somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিনায়ক সেনের আরেকটি অসাধারণ লেখা

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



[ড.বিনায়ক সেন মূলত অর্থনীতিবিদ। ১৯৮৬ সালে তিনি সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের সাথে সম্পৃক্ত স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা-বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এ গবেষক হিসাবে যোগদেন। বর্তমানে তিনি বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক। তিনি ১৯৮২ সালে মস্কো লোমোনোসভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিস্টিংশনসহ অর্থনীতিতে এমএসসি এবং ১৯৮৫ সালে মস্কোর রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ইন্সটিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ হতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বিশ্ব ব্যাংকের কনসালটেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, এডিবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশে বিদেশে বিভিন্ন গবেষণা/ রিপোর্ট প্রণয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবেও কাজ করেছেন। তিনি বহু গবেষণা ভিত্তিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থের প্রণেতা। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এ খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, গবেষকের একটি অসাধারণ লেখা আগে শেয়ার করেছি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তাঁর আরেকটি অসাধারণ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক সমকালের সাহিত্যের ম্যাগাজিন কালের খেয়াতে ১৫ জুলাই ২০১৬ তারিখের সংখ্যায়। সেটি লিঙ্ক আকারে শেয়ার করেছিলাম সামুতে। লিঙ্কটি প্রায়ই কাজ করে না বলে সে লেখাটিও সরাসরি শেয়ার করলাম]

হুমায়ূন ও তাঁর মধ্যাহ্নের সমাজ

১. কেন মধ্যাহ্ন উপন্যাসটি লিখতে হলো তাকে - এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, 'সময়কে' ধারণ করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তার চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ; সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগুলো মানুষ, তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যই নাকি তাকে 'একা এবং কয়েকজন', 'সেই সময়', 'পূর্ব-পশ্চিম' ও 'প্রথম আলো'র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তার নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এ রকম :'আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসেনি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি, সমস্যাটাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগুতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও...'এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, 'তারপরেও' বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। 'মধ্যাহ্ন' উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপড়েনের মধ্যে তাকে প্রবেশ করতে হলো- সেটা একটা প্রশ্ন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব- সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের প্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প- এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যার একজন হরিচরণ সাহা, অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সুফী-সন্তই বলা চলে তাদের- যারা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত। তারাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র - ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্র সবাই এদেরকে নিয়েই, এদেরকে পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো মৃত্যুবরণ করে। মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষ হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যারা, তারাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তারা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর- এরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছে। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্র সন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত; খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে। 'সাহা' যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এ উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা 'মৈমনসিংহ গীতিকা'য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে- সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহ্নের সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। উনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়; জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান; রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে; সেটা হিন্দুর, নাকি মুসলমানের; মজুরের, নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের- সেটা বের করা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি। এ রকম সমাজের কাহিনী কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবে তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু 'সময়'কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তার। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্য। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙুল দিয়ে।

২. রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিষ্কৃতি নাই।' মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশী আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল- ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে এক দল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়; এক পক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা ও হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে। পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এ উপন্যাসে। আমি এখানে দু'একটি উদাহরণ দেব।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুর চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষ্মণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে, অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, 'মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।' মওলানা তাতেই খুশি। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন, যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিন্দুর দেওয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে :'দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন।' রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে, তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভালো। স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, 'জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। ... তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?' আপাতত সম্মতি দিলেও চে গুয়েভারার চেয়ে কোনো অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুম্মার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুম্মার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্য। ইদ্রিসকে বহু দিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্য একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত-এর ১৩ নম্বর আয়াত স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা 'একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।' দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগি্ন করতে তার স্বধর্মের কেউ রাজি হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এ ক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এ জন্য কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তার বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, 'লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু-মুসলমান কী? লাশ নামাজ-কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না।' অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরানীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগদিপাড়ার মেয়ে ষোল-সতেরো বছর বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরানীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এর পর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক :'মওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।'

দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্র কি আছে এখনও আমাদের আশেপাশে কোথাও?

৩. তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসি-লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোনো শুভ-নীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই আমাদের 'মধ্যাহ্ন' অর্থাৎ 'স্বর্ণযুগ' বলছেন লেখক। আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ, এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহ্নে। 'অপরাহ্ন' কথাটা আমি 'লেট ক্যাপিটালিজম'-এর তাত্তি্বক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বাণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকে ও মানবসত্তাকে ক্রমাগত 'ব্যবহৃত-ব্যবহৃত' করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। 'অয়োময়'-এর মীর্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণির কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিল শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের 'জলসাঘর' চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে বিশ্বম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই। কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সঙ্গীতসভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু'তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু'দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে 'কৃষকের ইউটোপিয়া' গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।' হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ- তারা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে, শুভবোধকে, মঙ্গল কামনাকে। তারা সমাজকে অন্ধকার খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে সে আক্রান্ত। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎ সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। এক পর্যায়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। এই মৃত মায়ের নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনও আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি :'মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুর ঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।'

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, যেখানে সব গোত্র ও বর্ণের মানুষ মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহ্নের সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:৫৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×