সুমনার বিয়ে হয়েছে আজ বছর সাতেক হলো। এই সাত বছরে সংসারের সাত দুগুনে চোদ্দ পাঁকের মাঝে সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠেই বাঁধা পড়ে গেছে। ঠিক সতেরো বছর বয়সে চৌত্রিশ বছরের দুবাই ফেরৎ সুযোগ্য পাত্রের হাতে তাকে তুলে দিয়েছিলেন বাবা। তার এই কাঁটায় কাঁটায় অর্ধেক বয়সটা নিয়ে স্বামী দেবতা সেই বাসররাতেই রসিকতা করে বলেছিলেন-
- বুঝলা সুমনা? আজ থেইকা তুমি হইলা গিয়া আমার কবুল পড়া স্ত্রী। সাধুভাষায় যারে বলে অর্ধাঙ্গিনী। আমার সকল কিছুতে যেমনই তোমার আধাআধি অধিকার আছে, তোমার সকলকিছুতেও ঠিক তেমনি আঁধা-আধি অধিকার আমারও। তোমার আধা আর আমার আধা এই দুই মিল্লা হইতেছে গিয়া একজন। বলে হে হে হে হে করে দুলে দুলে হাসছিলো সে। সেদিকে তাকিয়ে বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না সুমনার। তার ভীষন বদরাগী বাবার মতের বিরুদ্ধে মুখ ফুটে একটা শব্দ উচ্চারণের ক্ষমতাও বাড়িতে কারো ছিলোনা। শফিক আরও যোগ করেছিলো,
-খেয়াল কইরা দেখছো আল্লায় তোমার বয়সটারেও আমার সাথে ঠিকঠাক আধাআধি ভাগ কইরা দিসে? তোমার সতেরো, আমার চৌত্রিশ এক্কেরে পাক্কা হিসাব। তার এই পাক্কা হিসাবী স্বামীদেবতা আরও কি কি হিসাব কষছিলেন তা জানা নেই সুমনার তবে এসএসসি এর পরে এই স্বামীর বাড়িতে এসে তার পড়ালেখার হিসেবের পাট চুকেছিলো। সাথে ছিলেন ভীষন বিচক্ষণা পন্ডিৎমনস্কা শ্বাশুড়িমাতা।
- বুঝলা বৌমা, মাইয়া মাইনষের এত দিগগজ হওনের কুনো কাম নাই। বেশি বিদ্বান হইলে মাইয়া মাইনষের পাও লম্বা হইয়া যায়। এই এত্তাখান লম্বা বুঝছো? বলেই তিনি তার শীর্ণ একখানি পা সামনের দিকে এগিয়ে দেখান। বলে চলেন, তখন সেই লাম্বা পা খান আর ঘরের ভিতরে থাকেনা, থাকে দুয়ারের বাইরে। আর এই দুয়ারের বাইরে থাকা পা খান আর ভিতরে ঢুকান যায় না। কাইট্টাও না। তিনি পান খাওয়া দাঁত মেলে হা হা হা হা করে হাসতে থাকেন। সুমনা হা করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। শ্বাশুড়ির কথার এক বিন্দুও তার বোধগম্য হয় না। শ্বাশুড়ি বলেই চলে-
- মাইয়া মাইনষের হায়া লাজ শরম হইলো বড় অলঙ্কার। কথায় আছে লজ্জা নারীর ভূষন। সেই লজ্জা যার নাই তার জীবনের কুনো মুল্য নাই। এই কানা কড়া দামডাও নাই। আগের দিনে বাড়ির বউ এর গলা পাশে বসা মাইনসেও শুনতে পাইতো না আর এখন একেক জনের বাজখাই ডাকসাইটে গলা দশ গ্রাম দূর হই্তে শোনা যায়। কলিকাল, কলিকাল। শ্বাশুড়ি দুঃখ করে কপালে বারেবারে হাত ঠেকায়। সুমনার খুব জানতে ইচ্ছে করে পাশের লোকেও যদি কথা না শুনতে পায় তাইলে সেই কথা বলেই বা কি লাভ? কিন্তু সে প্রশ্ন মাথায় আসতে আসতেই আবার হারিয়ে যায় শ্বাশুড়িমাতার এরই মাঝে বকে ফেলা আরও হাজারও কথার মাঝে।
