষা-বিতর্ক এখনো জারী আছে।

বেলজিয়ামের ১ কোটির বেশি মানুষের মধ্যে ৫৮% ওলন্দাজ ভাষাভাষী ফ্লেমিং জনগোষ্ঠী, ৩১% ফরাসী ভাষী ওয়ালুনস আর ১% জার্মান ভাষাভাষী। ওলন্দাজ আর ফরাসীভাষীদেও দ্বন্দ্বে বেলজিয়ামে একাধিকবার সরকার পতন হয়েছে। ওলন্দাজভাষী ফ্লেমিংরা নিজেদের বেলজিয়ান হিসাবে পরিচয় দিতেও রাজী না। ভাষার প্রশ্নে বেলজিয়ামের অখন্ডতাই ঝুঁকিতে আছে।

বৃটিশরা অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তার করে। একসময় বলা হতো বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। ১৯২২ সাল নাগাদ পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ আর এক চতুর্থাংশ এলাকা বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো। বৃটিশরা পুরো সাম্রাজ্যে নিজেদের ভাষা ইংরেজী চাপিয়ে দিয়েছে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে। সমাজের ’অভিজাত’ অংশ সানন্দে ইংরেজী রপ্ত করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজ ভাষা ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। ফলে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পর ইংরেজী ভাষা কার্যত: কয়েকটি দেশে সীমিত হয়ে পড়েছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া. নিউ জিল্যান্ড পুরো ইংরেজী চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের কথা বাদ দিলেও লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্য এবং কানাডার কিবেক প্রদেশ ফরাসী ভাষী। কানাডা থেকে অনেকদিন ধরেই ফরাসী ভাষাভাষী কিবেক প্রদেশ স্বাধীন হতে চাচ্ছে। ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতার প্রশ্নে কয়েক বছর আগে অনুষ্ঠিত গণভোটে সামান্য ব্যবধানে স্বাধীনতাপন্থীরা হার মেনেছেন। আফ্রিকা আর ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিছু দেশ ছাড়া স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলো নিজেদের ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা বা দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছে।

ইউরোপে ল্যাটিন বা ফরাসী অনেক দেশে অনেক দিন চর্চা করলেও সেটা অভিজাত পর্যায়ে রয়ে গেছে। গণমানুষ কিন্তু মাতৃভাষাতেই কথা বলেছে। তাই আজ পুরো ইউরোপে প্রত্যেক দেশের নিজের ভাষা আছে। জীবনের প্রয়োজনে কেউ অন্য দেশে আশ্রয় নিলেও মাতৃভাষা ছাড়েননি। তাই ইউরোপের বেশীরভাগ দেশেই একাধিক সরকারী ভাষা রয়েছে। যেমন-অস্ট্রিয়ার দাপ্তরিক ভাষা জার্মান,ক্রোয়েশিয়ান ও স্লোভেন। এছাড়া চেক,হাঙ্গেরিয়ান, স্লোভাক ও রোমানী ভাষার প্রচলন রয়েছে। চেক রিপাবলিকে চেক ও স্লোভাকসহ ১৫টি ভাষা প্রচলিত, জার্মানীতে আছে জার্মানসহ ৮টি ভাষা, হাঙ্গেরীতে হাঙ্গেরিয়ানসহ ৭টি ভাষা, ইতালীতে ইতালিয়ানসহ ৫টি ভাষা, রোসানিয়ায় রোমানিয়ানসহ ৯টি ভাষা, রাশিয়াতে রুশসহ ৩৪টি ভাষা প্রচলিত আছে।

ভাষার লড়াই বাড়ীর পাশেই

বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাধিকার বহন করছে। ভাষা চাপিয়ে দেয়া এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ এ অঞ্চলে বহুবার ঘটেছে। এর সাথে রাষ্ট্র এবং ধর্ম উভয়ে জড়িত ছিলো। প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্যভাষা যখন জনসাধারন্যে প্রচলিত ছিলো তখন পণ্ডিত ও ভদ্রলোকদের মধ্যে প্রচলিত ভাষায় বেদশাস্ত্রাদি ও কাব্য রচিত হয়। তাকে আখ্যা দেয়া হয় বেদভাষা বা বৈদিকভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্যরীতির সাথে বৈদিক ভাষার সংমিশ্রনে বৈদিক ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখা যাচ্ছিলো না। তাই বেদভাষার সূচিতা ও শুদ্ধতা রক্ষার জন্য পাণিনি প্রমুখ পণ্ডিত বৈদিক ভাষার বর্ণনামূলক ব্যাকরণ রচনা করেন। এভাবে ভারতীয় আর্য কথ্যভাষা ও বৈদিক ভাষার সংমিশ্রনজাত ভাষার সংস্কার করা হয়েছে বলে এ ভাষা ’সংস্কৃত’ ভাষা নামে পরিচিত হয়। সংস্কৃত ভাষার নিয়মের বেড়াজালে গণমানুষ স্বভাবতই আটকে থাকতে চায়নি বলেই সংস্কৃত ভাষা বইয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে। মানুষের মুখের ভাষা হয়ে উঠতে না পারার জন্য সংস্কৃত (ল্যাটিনের মতো) মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে। পাশাপশি ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম ও তার বাহন সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তথাগত বুদ্ধ তৎকালীন দেশজ ভাষায় (যা এখন পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। একইভাবে প্রাচীন ধর্মের সাথে প্রতিযোগিতায় শিখ ধর্মে পাঞ্জাবী সাহিত্যের সৃষ্টি। নতুন ধর্ম প্রচারকগণ নিজের মত সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার জন্য প্রচলিত ভাষার আশ্রয় নেন। ( আরব জনগনের কাছে সহজবোধ্য হবে, এ বিবেচনায় কুরান আরবী ভাষায় নাজিল করা হয়েছে বলে কুরানেই উল্লেখ আছে)

ভাষার ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, তাতে দেখা যায় রাজদরবার আর উচ্চ সমাজের সাথে গণমানুষের মুখের ভাষার একটা পার্থক্য ছিলোই। ভাষা বাবদে জনতা সব সময় রাজদরবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এরকম মুখের ভাষার বিবর্তনেই এ অঞ্চলে বাংলাসহ বর্তমানে প্রচলিত সকল ভাষা গড়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার বিকাশ ও গড়ে ওঠার মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা হয়ে ওঠা, লোক কবিদের গান,কবিতা রচনা। স্বাধীন সুলতানী আমল, আরাকান রাজসভার আনুকূল্য ছাড়া বাংলা ভাষার চিরকালীন ভরসা ছিলো সাধারণ মানুষ।

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন চালুর সময় থেকে ফারসী রাজদরবারের ভাষা। ১০২১ খ্রীস্টাব্দে গজনী রাজবংশ লাহোরে শাসন শুরু করার পর সেখানে ফারসী রাজদরবারের ভাষা হিসাবে গৃহীত হয়। ত্রয়োদশ শতকে সেটা সারা ভারতের রাজভাষায় পরিণত হয়। দিল্লী সালতানাৎ (১২০৬-১৫২৬) ও মুঘল শাসনামলে (১৫২৬-১৮৫৮) রাজভাষা ফারসীর পাশাপাশি স্থানীয় খারিবোলি উপভাষা থেকে তিনটি ভাষা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে- হিন্দুস্তানী, হিন্দী আর উর্দু। যেগুলো বৈশিষ্ট্যগতভাবে কাছাকাছি ভাষা ছিলো। ইংরেজরা ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের পর ফারসির বদলে ইংরেজী সরকারী ভাষায় পরিণত হয়। ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী (সরকার) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাকে ইংরেজীর পাশাপাশি সরকারী ও আদালতের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করে। সে নীতির ভিত্তিতে হিন্দীভাষী উত্তর ভারতীয় এলাকায় ইংরেজীর পাশাপাশি ফারসীর বদলে উর্দু ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। দেবনাগরী বর্ণমালায় লেখা হিন্দী ভাষাভাষীরা বিষয়টি সহজভাবে মানতে পারেনি। ১৮৬০-এর দশকে উত্তর ভারতে ব্রিটিশ রাজের স্ববিরোধী ভাষানীতির কারনেই এর সূত্রপাত বলে অনেকে মনে করেন। কারণ সরকার তখন শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে উর্দু ও হিন্দী দুই ভাষাকেই উৎসাহিত করেছে,অন্যদিকে সরকারী কাজে হিন্দীর বদলে উর্দুকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে চাকরীর বাজারে হিন্দী শিক্ষিতরা সমস্যায় পড়ে যায়। এটা শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নেয়।

