রম্য ভাবনাঃ খুন
তুমি আমাকে খুন করেছো তবুও তোমাকে আমি খুনী বলতে পারছিনা। কারণ সেই খুন আমাকে মৃত্যু দিতে পারেনি। শুনেছি, হৃদপিন্ডের স্পন্দন থেমে গেলে নাকি মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ আমার হৃদপিন্ড এখনো পুরোপুরি স্থবির হয়ে যায়নি। আমার হৃদয় খুন হওয়া সত্ত্বেও ক্ষীণ লয়ে বয়ে যাওয়া একটা মৃদু স্পন্দন সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে আমার মৃত্যু হয়নি। আমার দেহ দিব্ব্যি সচল। আমাকে দেখতে সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ মনে হচ্ছে। আমার দেহের কোথাও এতোটুকু আঘাতের চিহ্ন নেই। আমি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবোনা আমি খুন হয়েছি। অথচ আমি দিব্ব্যি করে বলতে পারি আমার দেহের ভেতরের হৃদয়টা নির্মমভাবে খুন হয়েছে। হৃদয় নামের যে এক সূক্ষ্ণ অনুভূতিপ্রবণ, প্রবল স্পর্শকাতর একটা মাংশপিন্ড রয়েছে তা আর আগের মতো সচল নেই, সক্ষম নেই। অথচ আমার সচল, সুঠাম দেহ কিছুতেই প্রমাণ করতে পারছেনা আমি খুন হয়েছি। তাই তুমি নিশ্চিত এক খুনী হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে আমি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছিনা। কী ভীষণ চালাক তুমি। কী ভীষণ বুদ্ধিমতি। তুমি জানো মানুষের দেহ থেকে আত্মা কেড়ে নিলে মানুষ নিথর হয়ে যায়। প্রাণহীন হয়ে যায়। আর নিথর প্রাণহীন দেহইতো মৃত্যুর প্রতীক। কি দারুন তোমার বুদ্ধিমত্তা। তুমি কী সুকৌশল আমার দেহ থেকে হৃদয় নামের আত্মাটাকে নিপূণ এক প্রেমময় অস্ত্রে ঘায়েল করলে আমি একটুও টের পেলামনা। যখন টের পেলাম তখন দেখি আমি এক দেহ সর্বস্ব জড় পদার্থ। এক জীবন্ত প্রেতাত্মা। ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি অথচ অনুভূতি বলে কিছু নেই।
আমি বড় হয়ে জেনেছিলাম আমার দেহের ভেতর একটা সুন্দর হৃদয় আছে। সেখানে প্রেম-ভালবাসা আছে। স্নেহ-মায়া-মমতা সবই আছে। তুমি হৃদয়ে বিশ্বাসী নও। তুমি বলো, “মানুষের ভেতর যারা পুরুষ তাদের ভেতর পশু থাকে। পশুর মতোই মানুষের দেহের ভেতরেও হৃদপিন্ড থাকে। সেটা নিতান্তই একটা মাংশপিন্ড। পশু আর মানুষের মাংশপিন্ডের কার্যকারিতা এক ও অভিন্ন। সেখানে রক্তের চলাচল থাকে। শ্বেত কণিকা, লোহিত কণিকা থাকে। সেই সব কণিকার দিব্ব্যি নেচে খেলে বেড়ায়। সেখানে কোন প্রেম ভালবাসা কিছু থাকেনা। ঐসব কীটসর্বস্ব রক্তই পশু ও মানুষকে বরাবর আলাদা করে ভাবতে শেখায়। পশুর রক্তে বহমান প্লাজমা মানুষের রক্তে বহমান প্লাজমার মতো সংবেদনশীল নয়। কারণ মানুষের নাকি মন বলে কী যেন একটা আছে। পশুদের তা নেই। সত্যই কী তাই? তবে মানুষ কেন সময়ে পশুর চেয়ে বেশী নৃশংশ হয়ে যায়? পশু তার পশুত্বের সীমা লঙ্ঘন করে এমনটা দেখিনি। তবে পশুকে মানুষ যেমন আক্রমণ করে তেমন পশুও মানুষকে পশু ভেবেই তেমন আক্রমণ করে। তবে বুদ্ধির মারপ্যাঁচে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের জয় হয়। তার পেছনেও নানা কারণ। মানুষ বুদ্ধিকে লালন করে, চর্চা করে। জ্ঞান লাভের জন্য বই পড়ে। পশুরা সেটা করতে পারলে পশু মানুষে তেমন কোন তফাৎ থাকতোনা”।
তুমি বলো, “মানুষের মন বলে যদি কিছু থাকে তবে সেখানেই হয়তো প্রেম-ভালবাসা নামের অনুভূতিগুলো থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তুমি তোমার দেহ হাজারবার পোস্টমর্টেম করেও সেখানে মন নামের কোন বস্তু দেখাতে পারবেনা। সত্যি কথা বলতে কী তোমার মন বলে কিছু নেই। তাই তুমি যাকে হৃদয় বলো সেটা তোমার কল্পনা, এক ধরণে মানসিক বিলাসিতা। হৃদয় বা মন মাঝে অনুপস্থিত। তোমার যা আছে ডাক্তারি পরিভাষায় বলতে গেলে সেটা তোমার হৃদপিন্ড। সেই হৃদপিন্ডে আছে রক্তের চলাচল, দাপাদাপিও বলা যায়। তোমার হৃদয় বলে কিছু নেই। তুমি হৃদপিন্ডসর্বস্ব একটা হৃদয়হীন মানুষ। একটা সফিস্টিকেটেড পশু”।
আচ্ছা তুমি কী আমাকে ছুঁয়ে দেখেছো? তুমি কী টের পাও আমার রক্তের ভেতর বেজায় রকমের দাপাদাপি? জানিনা পাও কিনা! সেটাই আমার হৃদপিন্ড। আর আমি যে কথাগুলো তোমাকে বলছি, সেটা আমার অনুভব। সেটাই আমার মনের কথা। আমার মন না থাকলে কথাগুলো আসতো কী করে? আর মন মানেইতো হৃদয়। আজ আমার বোধের কাছে আমি মৃত। আমাকে খুন করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত আমার হৃদয়টা আজ ক্ষতবিক্ষত। আমার আত্মাকে বেজায় রকমের ঘায়েল করেছো তুমি। এরপরেও আমার দেহে হৃদপিন্ডের স্পন্দন অব্যাহত। কারণ সব মানুষেরই হৃদপিন্ড থাকে। পশুদেরও থাকে। আমারো আছে। তবে পশুত্বকে ছাপিয়ে আমার বাড়তি যা ছিল সেটাকে আমি হৃদয় বা মন বলেই জানতাম। আমার হৃদয় খুন হয়েছে দেহ নয়, তাই পুরোপুরি খুন হয়েছি এমনটা প্রমাণ করার মতো কোন আলামত পাচ্ছিনা। তাই বিচারকের দরবারেও যেতে পারছিনা। হৃদয় খুন হলে দেহে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকেনা। আমার দেহেও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। সরেজমিন তদন্তে কিভাবে প্রমান করবো তুমি আমাকে খুন করেছো। প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ হয়ে যাবে। তোমার বিরুদ্ধে আমি কোন কোন প্রমাণ দাঁড় করাতে পারবোনা। একমাত্র আমিই জানি আমি খুন হয়েছি অথচ তোমাকে আমি খুনী বলতে পারছিনা। তবে কী ধরে নেব মানুষের হৃদয় খুন হলে কেউ খুনী হয়না!
(রাহেলার খুনীদের বিচার হোক। রাহেলার মত হতভাগীদের জন্য এই লেখাটা উৎসর্গকৃত)