- এই জন্যই বলে ঘরের বউ আনতে হয় কচি দেইখা। বুড়া ধাড়ি ঝুনা নারিকেল আনলে আর কিছুই শিখানো পড়ানো যায় না। ঐ যে কথায় আছে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস। সুমনা গালে হাত দিয়ে ভাবে তার ব্যকরন বই এ পড়া এত এত প্রবাদ প্রবচন পড়তে গিয়ে আর তার মর্মার্থ বুঝতে গিয়ে তার মাথা ঘুরাতো আর তার এই প্রায় অশিক্ষিত শ্বাশুড়ি এত সব শিখলো কোথা থেকে? প্রশ্নটা ঠোঁটের কাছে এসেও আঁটকে যায় শফিকের কাজে যাবার তাড়া শুনে,
- কই ভাত কই? ভাত তরকারী কিচ্ছু নাই কেন? আমি কি না খাইয়া দোকানে যাবো নাকি? সাথে সাথে শ্বশুরের গলাও শোনা যায়। -দাও দাও তাড়াতাড়ি দাও। ভোরে বাজার থেইকা যে চিতল মাছ আনলাম। রান্ধা হইসে নাকি? জিব কেটে তাড়াতাড়ি ভাত তরকারী বাড়তে মন দেয় শ্বাশুড়ি। আর লম্বা এক গলা ঘোমটা টেনে সেসব পরিবেশন করে সুমনা। বাবা ছেলের খাওয়ার মাঝেও অবিশ্রান্ত বকে চলেন শ্বাশুড়ি। যথারীতি শত শত প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহারে বিস্মিত হতে হতে বিস্মিত হওয়াটাই বুঝি ভুলে যায় সুমনা এক সময়।
বাবা ছেলে কাজে চলে যাবার পরে খেতে বসেন শ্বাশুড়ি বউ। শ্বাশুড়ি ভাত বেড়ে দেন। প্রথমে নিজের পাতে তারপর সেখান থেকে অর্ধেক ভাত তুলে দেন সুমনার থালায়। এ বাড়িতে আসা অবধি অবাক হয়ে খেয়াল করেছে সুমনা। শ্বাশুড়ি কখনও একবারে তার থালাতে ভাত উঠিয়ে দেন না বা নিজের পাতে নেন না। তার এই বউ শ্বাশুড়ি একত্রে ভোজনের এক রীতি আছে। প্রথমে তিনি হাতা করে নিজের পাতে উঠিয়ে নেন। সেখান থেকে খানিক উঠিয়ে সুমনার পাতে তুলে দেন। শুধু ভাতই না, মাছ মাংস, তরি-তরকারী সব কিছুর ক্ষেত্রেই শ্বাশুড়ির এই হিসাব। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভাতের পর কড়াই থেকে বিশাল চিতল মাছের পেটি উঠিয়ে তারপর হাত দিয়ে দুভাগ করে এক ভাগ উঠিয়ে দিলেন সুমনার পাতে।
- বাব্বারে বাবা কি বিশাল পেটি দেখছো? আমি পুরাডা খাইতে পারবোনা। লও তুমি আধাটা খাও আমি আধাটা ......
সুমনার কান্না পায়। সেই ভোর থেকে থালা বাসন মাজা, রান্নার যোগাড়, উঠান ঝাঁট দেওয়া সবই এক হাতে করেছে সে। খিধায় পেট চোঁ চোঁ করছে তার। এছাড়াও চিতল মাছের পেটি তার বিশেষ প্রিয়। নিজের মায়ের কাছে এ ছিলো তার বড় চেনা বিষয় কিন্তু শ্বাশুড়িকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। উনি পুরাডা না খাইতে পারলেও সুমনা পুরা মাছটাই হয়তো একাই খেতে পারবে। তাছাড়া সুমনার একটু ছুঁচিবায় স্বভাবও ছিলো সেই ছোটকাল থেকেই। তার খাবারে কেউ হাত দিলেই গা ঘিন ঘিন করতো অথচ এইখানে রোজ তাকে সেই ঘিনঘিনে ভাতই গলা দিয়ে নামাতে হয় চোখ বন্ধ করে। কিছু করার নেই। মেয়ে মানুষের খাবারের জন্য হ্যাংলামো বড় বাজে ব্যাপার। একা একাই চোখের জল ফেলে সে আড়ালে। তার ডাবল বয়সী স্বামীর কাছেও সে পুরোপুরি প্রকাশিত নয়, মনের সব কথা খুলে বলতেও পারেনা। তাছাড়াও তার মায়ের নামেই এমন অপবাদ দেবে? মনে হয় গলা টিপে মারবে এরা।