১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দে হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে উর্দুর বদলে হিন্দীকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দানের দাবী জানায়। ১৮৬৮ খ্রীস্টাব্দে বেনারসের বাবু শিব প্রসাদ এক লেখায় হিন্দী ভাষার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি অভিযোগ করেন, আগেকার মুসলিম শাসকরা তাদেরকে (হিন্দু সমাজকে) জোর করে ফারসী শিখতে বাধ্য করেছেন। ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে মদনমোহন মালবিয়া ’ Court character and primary education in North Western Provinces and Oudh,’ নামক বইতে হিন্দীর পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। ১৮৮১ খ্রীস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী বিহারে উর্দুর বদলে হিন্দী সরকারী ভাষার মর্যাদা লাভ করার পর এ আন্দোলন গতি লাভ করে। সাংগঠনিকভাবে ভাষার পক্ষে আন্দোলন আরম্ভ হয়। হিন্দী ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদায় আসীন করার জন্য বেনারসে ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় ’নাগরী প্রচারণী সভা’; ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে এলাহাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয় ’হিন্দী সাহিত্য সম্মেলন’; ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ’দক্ষিণ ভারত হিন্দী প্রচার সভা’ এবং ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ’রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’। বিভিন্ন শহর থেকে ৬৭ হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত ১১৮টি স্মারকলিপি শিক্ষা কমিশনের কাছে দাখিল করা হয়। স্মারকলিপিতে বলা হয়, হিন্দী সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা, উর্দু ভাষা লোকজন বুঝতে পারেনা, ফলে আদালতে জালিয়াতি বেড়ে যাবে।

অন্যদিকে উর্দু ভাষার পক্ষে আন্দেলনের জন্য গঠিত হয় ’আঞ্জুমান তারাক্কি-ই-উর্দু’। তারা যুক্তি দেখায় উর্দু একটি ভারতীয় ভাষা, এটা দ্রুত লেখা যায় ইত্যাদি। উর্দুর পক্ষে আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা নেন আলীগড় আন্দোলনের নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান। হিন্দী উর্দুর এ দ্বৈরথে ভাষাতাত্ত্বিকভাবে দুটি ভাষা আলাদা হয়ে যায়। উর্দুতে ধীরে ধীরে আরবী, ফারসী আর তুর্কি প্রভাব বাড়তে থাকে, অন্যদিকে হিন্দীতে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বাড়তে থাকে।

ভাষা নিয়ে এ সাম্প্রদায়িক বিভেদের বেড়াজাল ভাঙার জন্য মহাত্মা গান্ধী ১৮২০-এর দশকে বিকল্প উদ্যোগ নেন। তিনি উর্দু আর হিন্দীকে এক করে হিন্দুস্তানী ভাষার প্রস্তাব করেন। যা ফারসী ও দেবনাগরী উভয় বর্ণমালায় লেখা হবে। কিন্তু মহাত্মাজীর উদ্যোগ হালে পানি পায়নি।

১৯০০ খ্রীস্টাব্দে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় সরকার উর্দু ও হিন্দী সরকারী ভাষা হিসাবে সমান মর্যাদা প্রদান করে। এ পদক্ষেপ হিন্দু সমাজ সানন্দে মেনে নিলেও মুসলিম সমাজ তা মানতে পারেনি। বৃটিশদের ’ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি বাস্তবায়নে ভাষা-বিরোধ যে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে তা এ থেকে অনুমান করা যায়।

হিন্দী বিরোধী ভাষার লড়াই

উত্তর ভারতে যখন উর্দু নিয়ে মুসলিম সমাজ আর হিন্দী নিয়ে হিন্দু সমাজ ব্যস্ত তার কিছু পরেই দক্ষিণ ভারতে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। তামিল নাড়– রাজ্য আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী এলাকায় দেখা দেয় হিন্দী বিরোধী আন্দোলন। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দে সি, রাজাগোপালাচারীর (রাজাজী) নেতৃত্বে কংগ্রেস প্রথম সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পরেই হিন্দীকে স্কুলে বাধ্যতামূলক করা হলে প্রতিবাদ আরম্ভ হয়। ই.ভি.রামস্বামী (পেরিয়ার) ও বিরোধী জাস্টিস পার্টি এর প্রতিবাদ করে। জাস্টিস পার্টি ১৯৪৪ সালে নাম বদলে হয় ’দ্রাবিড়ার কাঝাঘাম’। ১৯৪৯ সালে এ দল ভেঙ্গে গঠিত হয় ডিএমকে ( দ্রাবিড়া মুন্নেত্রা কাঝাঘাম)। বর্তমানে তামিলনাড়–তে ডিএমকে সরকার ক্ষমতায় আছে। আন্দোলন কালে অনশন, বিক্ষোভ মিছিল, পিকেটিং, কালো পতাকা মিছিল, হিন্দী-বিরোধী সম্মেলন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ১৯৩৮ খ্রীস্টাব্দের ১ জুলাই ও ৩ ডিসেম্বর হিন্দী বিরোধী দিবস পালন করা হয়েছে। আন্দোলন অব্যাহত থাকায় ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে কংগ্রেস সরকার আন্দোলন দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। নারী-শিশুসহ ১১৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ১১৭৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৭৩ জন মায়ের সাথে ৩২ শিশুকেও জেলে যেতে হয়। এখানেই শেষ নয়, ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তালামুথু এবং নটরাজন নামে দুই আন্দোলনকারী পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন। তামিলনাড়–র উর্দুভাষী মুসলামানরা তামিলদের ভাষা আন্দোলনে সমর্থন দেন। হিন্দী প্রশ্নে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। রাজাজী আর তাঁর সমর্থকরা হিন্দী চালুর ব্যাপারে অটল থাকেন। অন্যদিকে সত্যমূর্তি আর ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান (পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন) চেয়েছেন হিন্দী শিক্ষা ঐচ্ছিক করা হোক। রাজাজী হিন্দীর পক্ষে সভা সমাবেশের ব্যবস্থা নেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে জড়ানোর প্রতিবাদে কংগ্রেস সরকার পদত্যাগ করে। মাদ্রাজে গভর্ণরের শাসন চালু হয়। আন্দোলন থামিয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে গভর্ণর ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের ২১ ফেব্র“য়ারী বাধ্যতামূলক হিন্দীর বদলে ঐচ্ছিক করা হয়। ১৯৪৬ থেকে ৫০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে আবার হিন্দীবিরোধী আন্দোলন আরম্ভ হয়। ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীন হবার পর আবার ১৯৪৮-৪৯ শিক্ষাবর্ষে হিন্দী বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ন্যূনতম নম্বর প্রাপ্তিও বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে দ্রবিড়া কাঝাঘামের নেতাদের একাধিকবার গ্রেফতার করা হয়। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হটে এবং ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে হিন্দী ঐচ্ছিক করা হয়।

ভারত স্বাধীন হবার পর ভাষা প্রশ্নে মতভেদের মুখে জাতীয় ভাষার (National Language) বদলে দাপ্তরিক ভাষা (Official Language) হিসাবে হিন্দীর সাথে ইংরেজীকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারী ভারতের সংবিধান সংসদে পাশ হয়। পরবর্তী চার দশকজুড়ে তামিলনাড়ুতে ডিএমকের নেতৃত্বে হিন্দী বিরোধী বহু আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৯৬৩ খ্রীস্টাব্দে দাপ্তরিক ভাষা আইন প্রণয়ন এবং পরে তার সংস্কারের মাধ্যমে ভাষা প্রশ্নে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। কারণ হিন্দী বিরোধী আন্দোলন এবং নিজ নিজ ভাষার সরকারী মর্যাদার জন্য দক্ষিণ ভারতসহ সারা ভারতে বারবার ভাষা আন্দোলন হয়েছে। ভাষার দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রাণহানি ঘটেছে। ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে তেলেগু ও অন্ধ্রের দ্বন্দ্বের জের ধরে কয়েকজন কংগ্রেস নেতার সমর্থনে একজন কমিউনিস্ট নেতা তেলেগুভাষী পৃথক প্রদেশের দাবী নেহেরুর কাছে তুলে ধরেন। দলীয় সংহতির দোহাই দিয়ে সে দাবী অগ্রাহ্য করা হয়। সর্বদলীয় অন্ধ্র কনভেনশনের পর বিশাল অন্ধ্র আন্দোলনের নেতা পোট্টি শ্রীরামুলু তেলেগুভাষী পৃথক রাজ্যের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করেন এবং ৫৬ দিন অনশনের পর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্রকরে সৃষ্ট দাঙ্গায় অনেক লোক মারা যান। অবশেষে ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে সরকার দাবী মেনে নেয় এবং ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে পৃথক রাজ্য গঠিত হয়। সে সূত্রে সরকার ভাষাভিত্তিক পৃথক রাজ্য গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সারাভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলো গঠিত হয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন তেলেঙ্গানা রাজ্য। আরো ৬/৭টি অঞ্চলে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবী ভারত সরকারের কাছে দাখিল করা আছে। ভাষার গোলমাল যে ভারতে এখনো জারী আছে তার প্রমান পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। আম আদমী পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল মে,২০১৪-এর মধ্যে বাস্তবায়ন করবেন তাঁর এমন সংস্কার কর্মসূচীর তালিতায় অন্যান্যের সাথে রয়েছে ’পাঞ্জাবী ও উর্দুকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দান।’

কঙ্কাই ভাষা আন্দোলন

গোয়া দমন দিউ’র কঙ্কাই ভাষী জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভাষার দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদার জন্য আন্দোলন করেছেন। সে আন্দোলনের অংশ হিসাবে ভাষা আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে ১৯৮৬ খ্রীস্টাব্দে কঙ্কাই ভাষা আন্দোলনকারীদের মিছিলে গুলী চালায়। গুলীতে ৭ জন আন্দোলনকারী নিহত হন, বহু আহত হন। ভারত সরকার কঙ্কাই ভাষা আন্দোলনকারীদের রক্তদানের পর ১৯৮৭ খ্রীস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারী কঙ্কাই গোয়ার একমাত্র দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পায় এবং সে বছর ৩০ মে পৃথক রাজ্যেরও স্বীকৃতি পায়।

গোকাক আন্দোলন

১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে কর্নাটক রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ’তিন ভাষা নীতি’ (হিন্দী,সংস্কৃত,কানাড়া) গ্রহণ করা হয়। ১৯৬০ ও ৭০ দশকে কর্নাটকে প্রবল হিন্দীবিরোধী মনোভাব দেখা দেয় এবং লোকজন ইংরেজীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। সে সাথে সংস্কৃত ভাষার প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব তৈরি হয়। কারণ সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বেড়ে যাচ্ছিলো। কানাড়া ভাষা না শিখেই ছাত্রছাত্রীরা হাইস্কুল পার হয়ে যেতে পারছিলো। ফলে স্কুলে প্রথম ভাষা হিসাবে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে কানাড়া চালুর দাবীতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। রাজনৈতিক দল, ছাত্রশিক্ষক, বুদ্ধিজীবী,লেখক সবাই এতে যোগদেন। সরকার ভাষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রিপোর্ট দাখিল করার জন্য কর্নাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভি.কে.গোকাকের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে। গোকাক রিপোর্টে কানাড়াকে প্রথম ভাষার মর্যাদা দানের পাশাপাশি ইংরেজী, মারাঠী, তেলেগু, তামিল ও উর্দু ভাষাকেও বিবেচনায় নেয়। সরকার রিপোর্ট পাবার পরও তা বাস্তবায়ন না করায় কানাড়া চিত্রনায়ক ড. রাজকুমারের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন আরম্ভ হয়। সবাই তাতে অংশ নেন। এক পর্যায়ে ছবি নির্মান পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। কানাড়া সরকার আন্দোলনের মুখে কানাড়াকে প্রথম ভাষার মর্যাদা দেয়। কিন্তু বাহ্মণরা সংস্কৃতের মর্যাদা হ্রাসের প্রতবাদ করছে। অন্যদিনে ১১% মুসলমান উর্দুর মর্যাদা রক্ষা আর কানাড়া ভাষা শিক্ষার প্রতিবাদে রীতিমতো জিহাদের হুমকি দিচ্ছে।

কোলশি ভাষা আন্দোলন

পশ্চিম উড়িষ্যার কোশাল জেলার অধিবাসীরা গত পাঁচ দশক ধরে তাদের ভাষার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করছেন। কোশাল রত্ন (প্রয়াত) প্রয়াগ দত্ত জোশী, ড. নীলামাধব পাণিগ্রাহীসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা এ আন্দোলনের সূচনা করেন। এখন তা পরিপূর্ণ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য কোলশি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্জন (৮ম তফশীলে অন্তর্ভুক্তকরণ)। কোলশি ভাষাভাষী অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঠিত সংগঠন কেডিডিএফ প্রধানমন্ত্রী ড.মনমোহন সিং-এর কাছে স্মারকলিপি দিয়ে কোলশি ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানের জন্য। কারণ সম্প্রতি সংবিধানের ৯৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে বোড়ো,ডোগরি,সাঁওতালী ও মৈথিলী ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

পাঞ্জাবী সুবা আন্দোলন

১৯৫০-এর দশক থেকে শিখদের সংগঠন আকালী দল ভাষাভিত্তিক পাঞ্জাবী সুবা (প্রদেশ) গঠনের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করে। শিখদের নেতা সন্ত ফতেহ সিং পাঞ্জাবের হিন্দী ভাষী এলাকা থেকে পৃথক করে পাঞ্জাবী ভাষী সুবা গঠনের দাবীতে আমরণ অনশন আরম্ভ করেন। কয়েকদিন পর ফতেহ সিং তাঁর ধর্ম-গুরু মাস্টার তারা সিং-এর নির্দেশে অনশন ভঙ্গ করেন। অন্যদিকে ’আকালী তখত’ও আন্দোলনে ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে আন্দোলনরত ১২ হাজার শিখকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯৬০-৬১তে গ্রেফতার হন ২৬ হাজার শিখ। সরকারের সাথে শিখদের আলোচনা ব্যর্থ হবার পর ধর্মীয় নেতা মাস্টার তারা সিং নিজেই ৪৮দিনের অনশন আরম্ভ করেন। আন্দোলনে কোন ফল না পেয়ে সন্ত ফতেহ সিং ১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দে আবার অনশন আরম্ভ করেন এবং হুমকি দেন, তাঁদেও দাবী মানা না হলে তিনি দক্ষিন ভিয়েতনামী বৌদ্ধদের মতো স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করবেন। পরে ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী সরকার পাঞ্জাবীদের দাবী মেনে নেন। পাঞ্জাবকে তিন ভাগ করে পাঞ্জাব,হরিয়ানা,হিমাচল রাজ্য গঠন করা হয়।

অন্যান্য ভাষার লড়াই

১৯৬২ খ্রীস্টাব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অহমিয়া,বাংলা প্রধান আসাম রাজ্য গঠনের পর তিবেতো-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত বিভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ী জনগন ভাষাভিত্তিক পৃথক রাজ্যের জন্য সহিংস আন্দোলন আরম্ভ করে ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে। ১৯৬৮তে শিলংয়ে সর্বদলীয় পাহাড়ী নেতাদের সম্মেলনে সর্বাত্মক ধর্মঘটের সিদ্ধান্তের পর তাদের দাবীর বিষয়ে সুপারিশ দেবার জন্য ভারত সরকার মেহতা কমিশন গঠন করে। মেহতা কমিশনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে পাহাড়ীদের ভাষার ভিত্তিতে ১৯৭১-এ মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা আর মনিপুর রাজ্য গঠিত হয়।

১৮৪৯ খ্রীস্টাব্দে ওড়িয়াভাষী দেশী রাজ্য সম্বলপুরের শেষ স্বাধীন রাজা চৌহানরাজ নারায়ন সিং অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। কয়েকমাস বিধাব রাণী মুক্ষাপন দেবী রাজত্ব চালানোর পর বৃটিশরা সম্বলপুর দখল করে। অন্যান্য এলাকার মতো সেখানেও নিজস্ব ভাষার (ওড়িয়া) পাশাপশি ইংরেজী চালু হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট্রাল প্রোভিন্সের চীফ কমিশনার স্যার জন উডবার্ন ওড়িয়ার বদলে হিন্দীকে সম্বলপুরের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৮৯৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত সম্বলপুরের কবি,সাহিত্যিক, সুধীসমাজের নিরন্তও চেষ্টায় ওড়িয়া সম্বলপুরের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা ফিরে পায় এবং সম্বলপুর উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৯৬ খ্রীস্টাব্দের ১৪ মার্চ আসামের করিমগঞ্জে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদার দাবীতে রেল অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলী ছুঁড়লে শহীদ হন ভাষা সংগ্রামী সুদেষ্ণা সিংহ। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।

বাংলা ভাষার তিন আন্দোলন

বর্তমান বাংলাদেশের বাংলাভাষীসহ ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র/দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দানের দাবীতে তিনটি আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে দুটি আন্দোলন ছিলো রক্তক্ষয়ী। তিন আন্দোলনের সবচেয়ে গৌরবময় আন্দোলনের কৃতিত্ব এই বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের। আসুন জেনে নেয়া যাক বাংলা ভাষার তিনটি আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত-

বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা আন্দোলন

১৯৬০ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি দাবী করে, ’অহমিয়া’ হতে হবে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা। এ নিয়ে প্রবল বিরোধ দেখা দেয় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। আসামের অধিবাসীরা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাঙালী হিন্দুদের বাড়ীঘরে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে ৫০ হাজারের বেশি বাঙালী হিন্দু পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয় নেন। ৯০ হাজারের মতো বাঙালী হিন্দু পালিয়ে যান বরাক উপত্যকা এবং রাজ্যের উত্তর পূর্বাঞ্চলে। ঘটনার পর গঠিত বিচারপতি গোপাল মেহরোত্রা কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় কামরূপ জেলার গোরেশ্বরে ২৫টি গ্রামে বাঙালী হিন্দুদের চার হাজারের বেশি বাড়ীঘর ধ্বংস করা হয়। হামলায় মারা যান ৯ জন, আহত হন শতাধিক বাঙালী হিন্দু। এরপরও আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্য বিধানসভায় ’অহমিয়া’কে আসাম রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদানের জন্য বিল উত্থাপন করেন। করিমগঞ্জ(উত্তর) আসনের বিধায়ক রনেন্দ্র মোহন দাস (বাঙালী) এর প্রতিবাদ করে বলেন, এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা (অহমিয়া) দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। ২৪ অক্টোবর আইন পাস হয়ে যায়। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষী জনগনের ওপর অহমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রতিবাদে ৫ ফেব্রুয়ারী,১৯৬১ গঠিত হয় ’কাছার গণসংগ্রাম পরিষদ’। পরিষদ ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে ’সংকল্প দিবস’ পালন করে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়তে ২৪ এপ্রিল থেকে পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রার আয়োজন করে বরাক উপত্যকার শিলচর ও করিমগঞ্জ এলাকায়। পরে হাইলাকান্দিতেও পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। পদযাত্রা শেষে কাছার গণসংগ্রাম পরিষদের প্রধান রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মে,১৯৬১-এর মধ্যে যদি বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করা না হয় তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হবে। ১৮ মে পুলিশ গণসংগ্রাম পরিষদের মূল ৩ নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন এবং বিধূভূষণ চৌধুরীকে (সম্পাদক, সাপ্তাহিক যুগশক্তি) গ্রেফতার করে। সর্বাত্মক হরতাল চলাকালে ১৯ মে বিকালে আসাম রাইফেলসের সৈন্যরা ভাষা-আন্দেনকারীদের দিকে গুলী ছোঁড়েন। বুলেটবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে নেয়া হলে ৯ জন ঐদিন আর ২ জন পরদিন মারা যান। শিলচরের ১১ ভাষা শহীদ হলেন-১.কানাইলাল নিয়োগী,২.চণ্ডীচরণ সূত্রধর,৩.হিতেশ বিশ্বাস,৪.সতেন্দ্র দেব,৫.কুমুদ রঞ্জন দাস,৬.সুনীল সরকার,৭.তরণী দেবনাথ,৮.শচীন্দ্র চন্দ্র পাল,৯.বীরেন্দ্র সূত্রধর,১০.সুকোমল পুরকায়স্থ ও ১১.কমলা ভট্টাচার্য। এখানেই শেষ নয়। ১৯৭২ খ্রীস্টাব্দের ১৭ আগস্ট বিজন চক্রবর্তী এবং ১৯৮৬ খ্রীস্টাব্দের ২১ জুলাই জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেন। আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। সে থেকে আসামসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ১৯ মে ’বাংলা ভাষা শহীদ দিবস’ পালিত হয়। শিলচরে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মান করা হয়েছে।

মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন

১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ২য় শাহ আলম বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলার দেওয়ানী প্রদান করেন। বিহার-উড়িষ্যা তখন বাংলার অংশ ছিলো। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ’বিহার-উড়িষ্যা’ আলাদা প্রদেশ ঘোষিত হয়। তখন ’মানভূম’ জেলা বিহার-উড়িষ্যায় পড়ে। মানভূম জেলা ১৮৩৩ খ্রীস্টাব্দে ৭,৮৯৬ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত হয়। পরে ১৮৪৫.১৮৪৬.১৮৭১ ও ১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দে মানভূম জেলা থেকে পৃথক চারটি জেলা গঠিত হয় এবং মানভূমের আয়তন কমে দাঁড়ায় ৪,১১২ বর্গমাইলে। মানভূমকে বিহার-উড়িয়্যার অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদ শুরু করে মানভূমের মানুষ । তাদের দাবী, বাংলাভাষী মানভূমকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীন হবার পর মানভূম জেলা পড়ে বিহার রাজ্যে। ১৯৪৮ সালে হিন্দীকে মানভূম জেলার দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করা হয়। জিলা স্কুলের বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে সেখানকার বাংলাভাষী মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। সেজন্য বাংলাকে মানভূমের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবী পেশ করা হয় কংগ্রেস পার্টির কার্যনির্বাহী পরিষদে। কিন্তু ১৯৪৮-এর ৩০ মে ৫৫-৪৩ ভোটে বাংলা ভাষার দাবী অগ্রাহ্য হয়। দু’সপ্তাহের মধ্যে ১৪ জুন বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর জোর করে হিন্দী চাপিয়ে দেবার যে নীতি বিহার সরকার গ্রহণ করেছিলো তার প্রতিবাদ করা এবং বাংলা ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয় ’লোক সেবক সংঘ’। বিহার সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার বন্ধ করেই থেমে থাকেনি, সভাসমাবেশও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত লোক সেবক সংঘ অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও হাল জোয়াল আন্দোলন করে। ১৯৫৪-তে করে তুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন। হাজার হাজার বাংলাভাষী গান গাইতে গাইতে স্বেচ্ছা-কারাবরণ করেন। আন্দোলনের মুখে ’রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ গঠন কওে সরকার। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দের ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী ১৬টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠন করে সেটাকে পশ্চিম বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৭ বর্গমাইলের পুরুলিয়া জেলার তখনকার জনসংখ্যা ছিলো ১১,৬৯,০৯৭।

বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন

১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রফিক শফিক সালাম বরকতসহ ভাষার জন্য যাঁরা শহীদ হয়ে বাংলা ভাষাকে গৌরবের আসনে বসিয়েছেনে তাঁদের সে আত্মত্যাগের প্রেক্ষাপট অনেক বিস্তৃত। উর্দু-হিন্দী ভাষার দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে বৃটিশ সরকার ’ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি নিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন অব্যহত রাখতে পারেনি। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বহন করছে ভারতীয় উপমহাদেশ। ভারতজুড়ে হিন্দীকে কেন্দ্র করে যে ভাষাবিরোধের সূত্রপাত হয়েছে, তেমনি পাকিস্তানে ভাষাবিরোধের সূত্রপাত হয়েছে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে গিয়ে। উর্দু ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেরই ভাষা ছিলো না। এটা উত্তর ভারতীয় অঞ্চলের একটি ভাষা। পাকিস্তানের পূর্বাংশের ভাষা বাংলা, পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবী, সিন্ধুর ভাষা সিন্ধী, বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচ, ফ্রন্টিয়ারের ভাষা পশতু। হিন্দীকে যে রকম অহেতুক হিন্দু ধর্মের সাথে মিলিয়ে ঝামেলা পাকানো হয়েছে, তেমনি একই অপকর্ম করা হয়েছে উর্দুকে ইসলামের সাথে গুলিয়ে ফেলে। সাথে দেয়া হয়েছে আরেকটা খোঁড়া যুক্তি- উর্দু হবে পাকিস্তানের সংহতি বজায় রাখার মাধ্যম। ( ল্যাটিনের হয়ে এ রকম যুক্তি দিয়ে ভ্যাটিক্যানের ক্যাথলিক চার্চও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ভাষার এ বিরোধকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত।) পাকিস্তান আন্দোলনের শেষদিকেই ভাষাবিরোধটি মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের মাথাতেও পাকিস্তানের জন্য উর্দু ঘুরতে থাকে। সেই ভাবনায় যোগ দিয়ে ১৯৪৭-এর জুলাই মাসের প্রথমদিকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড, জিয়াউদ্দিন প্রস্তাব করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সে প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে প্রবন্ধ লেখেন (পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা, দৈনিক আজাদ, ২৯ জুলাই,১৯৪৭)। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান হবার পর থেকেই উর্দু নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কথাবার্তা আরম্ভ হয়। কিন্তু প্রথমে আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এর কোন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়নি। প্রথম প্রতিবাদ হয়েছে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে (সে দফায় যেটা আরম্ভ করেছেন ড.শহীদুল্লাহ)।

সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বাংলা ভাষার পক্ষে অবস্থান নেবার দলিল পাওয়া যাচ্ছে ১৯৪৭-এর কয়েক শ’ বছর আগে থেকেই। ইতিহাসের পাতায় বাংলা ভাষা নিয়ে খুব বেশি কিছু নেই বলে অতীতে বাংলাকে কি ধরনের বিরোধিতার সামনে পড়তে হয়েছে তার নজির পাওয়া যায় না। লোকসাহিত্য আর লোকসঙ্গীতে তার কিছু খবর মেলে। তাতে বোঝা যায়, যারাই অবস্থাপন্ন ছিলেন, রাজানুগ্রহের উচ্ছিষ্টভোগী ছিলেন তারাই ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মাতৃভাষার বদলে রাজভাষার পদলেহন করেছেন। (যার চিহ্ণ এখনো পাবেন একটু চোখ কান খোলা রাখলেই) বাংলাসহ সব মাতৃভাষাই টিকে আছে গণমানুষের ভালোবাসায়। তাই মুসলমান শরীফ বান্দারা যেমন আরবী ফারসী বা উর্দুতে আশ্রয় খুঁজেছেন তেমনি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আশ্রয় খুঁজেছেন সংস্কৃতে। তাই বাংলাসহ সকল লোকভাষার বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ফতোয়া জারী করেছিলেন-
”অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানব: শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।” অর্থাৎ যারা অষ্টাদশ পুরাণ, রামচরিত (রামায়ন) মানবসৃষ্ট ভাষায় (বাংলাও এর অন্তর্গত) শ্রবণ করবে, তারা রৌরব নরকের আগুণে ভষ্মিভূত হবে। এসব ফতোয়ায় যে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাংলার গণমানুষ কান দেননি তার প্রমান বাংলা ভাষায় রচিত হাজার হাজার পুঁথি,কবিতা,গান। যাতে রামচরিতসহ ধর্মের প্রসঙ্গ ছিলো পরতে পরতে।

কবি গীতিকাররা নানা কালে বাংলা ভাষার পক্ষে কলম ধরেছেন। এতে অনুমান করা যায় বাংলার বিপক্ষে সমাজের কোথাও না কোথাও একটা বৈরিতার আভাস তাঁরা পেয়েছিলেন। নইলে কবি শেখ আবদুল হাকিম প্রায় চারশ’ বছর আগে মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে কেন এমন ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন-
”যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।” (নূরনামা)

উনবিংশ শতাব্দীতে রামনিধি গুপ্ত গেয়েছেন-
”নানানা দেশে নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা।।” (রাগ: কামোদ খাম্বাজ-জলদ তেতালা)

মধুসূদন দত্ত কম বয়সে বাংলার বিপক্ষে দাঁড়াবার সমস্ত অনুতাপ এক কবিতাতেই যেন মিশিয়ে দিলেন-
”ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘওে !”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।। (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

রৌরব নরকের ভীতি প্রদর্শন যে কাজে লাগেনি তার প্রমান অতুল প্রসাদের সেই মিষ্টি গান-
”মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা !
...........ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
...........ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হলে কাঁদা হাসা।।” (ঊনবিংশ শতকের গীতিকবিতা সংকলন)

হরি বোল দেবেন তিনি বাংলায় ! সবচেয়ে বড়ো কথা, স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর ভক্তিবাদী বৈষ্ণব ধর্মমত প্রচার করেছেন বাংলা ভাষায়!

বাংলা ভাষার প্রতি কবিসাহিত্যিকদের এমন পৃষ্ঠপোষকতা চিরকালই ছিলো। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোন প্রকার সিদ্ধান্ত হবার আগেই পাকিস্তান হয়ে গেলো। এর মধ্যেই দেখা গেলো ডাকটিকিট,পোস্ট কার্ড, মানি অর্ডার ফরমে ইংরেজী আর উর্দু ভাষাকে মুদ্রিত পাওয়া যেতে থাকলো। শিক্ষিতসমাজে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিক্রিয়া হলেও সংগঠিত কোন প্রতিবাদ হলো না। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় তমুদ্দুন মজলিশ। ১৫ সেপ্টেম্বর তমুদ্দুন মজলিশ ’পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা-বাংলা না উর্দু?’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এতে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা ’রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’, আবুল মনসুর আহমদের ’বাংলা ভাষাই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেমের ’আমাদের প্রস্তাব’। সবাই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। তমুদ্দুন মজলিশের সদস্য অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে অাহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানাভাবে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচারনা আরম্ভ হয়। ৪৭-এর ২৭ নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সভা করে দাবী জানায়, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষা হতে হবে বাংলা। সভা শেষে বিশাল এক প্রতিবাদ মিছিল হয়।

এরপর ছাত্রসংগঠনগুলোও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হয়। নিয়মিত সভা সমাবেশ মিছিল চলতে থাকে। এরমধ্যে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে ছাত্র শিক্ষক,সাহিত্যিকসহ সবাই অংশ নিতে থাকেন। ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৬ ফেব্রুয়ারী ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারী ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মার্চ আবার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১১ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। ধর্মঘটে পিকেটিংকালে ব্যাপকহারে লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে ১২-১৫ মার্চ আবার ধর্মঘট আহবান করা হয়। আন্দোলনের মুখে খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠক করে কিছু দাবীদাওয়া মেনে নেন। ১৯ মার্চ গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। এসেই উর্দুর পক্ষে ওকালতি করেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপর ছাত্ররা প্রতিবাদ করেন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে হরতাল সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারী সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। পুলিশ গুলী চালায় বিকাল ৩টার পরে। পুলিশের গুলীতে আবদুল জাব্বার ও রফিকউদ্দিন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পরে শহীদ হন আব্দুস সালাম,আবুল বরকত প্রমুখ। এ সংবাদ জানার পর মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ আইনপরিষদ সদস্যরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। সাধারন মানুষ আন্দোলনে অংশ নেন। সারা দেশ হয়ে পড়ে অগ্নিগর্ভ। ২৩ তারিখে শহীদদের স্মরণে তৈরী হয় শহীদ মিনার। আমাদের মহান ভাষা শহীদ হলেন (জানা মতে) আট জন-১.রফিক উদ্দিন,২.আবদুল জাব্বার,৩.আবুল বরকত,৪.আবদুস সালাম,৫.শফিউর রহমান, ৬.অহিউল্লাহ, ৭.আবদুল আওয়াল,৮.নাম না জানা একজন কিশোর।

১৯৫৩ সাল থেকে আমরা ভাষা শহীদদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস হিসাবে পালন করছি।

১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হলেও ভাষা নিয়ে অসন্তোষ থেকেই যায়। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ভাষা সংগ্রাম চলতেই থাকে। সৈয়দ মাহবুবুল আলম চৌধুরী লেখেন ভাষা শহীদ স্মরণে প্রথম কবিতা (কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি)। অসংখ্য কবিতা লেখেন আমাদের প্রায় সকল কবি। আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখেন ’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি , যা আমাদের অমর একুশের অপরিহার্য অংশ। বহু গান লেখা হয়েছে ভাষা শহীদদের স্মরণে। মুনীর চৌধুরী লিখেছেন ’কবর’-এর মতো অবিস্মরণীয় নাটক, জহীর রায়হান লিখেছেন ’আরেক ফাল্গুন’ নামের স্মরণীয় উপন্যাস।

মূলত: ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে ওঠে। সে চেতনার ধারাবাহিকতায় আমরা ত্রিশ লক্ষ প্রানের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা প্রকৃতপক্ষে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। এখন সর্বস্তরে বাংলা সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আমাদের ভাষা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠত্ব

আমাদের ভাষা আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ভাষার লড়াইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমরা বহু ত্যাগের বিনিময়ে ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছি। সবচেয়ে বড়ো কথা আমাদের ভাষা আন্দোলন পেয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারীকে ”আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সে থেকে সারা পৃথিবী আমাদের ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন সারা পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের, মাতৃভাষা রক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যা আমাদের ভাষা আন্দোলনকে বিশ্ব সেরার আসনে বসিয়েছে। এখানেই আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব। শ্রেষ্ঠ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা যে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে রক্ষা করেছি ভাষা হিসাবেও বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত। এবার বলছি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের সেই মহিমা।

বাংলা ভাষার অপার মহিমা

ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনায় বাংলা ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলোর পাশে আসন পাবার হকদার। বাংলা ভাষার এ বিপুল মহিমা আমাদের জাতিগত অহঙ্কারের প্রতীক, আমাদের পূর্বসূরীদের মণীষার উচ্চতার নিদর্শন। বাংলা ভাষার মতো বৈজ্ঞানিক, সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল ভাষা বিশ্বে দুর্লভ। একটি ভাষার শক্তি বুঝতে হলে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হয় সেগুলো হচ্ছে ধ্বনিবিন্যাস (phonology), শব্দ-গঠন পদ্ধতি (morphology), বাক্য-গঠন পদ্ধতি (syntax), ব্যাকরণ (grammar), বাগবিধি (idiom) ও বর্ণমালা (script)। বাংলা ভাষার প্রেক্ষিতে বিষয়গুলো পরীক্ষা করা যেতে পারে।

ধ্বনিবিন্যাস (phonology)

ধ্বনিবিন্যাস বলতে কোন নির্দিষ্ট ভাষায় মানুষের কণ্ঠোচ্চারিত ধ্বনিগুলোর ব্যবহার পদ্ধতিকে বোঝায়। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বাক-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিসমূহের যে সুপরিকল্পিত ও সুষম বিন্যাস দেখা যায়, তার পরিধি (range), সূক্ষ্মতা (precision) ও যথার্থতার (accuracy) কথা চিন্তা করলে বিস্মিত হতে হয়। বাংলায় ৩৭টি ধ্বনিবর্গ বা মূলধ্বনি (phoneme) ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে ব্যঞ্জনধ্বনি ৩০টি, স্বরধ্বনি ৭টি। শুধু অর্ধ-ব্যঞ্জনধ্বনি(w) ছাড়া সব ধ্বনির জন্য বাংলায় বর্ণ আছে। কিছু ধ্বনির জন্য বাড়তি বর্ণও আছে। ফলে বাংলা শব্দের উচ্চারণ শুনে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শুদ্ধভাবে শব্দটি লেখা যায়, আলাদা করে বানান বলে দিতে হয় না। পাশাপাশি ইংরেজীর কথা বিবেচনায় নিলে দেখা যায় বেশিরভাগ শব্দের বানান বলে না দিলে উচ্চারণ শুনে শুদ্ধ করে শব্দটি লেখা সম্ভব হয় না। বাংলা বানান দুটি স্বরবর্ণ আর দু’একটি ফলা বাদ দিলে আদর্শ ধ্বনিতত্ত্ব সম্মত (phonetic)। তারপর বিভিন্ন ধ্বনির প্রতীক বর্ণগুলির উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী বিভিন্ন বর্ণে অতি সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শ্রেণীবদ্ধ করে সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে। এতে বর্ণ শিখতে যেমন সুবিধা হয় তেমনি তাদের প্রকৃত ধ্বনিতত্ত্বগত পার্থক্য কোথায় তা বুঝতে সাহায্য করে। যেমন-’কাল’, ’খাল’ এবং ’গোল’,ঘোল’ শব্দগুলোতে ধ্বণিগত ও অর্থগত পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়।

শব্দ গঠন পদ্ধতি (morphology)

এটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড়ো শক্তিগুলোর একটি। শব্দ গঠন পদ্ধতি বলতে বোঝায় উপসর্গ (prefixes), প্রকৃতি (stem) ও প্রত্যয় (suffixes) যুক্তক করে কিভাবে শব্দ গঠিত হয়-সে বিষয়টি। এদিক থেকে বাংলা ভাষার অদ্ভুত শক্তি। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় ২১টি বাংলা উপসর্গ (অ,অজ,অনা ইত্যাদি), ২০টি তৎসম উপসর্গ (প্র,পরা,অপ ইত্যাদি), ১০টি ফারসি উপসর্গ (নিম, ফি, বে ইত্যাদি), ৪টি আরবী উপসর্গ (আম,খাস,লা,গর), ৪টি ইংরেজী উপসর্গ (ফুল,হাফ,হেড,সাব) এবং ১টি উর্দু-হিন্দী উপসর্গ (হর)। এগুলো ধাতু ও শব্দের শুরুতে ব্যবহার করে অসংখ্য নতুন শব্দ তৈরি করা সম্ভব। যেমন ’বাদ’ ধাতুর সাথে বিভিন্ন উপসর্গযোগে ভিন্ন ভিন্ন অর্থবোধক শব্দ গঠন করা হয়েছে-প্রবাদ, বিবাদ, সুবাদ, অনুবাদ,অপবাদ,সংবাদ,প্রতিবাদ ইত্যাদি। এরপর রয়েছে প্রত্যয়যোগে শব্দগঠনের অপার সুবিধা। বাংলা, সংস্কৃত ও বিদেশী প্রত্যয় ধাতু বা অধাতু শব্দের সাথে মিলিয়ে অসংখ্য শব্দ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। ধাতুর সাথে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত করে প্রাথমিক শব্দ গঠন করা হয়। যেমন- পড়+আ=পড়া, ঘাট+তি=ঘাটতি। অধাতু শব্দের সাথে তদ্ধিত প্রত্যয় যুক্ত হয়ে প্রচলিত শব্দে নতুন অর্থ বা পরিসর দান করা যায়। যেমন-হাত+আ=হাতা। প্রচলিত ’হাত’ শব্দের সাথে আ যুক্ত হয়ে নতুন অর্থ হলো জামার যে অংশ হাত ঢেকে রাখে অর্থাৎ হাতা। এর বাইরে আছে সন্ধি, সমাস, অনুসর্গ ব্যবহার করে নতুন নতুন অসংখ্য শব্দের ভান্ডার গড়ে তোলার সুবিধা। সন্ধির নিয়মাবলী সুনির্দিষ্ট। যা সহজেই অনুসরন করা যায়।

বাক্য-গঠন পদ্ধতি (syntax)

বাক্য-গঠন পদ্ধতিতে বাংলা ভাষার সারল্য ও দক্ষতা বিস্ময়কর। বাংলা বাক্যে সাধারণত কর্তা,কর্ম, ক্রিয়া এ পর্যায়ক্রম ব্যবহার করা হয়। যেমন-সে খোকাকে মেরেছে। মজার ব্যাপার হলো এ তিনটি শব্দকে যে কোন ভাবে স্থান পরিবর্তন করে লেখা যায়। যেমন- খোকাকে সে মেরেছে, খোকাকে মেরেছে সে, মেরেছে সে খোকাকে, মেরেছে খোকাকে সে, সে মেরেছে খোকাকে। এভাবে পরিবর্তন করতে বাংলা ভাষায় ব্যকরণগত কোন বাধা নেই। এতে বাক্যের অর্থের হানি হচ্ছে না। বরং অর্থের গুনগত প্রসার ঘটছে। এছাড়া বাংলা বাক্যের শব্দক্রমে বেশ কিছু সুন্দর ও কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: ১.বাংলা বাক্য বেশ সংক্ষিপ্ত। যেমন-আমি বাড়ি যাই। ২.বাংলায় ক্রিয়াপদ ছাড়াই বাক্য গঠন করা সম্ভব। ইংরেজীতে তা সম্ভব নয়। যেমন- আমার বাড়ি ঢাকা। মাত্র তিনটি শব্দ। এখানে ক্রিয়াপদ নেই। ইংরেজীতে বাক্যটি হবে-My home is in Dhaka. এখানে শব্দ লেগেছে পাঁচটি। সাথে আছে ক্রিয়াপদও। ৩.বাংলায় প্রশ্নবোধক ও না-বোধক বাক্যে কোন সহকারী ক্রিয়াপদের দরকার হয় না। তাই বাক্যের শব্দক্রম বদলে কোন সমস্যা হয় না। একটি প্রশ্নবোধক বাক্য-তোমার নাম কি? এর উত্তর-আমার নাম মাসুম। দুটি বাক্যের শব্দক্রম একই। ইংরেজীতে প্রশ্ন আর জবাবে শব্দক্রম ভিন্ন। যেমন-What is your name? My name is Masum. বাংলা না-বোধক বাক্যেও এর ব্যতিক্রম নেই। যেমন-আমি টাকা চাই-আমি টাকা চাই না। একটি ’না’ যুক্ত করেই কাজ সারা গেলো। ইংরেজীতে সেটা সম্ভব নয়। এর জন্য একটি সহকারী ক্রিয়াপদ লাগে। যেমন- I want money.-I do not want money. নাম পুরুষ হলে ঝামেলা আরো বাড়ে। Want-এর সাথে একটা বাড়তি s দিয়ে সেটা Wants হয়। সেটা না-বাচক করতে সহকারী ক্রিয়ার সাথে ‘s’ বা ‘es’ জুড়ে দিতে হয়। ৪.বাংলায় বিশেষণ পদ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদ একইভাবে যথাক্রমে বিশেষ্যের ও বিশেষণের পূর্বে ব্যবহৃত হয়। যেমন-মাসুদ ভালো মানুষ। ’ভালো’ বিশেষণটি বিশেষ্য ’মানুষ’-এর আগে বসেছে। সে জোরে দৌড়ায়। এখানে ’জোরে’ ক্রিয়া-বিশেষণ পদটি ক্রিয়াপদ ’দৌড়ায়’-এর আগে বসেছে।

ব্যাকরণ (grammar)

ওপরে বাংলা ভাষার যে সব গুণের কথা বলা হলো সেগুলো ছাড়াও বাংলা ব্যকরণে পদ-প্রকরণ, বচন, লিঙ্গ, পুরুষ, কাল, কারক ইত্যাদি বিষয়ে চমৎকার আলোচনা রয়েছে। যা ভাষা ব্যবহারকারীদের জন্য খুবই সহায়ক। পদ-প্রকরণে আমরা দেখি বাংলায় বিশেষ্য থেকে বিশেষণ (ধর্ম-ধার্মিক) অথবা বিশেষণ থেকে বিশেষ্য (ভদ্র-ভদ্রতা) দু’ভাবেই পদ সাধনের সুযোগ আছে। এটাও বাংলা ভাষার এক বিশেষ শক্তি। শুধু তাই নয়, ক্রিয়াপদ থেকে বিশেষ্য এবং তার থেকে বিশেষণ পদ গঠন করা যায়। যেমন-খেলা (ক্রিয়াপদ)-খেলোয়াড়(বিশেষ্য)-খেলোয়াড়সুলভ(বিশেষণ)। বাংলায় ক্রিয়াপদের বা ক্রিয়ার ধাতুর অপ্রতুলতার ঘাটতি মোকাবেলার জন্য আনুষঙ্গিক শব্দ জুড়ে দেয়ার বিধান রয়েছে। যেমন-যুদ্ধ করা, পালন করা ইত্যাদি। অন্য দিকে যৌগিক ক্রিয়া গঠনের জন্য অসমাপিকা ক্রিয়ার সাথে সমাপিকা ক্রিয়া জুড়ে দেবার দরকার হয়। যেমন-উঠে যাওয়া, শুয়ে পড়া ইত্যাদি। ইংরেজীতেও এর প্রচলন আছে-get on, lie down. মধুসূদন দত্ত নামধাতু ব্যবহার করে ক্রিয়ার ধাতুর অভাব পূরণের চেষ্টা করেছেন। যেমন- পালিলাম,স্মরিনু, আঘাতিল ইত্যাদি। সেটা অবশ্য বাংলায় আর কেউ অনুসরণ করেননি। তবে কথ্য বাংলায় ধাতুজ ক্রিয়াপদের ব্যবহার বাড়ছে। যেমন- শ্রবণ করা-শোনা, পালন করা-মানা, মোচন করা-মোছা ইত্যাদি। এভাবে বাংলা ক্রিয়াপদের অভাব পূরণের চেষ্টা ফলবান হচ্ছে।

বচন,লিঙ্গ ও পুরুষ-এগুলোর বিষয়ে বাংলা ভাষার অবস্থান বেশ শক্ত। বাংলায় দুটি বচন-একবচন ও বহুবচন। আরবী ও সংস্কৃতে দুটির বেশী বচন আছে। বাংলায় রা,গুলি,এরা ইত্যাদি বিভক্তি যোগ করে এক বচনকে বহু বচনে পরিণত করা হয়। ইংরেজীর মতো (Man-Men, Child-Children) অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলায় বচন পরিবর্তনের নিয়ম দুর্লভ। আবার সর্বনাম বা অব্যয়পদ জুড়ে দিয়ে বহুবচন করার সময় বিশেষ্য পদে বহুবচন চিহ্ণ ব্যবহার করা হয় না- এসব বই, সমস্ত লোক ইত্যাদি। এটাও ভাষার একটা শক্তি, কারণ এতে শব্দের সাশ্রয় হয়। বাংলা ক্রিয়াপদের বচন নেই এটাও ভাষার একটা সাশ্রয়। এটা থাকলে ক্রিয়াপদের আরো রূপভেদ বাড়তো।

বাংলা ভাষায় লিঙ্গের (Gender) রূপভেদ নেই বললেই চলে। যেমন- মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে,ভাই-বোন এসব শব্দে যে পার্থক্য সেটা প্রকৃতিগত, শব্দের রূপগত পার্থক্য নয়। বালক-বালিকা, মানব-মানবী, দাস-দাসী এরকম শব্দের রূপের এ পার্থক্য বাংলায় এসেছে সংস্কৃত থেকে। বাংলার নিজস্ব পদ্ধতি শব্দের রূপগত নয়। বাংলা ভাষার আরেকটা বড়ো সুবিধা, বাংলা ক্রিয়াপদেরও লিঙ্গ-ভেদের আলাদা চিহ্ণ নেই। এটা ভাষার জটিলতা কমাতে সাহায্য করে। যেমন- রহিম খায়। রহিমা খায়। লিঙ্গ-ভেদের জন্য ক্রিয়াপদের রূপ বদল হয়নি। আরবী ও উর্দু ভাষায় মোজাক্কর, মোয়ান্নস (পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ ভেদ) এক দুরূহ ব্যাপার।

বর্ণমালা (script)

বাংলা ভাষার সব চেয়ে বড়ো সম্পদ বাংলা বর্ণমালা। এমন সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল বর্ণমালা বিশ্বে খুব বেশি নেই। বাংলা বর্নমালায় বর্ণ ৫০টি। ১১টি স্বরবর্ণ,৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ। ধ্বনিগত বিচারে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা করে বিন্যস্ত রয়েছে। ইংরেজী বা আরবীর মতো উন্নত ভাষায়ও স্বরধ্বনি আর ব্যঞ্জনধ্বনি পৃথক করা নেই। স্বরধ্বনির হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের জন্য পৃথক বর্ণ আছে এবং সমজাত স্বরের হ্রস্ব ও দীর্ঘ ধ্বনির প্রতীক বর্ণগুলি পর পর সাজানো আছে (ই ঈ উ ঊ)। বাংলা স্বরবর্ণগুলো বিশুদ্ধ স্বরধ্বনি (pure vowels), ইংরেজীর মতো দ্বৈতস্বর ((diphthong) বিশিষ্ট নয়।

বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী বিভিন্ন বর্গে শ্রেণীবদ্ধ। এটি সূক্ষ্ম ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ফল এবং ধ্বনিবিজ্ঞানের দিক থেকে নি:সন্দেহে এক মহৎ কীর্তি। প্রতিটি বর্গের অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ বর্ণগুলো এবং ঘোষ ও অঘোষ বর্ণগুলো পাশাপাশি আছে। যেমন- ’ক’ বর্গের সব বর্ণের উচ্চারণ জিহ্বামূল। তাই এগুলোর নাম কণ্ঠ্য বর্ণ। ’চ’ বর্গের সব বর্ণ তালব্য বর্ণ, ’ট’ বর্গের সব বর্ণ মূধ্যর্ণ বর্ণ, ’ত’ বর্গের সব বর্ণ দন্ত্য বর্ণ, ’প’ বর্গের সব বর্ণ ওষ্ঠ্য বর্ণ। বাংলা অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনি যে স্বতন্ত্র ধ্বনিবর্গের অন্তর্গত এটা এ দেশের প্রাচীন ধ্বনিবিদগণ বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের জন্য স্বতন্ত্র চিহ্ণ উদ্ভাবন করেছিলেন। সেগুলোর সাদৃশ্য বিবেচনা করে পাশাপাশি রেখেছিলেন। যেমন-ক(অল্পপ্রাণ), খ (মহাপ্রাণ), গ(অল্পপ্রাণ), ঘ(মহাপ্রাণ), চ(অল্পপ্রাণ), ছ(মহাপ্রাণ), জ(অল্পপ্রাণ), ঝ(মহাপ্রাণ)। একই ভাবে অঘোষ ধ্বনি ও ঘোষ ধ্বনি পাশাপশি আছে। যেমন-ক খ(অঘোষ ধ্বনি), গ ঘ(ঘোষ ধ্বনি), চ ছ (অঘোষ ধ্বনি), জ ঝ (ঘোষ ধ্বনি)। সকল বর্গের ক্ষেত্রেই এ বিন্যাস বজায় রাখা হয়েছে। সকল বর্গের শেষ বর্ণ নাসিক্য বর্ণ (ঙ,ঞ,ণ,ন,ম)।

বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ সুনির্দিষ্ট, কোথাও তাদের নড়চড় হয় না। ইউরোপীয় বর্ণমালার মতো বিভিন্ন শব্দে তাদের বিভিন্ন উচ্চারণ হয় না। যেমন-যে একবার অক্ষরগুলো চিনেছে সে বানান করে সব শব্দ শুদ্ধ করে পড়তে পারবে। আরবী বা ইংরেজী ভাষায় তা পারা না। তাছাড়া বাংলা বর্ণ শব্দের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন চেহারা নেয় না। যেমন আরবীতে হয়। তবে স্বরবর্ণগুলি বাক্যের মধ্যে স্বরচিহ্ণের (া, ,ি ী ইত্যাদি) আকার ধারণ করে। আরবী হরকত সে তুলনায় বেশ জটিল। ব্যাকরণ খুব ভালো জানা না থাকলে আরবী পড়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলা ভাষার সব চেয়ে বড়ো গুণ এই ভাষায় মানুষের উচ্চারিত সব ধ্বনির জন্যই একেকটি করে বর্ণ আছে। সে জন্য অন্য ভাষার শব্দ বাংলায় লিখতে গেলে সমস্যা হয় না বা বিকৃতভাবে লিখতে হয় না। ইংরেজী তথা রোমান বর্ণে ’তিতির’ লেখা সম্ভব না। কারণ সেখানে ’ত’ এর শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য কোন বর্ণ নেই। কিংবা আরবীতে ’পাতা’ লেখা সম্ভব নয় কারণ আরবীতে ’প’-এর জন্য কোন বর্ণ নেই। মানুষ যা উচ্চারণ করতে পারে তা বাংলা ভাষায় লিখে দেয়া সম্ভব। এটা যে কোন ভাষার জন্য বিরাট গৌরবের ব্যাপার।

বাংলা ভাষার একটা আপেক্ষিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা দরকার। সেটা হচ্ছে যুক্তবর্ণ। বাংলা ভাষায় তিন ধরণের যুক্তবর্ণ আছে- পাশাপাশি (চ্চ,ধ্ব), ওপরে নীচে (স্ব, ন্ব) আর পাশাপাশি ও নীচে (ন্দ্ব, ন্ধ)। সনাতন মুদ্রন পদ্ধতি বা টাইপরাইটারের কালে এটা বড়ো সমস্য ছিলো। এখন আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সেটা আর বড়ো সমস্যা নয়। অনেকগুলো কি-বোর্ড তাদের হয়ে সাক্ষ্য দেবে। রোমান বর্ণমালায় লেখা ভাষাগুলো ছাড়া প্রায় সব প্রধান ভাষায় (আরবী,ফারসী,উর্দু,হিন্দী) যুক্তাক্ষর আছে। এরপরও মনে দ্বিধা থাকলে চীনা বা জাপানী ভাষার দিকে তাকান। বাংলাকে পানির মতো মনে হবে। বর্ণ সংখ্যায়ও বাংলার অবস্থা সুবিধাজনক। আরবী,ফারসী বা উর্দুতে বাংলার চেয়ে বর্ণ কম। কিন্তু মানুষ উচ্চারণ করতে পারে এমন বহু শব্দই সেসব ভাষা শুদ্ধ করে লেখা সম্ভব নয়। ইংরেজী তথা রোমান বর্ণমালায় ২৬টি বর্ণ থাকলেও কার্যত: সংখ্যাটা ১০৪। ইংরেজী ছাপার বড়ো হাতের ২৬টি, ছাপার ছোট হাতের ২৬টি, লেখার বড়ো হাতের ২৬টি এবং লেখার ছোট হাতের ২৬টি। কারণ সব বর্ণই কোন না কোনভাবে পৃথক। জাপানী বর্ণমালা (কাঞ্জি) ২১৬টি। চীনা ভাষার সর্বনিম্নস্তরের (ইংরেজীতে বলে কারেক্টার,কার্যত: এটা অনেকটা ইংরেজী সিলেবলের মতো) দশ হাজার চিহ্ণ আছে। কাজ চালাতে হলে হাজার চারেক চিহ্ণ শিখতে হয়। ৫০টি বর্ণ, ১০টি স্বরচিহ্ণ, কিছু রূপ বদলে যাওয়া যুক্তাক্ষর শিখতে হয় বাংলায়। খুব কি অসম্ভব ব্যাপার ?

উচ্চারণ ও বানান রীতি

বাংলা উচ্চারণ শেখার জন্য বাংলা ব্যাকরণে সুনির্দিষ্ট সূত্রাবলী রয়েছে। সে সব সূত্র একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই আয়ত্ত্ব করা যায়। সূত্রে ফেলে প্রায় সব শব্দ শুদ্ধ করে উচ্চারণ করা যায়। বাজারে বেশ কিছু উচ্চারণ অভিধানও পাওয়া যায়। ণত্ব ও ষত্ব বিধান আর বানান রীতির সূত্রাবলী আত্মস্থ করলে বেশিরভাগ শব্দ শুদ্ধ করে লেখা সম্ভব। বাংলা একাডেমি বানানের সংস্কার করে সূত্রাবলী স্থির করে দিয়েছে।




আরো কিছু আশার কথা

বাংলা ভাষার বিকাশের সম্ভাবনা অপরিসীম। শক্তিশালী কাঠামোর পাশাপাশি খুবই মেলোডিয়াস ভাষা বাংলা। অনুসর্গ, উপসর্গ, প্রকৃতি প্রত্যয়. সন্ধি, সমাস ইত্যাদির মাধ্যমে অসংখ্য শব্দ সৃষ্টির সুযোগ আছে। রয়েছে বাগধারার মাধ্যমে নতুন মাত্রা যুক্ত করার সম্ভাবনা। ধন্যাত্মক বা শব্দ দ্বিরুক্তি দিয়ে ধ্বণির মাধুর্য বাড়াবার সুযোগতো রয়েছেই। দেশী শব্দের পাশাপশি তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব আর বিদেশী শব্দে সাজানো বাংলা শব্দভান্ডার। বাংলা ভাষায় শব্দ বাড়াবার একটা বিশাল সম্ভার রয়েছে আঞ্চলিক শব্দে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি বের করেছে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। আমাদের মেধাবী লেখকরা দারুন দক্ষতায় ব্যবহার করে চলেছেন আঞ্চলিক শব্দ। বাংলা ভাষার অকল্পনীয় শক্তির জায়গা হচ্ছে বিদেশী শব্দ গ্রহণ করার সামর্থ্য। মানুষের সকল উচ্চারণকে ধারণ করার সামর্থ্য আছে বাংলা বর্ণমালার। তাই বিদেশী শব্দ শুদ্ধভাবে লেখা যায় বাংলা হরফে। বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষার বাক্যের মধ্যে ব্যবহার করা যায়। ধ্বনিগত বা অর্থগত কোন সমস্যা হয় না তাতে। কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মতো ইংরেজী শব্দ হুবহু ব্যবহার করা যায় বাংলায়। যেমন-আমি ল্যাপটপ ব্যবহার করি। করিম কম্পিউটার কিনেছে। নজরুলতো বাংলা কবিতা বা গানে আস্ত লাইন ব্যবহার করেছেন বিদেশী ভাষায়। যেমন- ’নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া/আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’ ( মোহররম)। কিংবা ’আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফাস গ্যায়ি’ (গজল)।

সমাপনী

ভাষা নিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের বাইরে ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্বেরও শেষ নেই। ভাষা নিয়ে দোটানায় থাকার কারণ কখনো আর্থ-সামাজিক, কখনো ধর্মীয়। ভাষা নিয়ে এ রকম মানসিক দ্বন্দ্বে পড়েছিলেন স্বয়ং স্যার আইজাক নিউটন। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে প্রথমবারের মতো ইংরেজী ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। তখন সারা ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যম ছিলো ল্যাটিন। সেটাই ছিলো বিজ্ঞানের জন্য ’লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। সে জন্যই ইংরেজীর তুলনায় ল্যাটিনের দুনিয়া ছিলো বৃহত্তর। বিজ্ঞান সাধনার জন্য ইংরেজী ভাষার দুর্বলতাকে (কারিগরী শব্দভান্ডারের ঘাটতি, ব্যাকরণের দুর্বলতা) প্রবল বাধা হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সে কারণে রয়াল সোসাইটি ১৬৬৪ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজী ভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ইংরেজ বিজ্ঞানী নিউটন তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ’প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ লিখেছেন ল্যাটিন ভাষায়। পরে অবশ্য তিনি তাঁর আলোক সম্পর্কিত গ্রন্থ ’অপটিকস’ ইংরেজীতেই লিখেছেন।

সাহিত্যেও এর নজীর আছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষাকে তাঁর প্রতিভা প্রকাশের অনুকূল মনে করেননি। তিনি ইংরেজী ভাষায় লিখতে চাইলেন ’প্যারাডাইস লস্টে’র মতো মহাকাব্য। তাঁর ইংরেজী কাব্য জবরদস্ত হবার পরও ইংরেজ সমাজে কল্কে পেলো না। তিনি ফিরে এলেন মাতৃভাষা বাংলায়। সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবও ভাষার দ্বন্দ্বে পড়লেন। রাজভাষা ফারসীতে লিখে বৃহত্তর সমাজের কাছে পরিচিত হবেন ? নাকি স্বল্প প্রচলিত মাতৃভাষা উর্দুতে লিখবেন ? ফারসিতে লিখেছিলেন কবিতা। সে কবিতার কোন হদিস নেই। মাতৃভাষায় লেখা গালিবের গজল উর্দু সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসন পেয়ে গেলো। একই সমস্যায় পড়ে আল্লামা ইকবাল ফারসী ভাষায় লিখলেন ’আসরারে খুদি’ (আত্মার গান)। কিন্তু অমরত্ব পেলেন মাতৃভাষা উর্দুতে লেখা ’শেকোয়া’, ’জওয়াবে শেকোয়া’ ইত্যাদির জন্য।

সব সময় সুবিধাভোগী অভিজাতরা হীনস্বার্থে মাতৃভাষা ছেড়ে পরদেশী ভাষার কাছে আত্মসমর্পন করেছেন। মাতৃভাষা ধরে রেখেছেন গণমানুষ। ভাষার জন্য লড়েছেন, রক্ত দিয়েছেন। সালাম বরকত তথাকথিত অভিজাত সমাজের কেউ ছিলেন না, ছিলেন গণমানুষের অন্তর্গত। তাঁরা প্রাণ দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র্রভাষার সম্মানে আসীন করেছেন। মাতৃভাষা বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কোন দ্বিধা ছিলো না কোন ভাষা সৈনিকের মনে।



কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

১. বাংলা সাহিত্যের কথা-ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
২. ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী-রফিকুল ইসলাম।
৩. Benefits of linguistic diversity multilingualism-Durk Gorlal et al.
৪. A Short History of the International Language Movement-Albert Leon Guerard
৫. পারস্য প্রতিভা-মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ ।
৬. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণী-জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,ঢাকা।
৭. বাংলা ভাষা : বিবিধ প্রবন্ধ-মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী।
৮. পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা-সৈয়দ মুজতবা আলী।
৯. উইকিপিডিয়া।
১০. Colonial Language Classification,Post-colonial Language Movements,And the Grassroots Multilingualism Ethos in India-Annie Montaut

( শিল্প ও সাহিত্যের ত্রৈমাসিক-অনুপ্রাণন-এর তৃতীয় বর্ষ ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত )
১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×