(১)
একদিন এক রাজা দেবতার খোঁজে বের হল। ছদ্মবেশী রাজা নদীর ধারে দৈবাৎ পেয়ে গেল তার আরাধ্য দেবতাকে। দেবতাকে সামনে পেয়ে রাজা নিজ মনোবাসনা পূর্ণ করার উপযুক্ত সুযোগ পেল। দেবতার পায়ের ধূলো কপালে নিয়ে রাজা দেবতার আশীর্বাদ চাইল।
রাজাঃ দেব মহাশয়। আমাকে বর দাও।
দেবতাঃ কি বর চাও? সাবধান, যা চাও, ভেবে-চিন্তে চাও, পরে যাতে বদলাতে না হয়।
রাজাঃ এমন বর দাও, যাতে সারাক্ষণ আলোয় ঝলমল করে রাজপ্রাসাদ আর প্রজারা অনেক দূর থেকেও বুঝতে পারে এটা রাজার প্রাসাদ।
দেবতাঃ ঠিক আছে। এই দিলাম আলোর বর। মনে রেখ, বর বদলানো চলবে না।
বর নিয়ে রাজা প্রাসাদে ফিরল। প্রাসাদে পা রাখার সাথে সাথে পুরো প্রাসাদ আলোয় ঝলমল করে উঠল। প্রাসাদের এক বিন্দু ও অন্ধকার রইল না। রাজ-চিত্ত আনন্দে নৃত্য করতে শুরু করল। ভাবল, আমি রাজা বটে! রাণীর হৃদয় দর্পে ফুলে উঠল। রাজার এ আলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্তিতে প্রাসাদের সবাই মহাখুশি। মন্ত্রী-পরিষদের জন্য রাণী নৈশভোজের আয়োজন করল।
সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য মন্ত্রীবর্গ প্রাসাদে ঢোকার ঠিক পূর্বমুহুর্তে রাণী সব বাতি নিভিয়ে দিল এবং রাজামশায় সবাইকে অভ্যর্থনা জানানোর অভিপ্রায়ে প্রাসাদের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকল। যখন মন্ত্রীবর্গ হাজির হল, সবাইকে নিয়ে প্রাসাদে ঢোকার জন্য রাজা এগিয়ে গেল। রাজা প্রাসাদে পা রাখার সাথে সাথে প্রাসাদের প্রতিটি স্থান আলোকিত হয়ে উঠল যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। ঝলমলে আলোর বর্ণালীতে বিমুগ্ধ হয়ে সবাই রাজার তারিফ করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর এক মন্ত্রী বলল, আহা! তারাও যদি এমন আলোর বর পেত! যা হোক, সবাই রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
নৈশভোজ শেষে অতিথি বিদায় হলে রাজার মনে হল, এ কেমন আলো, যাতে ছায়া হয় কালো। আমি এমন আলো চাই যাতে সবার ছায়া হবে রঙিন। আর এ রঙিন ছায়া দেখে সবাই অবাক হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকবে ছায়ার দিকে।
পরদিন রাতে রাজা ছদ্মবেশে বের হল দেবতার বর পাওয়ার আশায় । অনেক ঘুরাঘুরির পর রাজা দেবতাকে পেল নদীর ধারে। রাজা কিছু বলার আগে দেবতা এগিয়ে এল। তবে রাজা দেবতার পায়ের ধুলো নিতে ভুল করল না।
দেবতাঃ চারপাশে এত অন্ধকার। নদীর ধারে আসা দুষ্কর।
রাজাঃ যে দেবতা মানুষকে আলোর বর দেয়, তার আবার অন্ধকারে সমস্যা হয় কিভাবে?
দেবতাঃ মানুষরূপে এ জগতের মানুষের সাথে মেলামেশা করে তাদের সমস্যা উপলব্ধি করি। নতুবা আমি তাদের বর দেব কিভাবে?
রাজাঃ (স্মিত হেসে) আমাকেও প্রজা হয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বুঝতে হবে।
দেবতাঃ মন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলেও হয়। মনে রাখবে, মানুষের জন্য অভিজ্ঞতা উপলব্ধির চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর।
রাজাঃ (একটু ইতস্ততভাবে) আমার বর বদলাতে চাই।
দেবতাঃ ঠিক আছে। বদলে দিচ্ছি। তবে ভালভাবে চিন্তা কর, যে বর তোমাকে দিচ্ছি তা যেন আবার বদলাতে না হয়। বল, এবার তুমি কি বর চাও?