সুমনার দম বন্ধ হয়ে আসে, কবে বাবার বাড়ি যাবে ভেবে ভেবেই দিন কাটে। মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নেবে। দুপুরের একাকী প্রহরে হু হু করে কান্না পায় তার। জানালা দিয়ে দেখা যায় বহুদূর চলে যাওয়া ছায়া ছায়া বাঁকা মেঠো পথ। নারিকেল গাছের সারি। বড় জানালার তাকের উপরে লোহার শিক ধরে বসে থাকে সুমনা। নিজেকে বড় নিঃস্ব, একাকী মনে হয় তার। রেডিওতে মৃদু ভ্যলিউমে গান বাঁজে। জোরে ভ্যলিউম দিয়ে গান শোনাও নাকি বেহায়া নারীর কাজ। আরও কত দিন বয়ে যাবে এই জীবন? আরও কতকাল এইভাবেই কাঁটবে ভেবে পায় না সে। মোট কথা সুমনার জীবনে আনন্দ বলতে যা কিছু ছিলো এই ঝটিকা বিবাহের পর সবই যেন ভোঁজবাজির মত মিলিয়ে গেছে। তার মন বাবার বাড়ির পথ ধরে আকাশ দিয়ে প্রায়ই উড়ে উড়ে যায়।
এই বিকেলে কি করছেন মা? ভাবী কি তার ছেলেকে তেল মাখিয়ে, কাজল পরিয়ে, চুল আঁচড়ে খেলতে বসিয়েছে? বাবা কি ফিরেছেন কাজ থেকে? কত রকম দৃশ্যকল্প ঘোরে সুমনার দুচোখ জুড়ে। মেঘের ডানায় ভর করে উড়ে চলে তার মন বলাকা। ভেসে যায় দূর দেশে। তার প্রিয় কবুতরের খোঁপগুলি। তার লাগানো জানালার ধারের মাধবীলতার ঝাঁড় সব কিছু পর হয়ে গেছে আজ তার।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষন। ঈদের ছুটিতে সাত দিনের জন্য বাবার বাড়ি ভ্রমনের ছুটি মিলে যায় তার। তবে সাথে করে যেন জামাই বাবাজীও যায় সেই দাওয়াৎ নিয়েও ফোন করে সুমনার বাবা।এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে এই কদিনের মুক্তি। সুমনার প্রানের মাঝে যেন একশো ময়ুর পেখম খুলে নাচে। যথারীতি শুভক্ষনে রওয়ানা হয় তারা। বহুদিন পরে ট্রেইনের জানালার খোলা হুহু শীতল বাতাসে শরীর জড়িয়ে যায় সুমনার। ঝালমুড়ি, চানাচুরওয়ালা, চা পান সিগারেট পসারীদের ছুটোছুটি। অনবরত যাত্রীদের ওঠানামা। মন্ত্রমুগ্ধের মত আবিষ্ঠ হয়ে রয় সুমনা।
মেয়ে জামাই, তাদেরকে পেয়ে সারা বাড়ীতে হই হই পড়ে যায়। এতদিন পরে তাদেরকে পেয়ে পুরো বাড়ি যেন প্রান পেয়ে ওঠে। জামাই এর আগমন উপলক্ষে পুরো পরিবারেই জামাই ভোজনের আয়োজন করা হয়েছে। মেয়ে জামাইকে পাশাপাশি বসিয়ে খাওয়াবেন সুমনার মা। কত কত দিন হেঁসেলের অন্ধকারে শ্বাশুড়ির পাত থেকে আধাপেটা ভাত, আধাখানা মাছ খেতে হয় তাকে। আজ তার জন্য এই বিশাল আয়োজন! মনে মনে হাসি পায় সুমনার। তবুও সেসব ভুলে হাসি মুখে যোগ দেয় এই বাবার বাড়ির আনন্দযজ্ঞে। জামাই এর আগমন উপলক্ষে বাজারের সবচাইতে বড় রুই, কাতলা, বোয়াল, ইলিশ, চিতল থেকে শুরু করে কিছুই মনে হয় বাদ রাখেননি সুমনার বাবা। খেতে বসেই সুমনার প্রিয় মাছ চিতলমাছের বিশাল এক পেটি তার পাতে তুলে দেন মা। এরপর জামাইকে উঠিয়ে দিতে গেলেই শফিক রে রে করে ওঠে। এত বড় টুকরো সে কিছুতেই খেতে পারবেনা। ঝট করে হাত দিয়ে দেয় ঠিক তার মায়েরই মত সুমনার পাতে।
- এত বিশাল পেটি আমি খাইতে পারবো না মা। আমি বরং আধাটা খাই ......পরম তৃপ্তিতে পেটির তেল চকচকে অংশটুকু কেটে নেয় সে নিজের পাতে।
শালাশালীদের দিকে তাকিয়ে রসিকতা ছলে বলে ওঠে
- হে হে হে অর্ধাঙ্গিনী বলে কথা। সবকিছুই আধা আধি ভাগাভাগি... হে হে হে ....
ছবি- গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪১