তরু আজ ভীষন রকম রেগে আছে।অনেকদিন পর তার এমন রাগ হচ্ছে।এমন একটা ঘটনা ঘটবে সে ভাবতেও পারেনি।কি যে হবে ?এতক্ষনে হয়ত সবাই জেনে গেছে।তরুর হাজব্যান্ড কিছুক্ষন পর অফিস থেকে ফিরবে।সে বিষয় টা কিভাবে নিবে তা ভাবতে গিয়েই তরুর হাত পা অবশ হয়ে আসছে।ঘড়িতে এখন বিকাল তিনটা বেজে বাইশ মিনিট।এখনো গোছল খাওয়া কিছুই হয়নি।কতদিন পর যে এমন অনিয়ম হল ?এমনিতে তরু অসম্ভব রকম গোছানো মেয়ে।সে নিজে যেমন গোছানো থাকে ,তেমন চারপাশের সবাইকে জোর করে গোছিয়ে রাখতে চায়।তাতে কেউ বিরক্ত হলেও তার কিছু যায় আসে না।বেশী রকমের গোছানো মানুষদের কিছু বিচিত্র সমস্যা থাকে।যা অন্যদের হাসির উপকরন তৈরি করে।তরুর তেমনি কিছু বিচিত্র সমস্যা আছে।যেমন তার কিছুক্ষন পর পর সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়।দিনে যে কতবার ধুয়া হয় তার হিসাব নেই।তরুর হাজব্যান্ড একদিন ব্যাপারটি নিয়ে খুব হাসাহাসি করল সবাইকে নিয়ে।তরুর অনেক মন খারাপ হল।কিন্তু মুখে বলল না কিছু।মনে মনে বলল ,সবাই হাসে হাসুক।তুমি কেন হাসতে যাবে আমাকে নিয়ে?
রাগ করলেও তরু জানে তার স্বামী মানুষটা অতিশয় ভাল ।তার শশুরবাড়ির অন্য লোকেরাও যতেষ্ট ভাল।এই সংসারে তার ইচছা অনিচছার মূল্যায়ন হয়।যা তার নিজের বাড়িতে কখনও হয়নি।অবশ্য তরুও অন্যদের ইচছা অনিচছার মূল্য দিতে জানে।তরু বিয়ের আগে এতটা ভাল আশা করেনি।প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি বেশী হলে কার না ভাল লাগে।
তরুর হাজব্যান্ড অফিস থেকে আসার পথে প্রায়ই তার জন্য চকলেট কিনে আনে।তরুর লজ্জাও হয় ,রাগও হয়।সে কি ছোট বাচ্চা যে চকলেট খাবে।লোকে শুনলে কি বলবে?তারপরও যখন কয়েকদিন চকলেট আনা বন্ধ থাকে তরুর খুব কষ্ট হয়।চকলেটের জন্য নয়,তার স্বামী ব্যাস্ততার জন্য তাকে ভুলে আছে তাই।তবে একটা ব্যাপারে তার হাজব্যান্ডের জন্যও তার অনেক কষ্ট হয়।
বেচারা কতবার বলেছে,তরু তোমার চুলের খোপাটা একটু খোলে রাখ,খোলা চুলে তোমাকে দেখতে অনেক ভাল লাগে।
তরু উত্তর দিয়েছিল,বাঁধা চুলে কি দেখতে পচাঁ লাগে?
তার হাজব্যান্ড আর কিছু বলতে যায়নি।হয়ত কষ্ট পেয়েছে।এরপর আর কোন দিন চুল খোলা রাখতেও বলেনি।তরু ভেবেছিল এরপর কখনো বললে সে চুল খোলেই দেখাবে।কেমন মানুষ?আর একটি বার বললও না।আসলে তরু চুল খুলে রাখতে পারে না একদমই।তার ধারনা চুল খোলে রাখলেই এখানে সেখানে চুল পড়বে।কোথাও চুল পড়ে আছে দেখলে তরুর গা শিরশির করে।
তার হাজব্যান্ড তাকে একা পেলে মাঝেমাঝে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে।কিন্তু বলেনা কিছুই। প্রায়ই এমন হয়।অনেকটা ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে থাকার মত।একদৃ্ষ্টিতে পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে কিন্তু কোন প্রশ্ন করা হচ্ছে না।কি বিব্রতকর অবস্থা।তার হাজব্যান্ড যখন এমন করে,তরুর এত লজ্জা লাগে।তার রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা হয় লজ্জায়।কিন্তু কেন যেন পারে না যেতে।তার হাজব্যান্ড অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে, তরু,তুমি না অনেক ভাল একটা মেয়ে।তরু মনে মনে হাসে।ভাল কি তাকিয়ে থেকে দেখা যায় নাকি ?কোথায় বলবে তরু তুমি অনেক সুন্দর।তা না,বলে ভাল মেয়ে।কি অদ্ভুত।
তরু মনে মনে এটাই চায় যে, সবাই যেন তাকে ভাল বলে।কিন্তু আজ দীপা এসে যা একটা কাজ করে গেল।সে জানত দীপা আসলে এমনি।তার আগেই সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল।বিয়ের দুই বছরের মাথায় এই প্রথম দীপা তার শশুর বাড়ি এসেছে আজ।দীপা সেই ছোটবেলা থেকে তার বান্ধবী।একসাথে স্কুলে,কলেজে আসা যাওয়া করেছে।সে সম্পর্কে তরুর কাজিন ও হয়।এই মেয়েটির একটা বড় সমস্যা আছে।সে কোন কিছুই গোপন রাখতে পারে না।সেটা নিজের বা অন্য যে কারো ব্যাপারেই হোক।সে যার তার কাছে বলে দেয়।কত লজ্জার কথা ও সাবলিলভাবে হাসতে হাসতে বলে দেয়,যেন বলার মাঝেই সব আনন্দ।স্কুলে,কলেজে কোন কোন ছেলেকে দীপার ভাল লাগত,কার সাথে প্রেম করতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু পারেনি,শেষে কার সাথে প্রেম হল,প্রেম কেন ভেঙে গেল,এই জাতীয় যত কথা ছিল তা সব আজ তরুর স্বামীর ছোট বোনদের কাছে বলে দিয়েছে।মেয়েটা কি যে পাগল।কারও শশুরবাড়ি নামক স্পর্শকাতর জায়গায় কেও এইসব কথা বলে?একদম কমনসেন্স নেই মেয়েটার।বাংলাদেশে কমনসেন্সস শিখানোর জন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে।যেখানে মানুষকে শুধু কমনসেন্স শিখানো হবে।দীপা হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। সবাই জেনে গেছে ।তরুর স্বামী এইমাত্র ফিরল অফিস থেকে।সেও জেনে যাবে বোনদের কাছ থেকে।
তরুর সবচেয়ে ভয় হচ্ছে দীপা জাহিদ ভাইয়ের কথা সবাইকে বলে দিল কিনা এই ভেবে।দীপা যা যা বলেছে তার সব তরু শুনতে পারেনি রান্নাঘরে ছিল বলে।তার খুব ভয় হচ্ছে।
জাহিদরা তরুদের মহল্লার ভারাটিয়া ছিল।তরু যখন কলেজ থেকে ফিরত,তখন জাহিদ সবসময় গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে থাকত একা।কখনও কিছু বলত না,বলেওনি কোনদিন।এমনকি তরুর দিকে মুখ তুলে তাকাতো না কেন জানি।কলেজ থেকে ফেরার সময়টাতে গলির মুখটায় রোদ পড়ত সবসময়।জাহিদ চাইলে ছায়ায় দাঁড়িয়ে তরুর জন্য অপেক্ষা করতে পারত।তবুও জাহিদ ঐ রোদ পড়া গলির মুখটাতেই দাঁড়িয়ে থাকত।
একদিন পাশ কেটে যাবার সময় তরুর বান্ধবী দীপা এদিক ওদিক ভালভাবে দেখে নিয়ে আচমকা জাহিদের সামনে দাঁড়াল।একরকম ধমক দিয়েই বলল,কি চান আপনি?প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন,কাজ নেই আপনার?
জাহিদ শুধু তরুর দিকে একবার তাকাল।তারপর, কিছু না..কিছু না..এমনি ,বলে একরকম পালিয়ে গেল।জাহিদের এই অবস্থা দেখে দীপার হাসি কিছুতেই থামতে চায় না।তারপর কয়েকদিন সেই জায়গায় আর দাঁড়ায়নি জাহিদ।গলির মুখটা কেমন যেন ফাঁকা লাগত তরুর কাছে।আার একদিন যখন জাহিদকে সিগারেট হাতে দেখে ফেলল তরু,জাহিদের সেকি অবস্থা।চেহারার এমন ভাব হয়েছিল জাহিদের যেন সে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে।তরু এমন একটা ব্যাপার দেখে ফেলেছে তা জাহিদ কিছুতেই মানতে পারছিল না।তরু মনে মনে হাসে।সিগারেট তো মানুষেই খায়।তা দেখেছে বলে এমন করতে হবে নাকি?
তরুর বড় বোনের বিয়ের দিন জাহিদ প্রায় সারাদিনই ছিল তাদের বাসায়।অনেকবার মুখোমুখি হয়েছে।কন্তু সেদিনও কোন কথা হলো না তাদের।তরুর বিয়ে যখন প্রায় ঠিকঠাক হয়ে যাচ্ছিল,তখন তরু দীপাকে দিয়ে জাহিদকে বলেছিল যেন বিয়ের প্রস্তাব দেয় যেভাবেই হোক।কিন্তু জাহিদ তাও দিল না। খুব কষ্ট লাগল।সে মেয়ে হয়ে এতটুকু বলে ফেলল,আর জাহিদ কিছুই করল না।
অনেকদিন পর তরু জেনেছিল,আসলে দীপা জাহিদকে জানায়নি কিছুই যা তরু তাকে জানাতে বলেছিল।এর ভেতরে তরুর বিয়ে হল।একটু দূরে,অন্য একটি মহল্লায়।
তরুর হাজব্যান্ড আজো চকলেট নিয়ে এসেছে।চকলেটের প্যাকেটে বাচ্চাদের ছবি।তরুর ভাল লাগল।প্রায় একসপ্তাহ হল সে এই চকলেটের আশায় ছিল।দীপা আসলে জাহিদের কথাও বলে গেছে।কিন্তু তার হাজব্যা্ন্ড লোকটি এমন কেন?কিছুই যে বলল না।আগের মতই স্বাভাবিক।তরুকে নিয়ে সামনে কোথায় বেড়াতে যাবে সেই পরিকল্পনার কথা বলতে লাগল।বেরাতে যাবার ব্যাপারটা তরুর অনেক পছন্দ।
...............................
জাহিদের বিদেশে চলে যাবার ব্যাপারটা যখন পুরোপুরি ঠিকঠাক তখন একদিন তার বাসায় গেলাম।কিন্তু জাহিদকে বাসায় পেলাম না।আমি ওর রুমে বসে টেবিলের বইপত্র নাড়াচাড়া করছি।হঠাৎ পুরনো একটা গল্পের বইয়ের ভেতর থেকে কয়েকটা কাগজের টুকরা আবিষ্কার করলাম।জাহিদের হাতের লেখা বরাবরই জঘন্য।তার উপর অসংখ্য কাটাকাটি।কাগজের উপরের দিকটায় লেখা ‘ইহা কবিতা নয়,কবিতার মত করে লেখা।‘জাহিদের জঘন্য কবিতা পড়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।ওকে ডেকে এনে বলতে ইচ্ছে হল ,শালা প্রেমে ব্যাথ হলেই জীবনানন্দ হওয়া যায় না। তবুও কাগজের টুকরাটি পকেটে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।লেখাটি ছিল এরকম-
এমন এক খরতাপের দুপুর,
পাকা রাস্তার কাল পিচ যখন গলে যায়,
ভাপ উঠে ধূলোর ভেতর,
রবিকর কেন জানি আজ রেগে আছে,
হৃদয়হীনা রুক্ষ এই শহরের উপর।
এসময় চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।
যখন চারিদিকে শুধুই ক্লান্তি আর চির অবসাদের ঘোর
তখন রাস্তার আইল্যান্ড ঘেষে ধীর গতিতে
হাতে হাত রেখে তারা হাঁটছিল দুজন
জাহিদ এই রোদের ভেতর যে কি পেয়েছে?সব কিছুতই শুধু রোদ খুজেঁ বেড়ায়।
কবিতার মত করে লেখা কাগজের টুকরোগুলো সযত্নে রেখে দিলাম।বৃদ্ধ বয়সে জাহিদকে পেলে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ আডডা দেয় যাবে।
ঐসময়টায় আমাদের মফস্বলের পাড়া মহল্লায় খেলাধূলা করে বেশ সময় কেটে যেত।তরুর শশুরবাড়ির পাশে প্রায়ই খেলতে যেতাম।একদিন ফেরার পথে তরুর হাজব্যান্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ।মানুষকে আপ্যায়ন করার অসাধারণ গুন আছে এই লোকটার।আমাকে জোর করে বাসায় নিয়ে গেলেন।তরু আমাকে দেখে ভীষন অবাক হল।প্রথমে তেমন কিছু না বললেও কিছুক্ষন পর এমনভাবে কথা বলতে লাগল,যেন আমি তার অনেক কাছের বন্ধু ছিলাম।আমি তরুকে ছোটবেলা থেকে চিনলেও তেমন কথা হতো না আমাদের মাঝে।বিশেষকরে আমি জাহিদের বন্ধু ছিলাম বলে।আজ আমাকে পেয়ে সবার খোঁজ নিতে লাগল।তরু আসলে বিয়ের পর নিজের বাড়িতে এসেছে খুব কম।আমার সাথে তার বিয়ের পর এই প্রথম দেখা হল।
সে হঠাৎ বলল,জাহিদ ভাই কেমন আছে?
আমি বললাম,ভাল।জাহিদকে ওর চাচা বিদেশে নিয়ে গেছে।সে চাকরি করছে ওখানে।
তরু বলল,বিয়ে করেছে জাহিদ ভাই?
আমি বললাম, না।এইবার দেশে আসলে করতে পারে।
তরু জানতে চাইল,কবে আসবে জাহিদ ভাই?
আমি জেনেও বললাম,এখনো জানি না।
শেষে তরু আমাকে অনুরোধ করে বলল,জাহিদ বিয়ে করলে যেন অবশ্যই তাকে জানাই।তখন তার হাজব্যান্ড চলে আসল।আমি তরুর হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলাম।
ভাল আছে তরু।
এইটুকু ভাল থাকা তার প্রাপ্য ছিল।
আজকাল কেন যেন খুব মনে পড়ে বন্ধু জাহিদ আর তরুর কথা।চারপাশের সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল।সেই চিরচেনা খেলার মাঠটি যেন আজ আমার মতই নিঃস্বঙ্গ।গলির মুখটায় শেষ দুপুরে আজ ও রোদ পড়ে।কিন্তু আমার বন্ধু জাহিদের মত কেউ হয়ত তপ্ত রোদে দাড়িঁয়ে তার স্বপ্নের প্রিয়তমাকে শুধু একপলক দেখে নিয়ে তার ভাবনার মত করে সারা দিবস রজনী সাজিয়ে রাখে না।