রাজাঃ আমি এমন আলো চাই যাতে রাজপ্রাসাদে সব কিছুর ছায়া রঙিন হয়।
দেবতাঃ ঠিক আছে। বর নিয়ে যাও। মনে রেখ, এরপর বর বদলাতে চাইলে ভোগান্তি পোহাতে হবে।
দেবতা অতি সত্বর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। রাজা তুষ্ট চিত্তে প্রাসাদের দিকে ফিরল। প্রাসাদে পা রাখতেই পুরো প্রাসাদ আলোকিত হয়ে উঠল। তবে এবার সবকিছুর ছায়া নানান রঙে বর্ণিল। প্রাসাদের সবাই মুগ্ধ হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে যে যার ছায়ার দিকে। প্রাসাদের যেদিকেই তাকায়, দেখতে পায় অভূতপূর্ব ছায়া। রাজামশায় নিজেও অবাক ছায়ার এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যে। রাণী ভাবল, এবার তাদের ঠেকায় কে? তারাই এজগতের শ্রেষ্ঠ রাজা-রাণী। আগের মতই রাণী আবার মন্ত্রীবর্গের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করল।
এবার আয়োজন আগের চেয়ে বেশী আড়ম্বরপূর্ণ। তার সাথে যোগ হয়েছে সব কিছুর রঙিন ছায়া। রাজকর্মচারীদের যারা অতি বৃদ্ধ, তারা বলতে লাগল, এ রাজবংশে ইতোপূর্বে এমন রাজার আবির্ভাব ঘটেনি। এ রাজা হয়ত একদিন দেবতার সম্মানে ভূষিত হবে। রাজা আগের মতই অভ্যর্থনার অভিপ্রায়ে প্রাসাদের বাইরে মন্ত্রীবর্গের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। রাণীও প্রাসাদের সব বাতি আগের মত নিভিয়ে রাখল।
যথাসময়ে মন্ত্রীবর্গের সাথে প্রাসাদে রাজা পা রাখা মাত্রই চারপাশে সবাই ঝলমলে আলোর সাথে সব কিছুর বর্ণিল ছায়া দেখতে পেল। এ ছায়ায় বর্ণালী এতই মোহনীয় যে, সবাই কারো দিকে না তাকিয়ে শুধু ছায়ার দিকেই তাকিয়ে রইল। এমনকি রাণীকে সম্ভাষণ করতেও ভুলে গেল। এতে রাষ্ট্রাচার ভঙ্গ হলেও রাজা-রাণী তাদের প্রাসাদের মোহনীয় যজ্ঞে তুষ্ট রইল। বিপত্তি হল, সবাই খাওয়ার টেবিলে গিয়ে না খেয়ে চারপাশে ছায়ার দিকে চেয়ে আছে। রাজার দৃষ্টি আকর্ষনে সবাই খাওয়ায় মনোনিবেশ করল।
রাজপ্রাসাদের সবাই ছায়া নিয়ে মেতে আছে। এমনকি রাজার দৃষ্টিও ছায়ার দিকে নিবদ্ধ। রাজা লক্ষ্য করল, আসল হয়েছে ফিকে, যেহেতু সবাই ছুটছে ছায়ার পিছে পিছে।
দিন যায়। রাত যায়। প্রাসাদের কাজ-কর্ম প্রায় বন্ধ। ছায়ার বিড়ম্বনা আর সহ্য হয় না। যে রঙিন ছায়া নিয়ে মনের আনন্দে রাজকার্য পরিচালনা করবে বলে দেবতার কাছে থেকে বর নিয়েছে, তার বিপত্তিতে রাজামশায় অতিষ্ঠ। রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। ভেবে পাচ্ছে না, কেন তার মহৎ উদ্দেশ্য এক অনিবার্য আপদ হল। অবশেষে মন্ত্রীপরিষদের সবাইকে ডেকে প্রাসাদে পরামর্শ সভায় বসল।
রাজাঃ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।
রাজা আবারো বলল, সবাইকে স্বাগতম কিন্তু কেউ শুনছে না। সবাই ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজা ক্ষেপে গিয়ে বলল, আমি সবাইকে ছায়া দেখার জন্য ডাকিনি।
জনৈক মন্ত্রীঃ রাজা ছায়া যে এত চমৎকার হতে পারে, তা সাত জন্মেও দেখিনি
রাজাঃ এটাই তো বিপত্তি। আমি ছায়া থেকে মুক্তি চাই।
জনৈক মন্ত্রীঃ যে দেবতা বর দিয়েছে, সেই পারবে এর বিহিত করতে।
রাজা এত সহজ সমাধানে বোকা বনে গেল। ভাবল, আমিও তো ছায়ার ঘোরে ছিলাম। আমি তো কখনো এমন সহজ সমাধানের কথা চিন্তা করিনি। তাহলে মন্ত্রীপরিষদে এমন একজন আছে, যে ছায়ার মায়া থেকে মুক্ত। রাজা সভা ভেঙ্গে দিয়ে ফিরে গেল। সন্ধ্যার পর পরই বের হল আরাধ্য দেবতার খোঁজে। অনেক ক্ষণ ঘুরাঘুরির পরেও দেবতার সাক্ষাৎ পেল না। ভাবল, নিজ স্বার্থ-সিদ্ধি আর খ্যাতির জন্য দেবতার বর চেয়েছি। দেবতা তো মানুষরূপে জগতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে ব্যস্ত। আমার বিলাসী চাওয়ার দুর্দশা তার চোখে পড়বে না। অনেক ঘুরাঘুরির পর রাজা ক্লান্ত দেহে নদীর ধারে একটি গাছের নীচে বসল। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তা টের ও পেল না।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন মাঝ রাত। চারপাশে গা ছমছম করা অন্ধকার। ভয়ে গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে উঠল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, যতদুর এসেছে তা পেরিয়ে একা একা প্রাসাদে ফেরা দুষ্কর। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখল, নদীর ধারে মালপাড়া – সেখানে দরিদ্র প্রজাদের লতাপাতার কুঁড়েঘর। কোন বাড়ীতেই আলো নেই, যেমনটি আলো নেই নদীর ধারে। তাই প্রজাদের দুর্দশার কথা ভেবে রাজা দেবতাকে স্মরণ করল। ভাবল,আর একবার যদি দেবতাকে দেখতে পায়, তাহলে এমন বর চাইব যাতে এসব প্রজাদের বাড়িতে ঝলমলে আলো জ্বালাতে পারি। মুহূর্তেই অশরীরী উপস্থিতি টের পেল। শুনতে পেল দৈব-বাণী।
দেবতাঃ আবার বর বদলাতে চাও কেন?
রাজাঃ (ভীত কণ্ঠে)আমাকে সেই বর দাও, যাতে আমার সব প্রজার ঘরে আলো জ্বালাতে পারি।
দেবতাঃ এই নাও তোমার বর। এরপর তোমাকে আর বর বদলাতে হবে না।
মুহূর্তেই দেবতা উধাও হয়ে গেল। এবার রাজা দেবতার পদধূলি নেওয়ার সুযোগ পেল না। তবে দৈব-বাণী শুনতে পেল স্পষ্টঃ
মানুষের ঘরে জ্বেলে আলো
পাবে আমার পায়ের ধূলো।
সহাস্য চিত্তে রাজা প্রাসাদে ফিরে গেল আলোর বর নিয়ে। প্রাসাদে পা রাখার সাথে সাথে ছায়ার খেলা বন্ধ হল। প্রয়োজনীয় সব বাতি জ্বালিয়ে রাজা শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজা দেখল, আলোর খেলা না থাকায় সবাই শান্তিতে ঘুমুচ্ছে। অন্যদিন হলে সবাই ছায়া নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত থাকত।
পরদিন রাণীকে কিছু না জানিয়ে রাজা নিজেই মন্ত্রীপরিষদের জন্য নৈশভোজের নিমন্ত্রণ পাঠায়। রাষ্ট্রাচার মেনে সবাই প্রাসাদে প্রবেশ করে। ভণিতা ছাড়া রাজা মন্ত্রীবর্গকে দেবতা প্রদত্ত আলোর বর প্রজার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে বলে।
রাজার নির্দেশ মোতাবেক, সকল প্রজার ঘরে পৌঁছে যায় আলোর বর। ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে ঝলমলে আলো। সবার শেষে বর পৌঁছে রাজপ্রাসাদে। রাজ্যের অন্ধকার দুর হল। প্রজারা রাজকীর্তন গেয়ে রাজার পদধূলো নিতে আসে দলে দলে। রাজা পদধূলো দেয়ার সুযোগ না দিয়ে সবার হাতে চুম্বন তিলক এঁকে দেয়। সবাই খুশি হয়ে নিজ নিজ বাড়ী ফিরে যায়।
রাতে রাজাকে আশীর্বাদ দিতে অশরীরী দেহে দেবতা অবতীর্ণ হয় রাজ-শয্যার পাশে। রাজা শুনতে পায় দৈববাণীঃ
মানুষের রাজা হও যদি,
প্রজার শান্তি যাচ নিরবধি।
(২)
এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজ-পরিবারের পরিচিতি রাজ্য জুড়ে। রাজ-দর্শন পাওয়ার আশায় প্রতি সপ্তাহে প্রজাদের ভীড় জমত প্রাসাদের আশেপাশে। রাজাও কাউকে বঞ্চিত করত না। প্রতিদিন বিকালে নিয়মমাফিক বাইরে খোলা জায়গায় সবার সাথে স্মিত হাসিতে ভাব বিনিময় করত। আর প্রজারা রাজাকে কুর্নিশ করে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করত। কেউ কোনদিন রাজার বিরুদ্ধাচরণ করত না।
রাজামশায় প্রতিদিন খালি গায়ে সূর্যালোক উপভোগ করত। খালি গায়ে মুক্ত বাতাসের ছোঁয়া রাজার খুব প্রিয়। যেদিন কোন ব্যস্ততার জন্য তা থেকে বঞ্চিত হত, রাতে ঘুম আসতে দেরী হত।
এভাবেই রাজা আর রাজ্যের লোকজন সুখে-শান্তিতে বসবাস করত।
একদিনের একটি ছোট্ট ছেলে বায়না ধরল, সে রাজাকে দেখতে যাবে। ছেলেটির বাবা-মা গরীব। রাজাকে দেখতে যাওয়ার সময় পরিপাটি পোশাক থাকা চাই কিন্তু সংসারে সচ্ছলতা না থাকার জন্য ছেলেটির ভাল পোশাক ছিল না। দরিদ্র বাবা-মা ছেলের মনোবাঞ্চনা পূরণ করার জন্য অল্প অল্প করে কিছু পয়সা জমাতে শুরু করল। প্রায় মাস ছয়েক এক পয়সা দু’পয়সা করে জমিয়ে একদিন ভাল কাপড়ের জন্য টাকা যোগাড় হল। যা হোক, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষে একদিন ছেলেটি বাবার সাথে রাজা আর রাজপ্রাসাদ দেখতে বের হল। রাজপ্রাসাদ অর্ধদিনের পথ। ছোট্ট একটি ছেলের সাধ পূরণের জন্য এক দরিদ্র বাবা রাজা আর রাজপ্রাসাদ দেখতে যাচ্ছে। তাই পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে ঘটনাটি খুব দ্রুত জানাজানি হয়ে গেল।
বাবাঃ রাজদর্শন ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যে না থাকলে রাজাকে দেখতে পাওয়া যায় না।
ছেলেঃ কেন, বাবা? আমরা রাজাকে বলব, রাজামশায়, আমরা আমরা অনেক দুর থেকে কষ্ট করে তোমাকে দেখতে এসেছি। তুমি আমাদের দেখা দাও।
বাবাঃ তুমি ঠিক বলেছ কিন্তু আমরা সাধারণ প্রজা। আমাদের কথায় রাজা বাইরে আসবে কেন?
ছেলেঃ আমাদের বাড়িতে কেউ আসলে আমরা কি না দেখে ফিরিয়ে দিই? তাহলে রাজামশায় আমাদের সাথে দেখা করবে না কেন?
ছেলের হাজারো প্রশ্নে বাবা অস্থির হয়ে পড়ল। ছেলেটির আর ধৈর্য হয় না এই ভেবে যে, রাজবাড়ি আর কতদূর আর কখনই বা রাজা আর রাজপ্রাসাদ দেখতে পাবে। যা হোক, দুপুরের পর তারা রাজপ্রাসাদে দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় এসে পড়ল। রাজা তখনও বাইরে এসে বসেনি। ছেলেটি কোনমতেই ধৈর্যধারণ করতে পারছে না। সে বারবার প্রশ্ন করে বাবাকে অস্থির করে তুলেছে। রাজা দেখতে কেমন, রাজা এখনও আসছে না কেন?- এভাবে নানা প্রশ্ন একের পর এক করেই চলেছে।
রাজা বাইরে এসে বসলে ছেলেটি একটু এগিয়ে গিয়ে রাজাকে বলল, তুমি তো আমাদের মত একজন মানুষ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়ত দেখতে সুন্দর কোন কিছু হবে। আগে জানলে মানুষ দেখতে এত দূরে আসতাম না।
রাজা ছেলেটির কোথায় থতমত হয়ে গেল। এমন প্রশ্ন কোনদিন শোনে নি যা ছোট্ট একটা ছেলের কাছে থেকে শুনতে হল। নিজেকে সামলে নিয়ে রাজা ছেলেটিকে বলল, তুমি আমার কাছে কি চাও?
ছেলেটিঃ তুমি আমাকে বলতে পার, কিভাবে আমি বড় হয়ে তোমার মত রাজা হতে পারব?
রাজাঃ (বিস্মিত কণ্ঠে) তুমি রাজা হতে পারবে না!
ছেলেটিঃ কেন পারব না? কোন প্রাণী কি বড় হয়ে রাজা হয়?
রাজাঃ (রাগতঃ কণ্ঠে) রাজা হতে হলে তোমাকে রাজার ছেলে হতে হবে যা তুমি কোন দিন পারবে না।
ছেলেটিঃ রাজার যদি সন্তান না থাকে তাহলে কে রাজা হবে?
রাজাঃ (বিরক্ত হয়ে) তুমি এত কিছু জেনে কি করবে? এদেশে তুমি কোনদিন রাজা হতে পারবে না।
ছেলেটিঃ তোমার ছেলেমেয়ে না থাকলে, ঠিকই আমি রাজা হব।
ছেলেটি চলে গেলে রাজা পড়ল বিষম চিন্তায়। তার রাজ্যে এর আগে কোনদিন কাউকে বলতে শোনে নি যে, সে রাজা হতে চাই। ছেলেটি যতই ছোট হোক না কেন, আজকের ঘটনাটি তার কাছে অশনি সঙ্কেত মনে হল। এর একটি যৌক্তিক কারণও আছে তা হল আজও সে নিঃসন্তান।
দিন যায়, মাস যায়, মাস ফুরিয়ে বছর যায়। রাজা নিঃসন্তান রয়ে যায়। রাজা তার রাজত্ব অন্যের কাছে হারানোর ভয়ে শংকিত হতে থাকে। রাতে শুয়ে ছোট্ট ছেলেটির কথা ভেবে আঁতকে ওঠে। রাজা-রাণী দু’জনে দেশের সব হেকিমের পথ্য রাতদিন সেবন করেও কোন সুফল পায় না।
এদিকে ছেলেটি বাড়ি ফিরে অস্থির হয়ে পড়ল এই ভেবে যে, তাদের মত মানুষ একজন মানুষ রাজাকে দেখার জন্য প্রতিদিন ভীড় জমাচ্ছে, অথচ সে রাজার ছেলে নয় বলে কোনদিন রাজা হতে পারবে না। সে একদিন মনের দুঃখে বাবামাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে বের হল। আর কোনদিন ফিরে এল না। তার বাবামা কিছুদিন তাকে খুঁজে না পেয়ে বাকি জীবন কান্নাকাটি করে পার করে কালাতিপাত করতে থাকল। এদিকে ছেলেটি বাড়ি ছেড়ে নদীর ধার ধরে হাটতে শুরু করল। হাটতে হাটতে সে একটা বনের ধারে হাজির হল। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সে ঘাসের উপর ঘুমিয়ে পড়ল।
এদিকে রাজামশায় রাণীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে শিকারে বের হয়েছে। বনের মাঝে একটা ছোট্ট ছেলেকে দেখতে পেয়ে রাজা অবাক হল। রাণী রাজাকে বলল, এত সুন্দর একটি ছেলে বনের মধ্যে একা একা ঘুরছে। চল, আমরা ওকে নিয়ে যায়। রাজা ছেলেটিকে বাবামায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই মনে করতে পারছে না বলে জানাল।
রাজা-রাণী দু’জনে আলোচনা করে ঠিক করল, তারা ছেলেটিকে প্রাসাদে নিয়ে যাবে। কারণ, একটি ছোট্ট ছেলেকে বনের মধ্যে একাকী ফেলে যাওয়া নিতান্ত অন্যায়। ফেরার সময় রাণী বলল, এ ছেলেটিকে তার প্রকৃত বাবামায়ের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের ছেলে হিসেবে লালন-পালন করাই ঠিক হবে। রাজামশায় একবাক্যে রাণীর কথায় রাজী হয়ে ছেলেটিকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে গেল।
রাজামশায় ছেলেটিকে চিনতে পারল না। কারণ হাজারো মানুষের একজনই ছিল এ ছেলেটি। এদিকে ছেলেটি প্রাসাদে পৌঁছুতেই বুঝতে পারল যে, রাজা হওয়ার অভিষ্ট গন্তব্যের দিকেই সে যাচ্ছে। তাই প্রতিদিন নানা কাজে পারদর্শী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করল। এদিকে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেটির আসল পরিচয় প্রাসাদের বাইরে কাউকে রাজা-রাণী জানতে দিল না। সে রাজার ছেলে হিসেবে বড় হতে লাগল।
দিন যায়, মাস যায়, মাস ফুরিয়ে বছর আসে। ছেলেটি দিনে দিনে বড় হয়ে পরিণত বয়সে উপনীত হল। রাজা বয়সের ভারে নূব্জ্য হয়ে পড়ায় রাজকার্য সমাধা করতে অপারগ হয়ে পড়ল। তাই একদিন সভাসদ্ সবাইকে ডেকে ছেলেটির হাতে রাজকার্য অর্পণ করে পরম শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। এভাবে পথের শিশু সবার অগোচরে ভাগ্যের জোরে রাজপ্রাসাদে অধিষ্ঠিত হল। নতুন রাজার পশ্চাতের ইতিহাস কেউ জানতে পারল না।
নতুন রাজা গুণে-মানে সবার সেরা। প্রজা সাধারণ পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগল। প্রজারা জানতে পারল না যে, অতি সাধারণ কুঁড়েঘরের এক ছেলে আজ দেশের রাজা। রাজাও জানে না যে, সেই দিনের ছোট্ট ছেলেটি যে রাজা হতে চেয়েছিল কপালগুণে আজ সত্যি সত্যিই নতুন রাজা। তাই নতুন রাজার ইতিহাস সবার অগোচরে রয়ে গেল।
প্রতিদিন আগের মতই নতুন রাজাকে দেখার জন্য দর্শনার্থীরা ভীড় জমাতে লাগল। নতুন রাজার কাছে এটি দুষ্টাচার মনে হল। কারণ, শুধু রাজা বলেই একজন মানুষকে দেখতে আসা মানবাত্মার অপমান ছাড়া কিছুই নয়। যেহেতু মানুষ রাজদর্শনে নিজেকে ধন্য মনে করে, তাই এ ধারা থেকে বের হওয়া সহজ হবে বলে তার কাছে মনে হল না। নতুন রাজা প্রতিদিন সবাইকে নিরুৎসাহিত করতে লাগল, যাতে সবাই এ থেকে বিরত থাকে। এর ফল হলো উল্টো। সবাই বলতে শুরু করল, এটি রাজার মহানুভবতা। নতুন রাজা রাজ-বংশের ইতিহাসে সেরা। আর এতে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেড়ে গেল। তার অস্বস্তি ও বেড়ে গেল দ্বিগুণ ।
অনোন্যপায় হয়ে নতুন রাজা মন্ত্রী-আমত্যবর্গ নিয়ে পরামর্শ সভায় বসল কিন্তু তারাও রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। বিপত্তি চরমে পৌঁছল।
চিরদিন রাজা হিসাবে অধিষ্ঠিত হওয়া নতুন রাজার ইচ্ছা ছিল না। রাজা হয়ে রাজা হওয়ার যোগ্যতা বদলে দেওয়াই তার মনোবাসনা যাতে রাজা হতে হলে রাজার ছেলে হতে না হয়। এদিকে সাধারণ কোন মানুষের ছেলে রাজা হবে তা প্রজারা কোনমতেই মানবে না। কারণ, রাজসম্মান পেতে হলে রাজার উচ্চতায় পৌঁছুতে হবে। হাজার হোক, রাজাচার রাজবংশেরই প্রাপ্য। উপায়ন্তর না দেখে রাজা ঠিক করল, তার আসল পরিচয় প্রজাদেরকে জানাতে হবে। তবে একাজটি করতে হবে খুব কৌশলে।
একদিন নতুন রাজা ছদ্মবেশে বাবামার তালাশ করতে বের হলো। সত্যি সত্যি এক পর্ণকুটিরে বাবামার সন্ধান মিলে গেল। অনেকদিন পর বাবামাকে দেখতে পেয়ে চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসছে কিন্তু পরিচয় গোপন রাখা ছাড়া উপায় নেই। এখনই পরিচয় জানাজানি হলে অহেতুক সমস্যায় তার সারা জীবনের মনোবাসনা অপূর্ণ রয়ে যাবে। সুতরাং, ধৈর্য ধারণ করা ছাড়া উপায় নেই। জগতের অনেক রীতিনীতির কাছে রাজাও যে অসহায় তা প্রতীয়মান হল।
নতুন রাজাঃ ওগো মা, তোমরা আমাকে একটু জলখাবার দিতে পার। বড্ড খিদে আর তৃষ্ণা পেয়েছে।
কুটিরবাসীঃ আমরা, বাবা, অতি গরীব। কিভাবে ক্লান্ত পথিককে সেবা করি। ফেরাব না তোমাকে। যা আছে তাই ভাগ করে খেয়ে নিই।
নতুন রাজাঃ (খাওয়া দাওয়া শেষ হলে) বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।
ছদ্মবেশী নতুন রাজা নিজ বাবামায়ের কাছে আত্মপরিচয় গোপন রেখে রাজপ্রাসাদে গোপনে ফিরে এলো যাতে কেউ টের না পায়। এদিকে সন্তানের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রতীক্ষারত মা-বাবা হারানো সন্তানকে অতি কাছে পেয়েও চিনতে পারল না।
রাজা প্রাসাদে ফেরার পর থেকে ভাবতে লাগল, কিভাবে বাবামায়ের আসল পরিচয় প্রকাশ করবে। দিন যায়, রাত যায়। তার চিন্তার অবসান কিভাবে হবে তাও জানা নাই। একদিন রাজা কর বিভাগের লোকজনকে ডেকে হুকুম জারি করল, রাজ্যের প্রতিটা মানুষকে ঠিকমত খাজনা দিতে হবে। কারো খাজনা মাফ হবে না। রাজার বিশেষ আদেশে কর বিভাগের লোকজন একদিন এক পর্ণকুটিরে কর আদায় করতে হাজির হল ।
খাজনা আদায়কারীঃ তোমরা প্রতি বছর খাজনা দাও, তার প্রমাণ কি?
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাঃ আমরা অতি গরীব। বুড়ো মানুষ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ। আমরা দু’বেলা পেটের ভাত জোগাড় করতে পারি না। খাজনা দেব কিভাবে?
খাজনা আদায়কারীঃ রাজামশায়ের আদেশ- খাজনা দিতে হবে। অন্যথায়, সালিশ মোকাবেলা করতে হবে।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাঃ বাবা, তোমাদের সালিশের বিচারে যা হয় শাস্তি দাও। আমাদের খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য নেই।
খাজনা আদায়কারীঃ এ রাজ্যে কারো খাজনা মাফ হবে না। তোমরা আমার সাথে চল। রাজদরবারে তোমাদের বিচার হবে।
সব সালিশের বিচার হাকিম করলেও এবার বিচারকের আসনে স্বয়ং নতুন রাজা। আদালতে হাজির হলো মন্ত্রী-আমাত্যবর্গ। সালিশ বসল। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আদ্যপান্ত শুনে নতুন রাজা বলল, আমিই তোমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলে যে রাজা হওয়ার জন্য বাড়ী ছেড়েছিল।
সবার চক্ষু চড়কগাছ। একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না। তাদের নতুন রাজা কি আসলেই রাজার ছেলে নয়, না, নতুন রাজা তাদের সাথে কৌতুক করছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চোখেও ঢের সন্দেহ। তবে একথা সত্যি যে, তাদের ছেলে রাজা দেখার পর কেন রাজার ছেলে ছাড়া অন্য কেউ রাজা হতে পারবে না – এই নিয়ে বেশ কিছুদিন জ্বালাতন করেছিল। তারপর একদিন সত্যিই সে ঊধাও হয়ে যায় এবং আজকের দিনের পূর্ব পর্যন্ত তার কোন হদিস ছিল না। বৃদ্ধা কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করার পর আপন ছেলেকে চিনতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরল। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আরো অবাক হল জেনে যে, মাত্র কয়েকদিন আগেই তাদের সাথে ছদ্মবেশে নতুন রাজা সাক্ষাৎ করেছিল এবং তাকে সেদিন চিনতে না পারার জন্য তারা ভীষণ অনুতপ্ত হল।
মন্ত্রী-আমত্যবর্গ বুঝতে পারল, রাজা নিঃসন্তান থাকলেও হঠাৎ একদিন একজনকে ছেলে হিসেবে হাজির করেছিল। আর কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করলেও রাজামশায়কে তা বলার সাহস পায়নি। সবার কাছে জলের মত পরিষ্কার হল, নতুন রাজা রাজার ছেলে নয়। রাজার ছেলে ছাড়া অন্য কেউ এরাজ্যে রাজা হয়েছে তা জেনে সবাই খুশী হল।
নতুন রাজা বাবামাকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। বেশীদিন এ অবস্থা তার ভাল লাগল না। কিছুদিন পর রাজ্যের যত ঢুলি ডেকে ঘোষণা করে দিতে বলল, সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে পরবর্তী রাজা কে হবে তা খুঁজে বের করা হবে। রাজ্য জুড়ে ঢি ঢি পড়ে গেল। রাজার ছেলে ছাড়া অন্য কেউ রাজা হবে, তা মেনে নেয়া যায় না। রাজাচার কাদাচার নয় – এর জন্য রাজরক্ত থাকা চায়। এদিকে মন্ত্রী, আমাত্য, মন্ত্রীর ছেলে, আমাত্যের ছেলে, আরও অনেকে রাজা হতে চায়। শুরু হল চরম বিপত্তি – কাকে, কিভাবে সঠিক রাজা হিসাবে অধিষ্ঠিত করা যায়।
রাজা মন্ত্রী-আমাত্য সবাইকে ডেকে পরামর্শ করল কিন্তু কোন উপায় কেউ বাতলে দিতে পারল না। রাজা রেগে গিয়ে বলল, সবাই গর্দভ। রাজা হতে চায় অথচ কে রাজা হবে, তা নির্ধারনের উপায় কেউ বাতলে দিতে পারছে না। আসলে রাজা হওয়ার উপযুক্ত কেউ এখানে নেই।
এরপর রাজা ঘোষণা দিল, প্রজাসাধারণের জন্য যে সবচেয়ে বেশী ভাল কাজ করবে, সেই রাজা হবে। এরপর থেকে রাজা পদপ্রার্থীরা প্রজা সাধারণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় কাজ করতে লাগল। রাজ্যের মানুষের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হল। সবাই ভীষণ খুশী। বছর শেষে উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে গিয়ে শুরু হল নতুন বিপত্তি। যে যতটুকু কাজ করেছে, বলে তার চেয়ে ঢের বেশী - মিথ্যার বেসাতি, অসুস্থ প্রতিযোগিতা সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেল। তারপরেও নতুন রাজা ভাবল, এটাও কম কি যে, সাধারণ মানুষের ছেলে রাজা হবে।
নতুন রাজা সব রাজা পদপ্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদেরকে একটি বিশাল মাঠে সমবেত হতে বলল। যার সমর্থক সবচেয়ে বেশী সেই পরবর্তি রাজার পদে আসীন হল। এরপর থেকে রাজাকে দেখতে আর কেউ ভীড় জমাত না, কারণ, রাজা ছিল তাদেরই একজন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



