মনে প্রাণে সংসারী মেয়ে আমি। আমি ঘর গুছোতে ভালোবাসি, রাঁধতে ভালোবাসি। আমার শিং মাছ আর ছোট ছোট আলু দিয়ে ঝাল করে চচ্চড়ি কিংবা লাল টকটকে ঝাল ঝাল গরুর মাংস যা খেয়ে সানভী চোখের জলে নাকের জলে আহা উহু করেও তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অথবা আমার মাখা জামভর্তা বা আমডাল খেয়ে কোক বার্গার খাওয়া সানভী একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায়। সেই সংসার করবার সাধ আমার কপালে জুটলো না। আমি পারলাম না। হেরে গেলাম। এই পাগলা পাগলা ভালোবাসার মুগ্ধ করা ছেলেটা সানভী আর তার করা নির্মম অত্যাচারগুলো মুখ বুঁজে সহ্য করেছি বহু বহু বার। অভিমান করেছি, রাগ দেখিয়েছি রাগ করে চলেও গেছি বাবার বাড়ি কত শত বার। প্রতিবার সে তার দোষ স্মীকার করে নিয়েছে, ক্ষমা চেয়েছে। আমিও ভুলে গেছি।কিন্তু এবার.....
সানভীকে প্রথম দেখার দিনটিতেই চমকেছিলাম আমি। ছিপছিপে ফরসা কালো শার্ট জিন্স আর মাথায় কালো ক্যাপ দেওয়া চটপটে ছেলেটা। তার সাথে যে আমার সেদিন প্রথম দেখা মনেই হচ্ছিলো না আমার। আমি অবশ্য জড়োসড়ো ছিলাম কিন্তু সানভীর সতস্ফুর্ততা আমাকে সহজ করে দিয়েছিলো খুব তাড়াতাড়ি। আসলে আমাদের সেদিন প্রথম দেখা হলেও তার কয়েকমাস আগে থেকে আমাদের পরিচয় ছিলো অনলাইনে আর ফোনেও নিয়মিত কথা হত। সানভী বিয়ের জন্য বউ খুঁজছিলো আর পেয়ে গেলো মনের মত আমাকেই। আর আমি? না বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। কিন্তু আমার মতই একটা মেয়েকে বউ হিসাবে খুঁজছে সানভী এই ব্যপারটা আমাকে কেমন এক অজানা আনন্দের জোয়ারে ভাসাতো। মানে মানুষ যা করে আর কি? মানুষ বলতে বোকামানুষেরা যা করে ভুল অথবা আবেগের কাছে পরাজয় বা হেরে যাওয়া । সেটাই করেছিলাম আমি।
আসলে হয়ত ভুলে গেছিলাম বা হেরে গেছিলাম ওর অপরিসীম ভালোবাসার কাছেও। সানভী যত অত্যাচার বা পাগলামীই করুক না কেনো ওর শিশুর মত ভালোবাসা মানে ওর অবুঝ ভালোবাসার কাছে আমি হেরে যেতাম বার বার। কিন্তু একটা সময় অপমানিত হতে শুরু করলাম। আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না যখন তখন ওর রেগে যাওয়া, যাচ্ছেতাই বলে ফেলা, জিনিসপাতি ছুড়ে ফেলা বা তার উন্মাদীয় ক্রোধটাকে। বিস্মিত হয়ে ভাবতাম এটা সানভী! একেই আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি! প্রথম দিকে ভয় পেতাম, তারপর দুঃখ, তারপর ক্রোধ ও অবশেষে বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহের ফলস্বরুপই এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাকে। সানভীর আর কোনো অনুনয় বিনয় বা অনুরোধই আটকাতে পারলোনা আমার এই সিদ্ধান্তকে।
আসলে ওভাবে হুট করে বিয়ে করাটা মোটেও ঠিক হয়নি আমার।কিন্তু মানুষ বলে যাদু করা বা তাবিজ করা। সানভীও কি আমাকে সেটাই করেছিলো নাকি কেই বা জানে। নয়ত যখন প্রথম দেখাতেই সে আমাকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে হাজির হলো আমি কেনো তখন একটাবারও বাঁধা দিতে পারিনি? না করতে পারিনি? আসলে আমি মনে হয় শুধু বড় বেশি আবেগিকই ছিলাম না শুধু আমি বড় বেশি নাটকীয় বলতে গেলে ফিল্মীই ছিলাম। সেই ব্যপারটা আমার কাছে বড়ই সিনেমাটিক লেগেছিলো। জীবন যে সিনেমা বা গল্পের বই এর পাতা নয় সে কথা তখন আমার মনেই পড়েনি। বরং বাড়িতে মা বাবা ভাই বোন সবাই কি ভাববে, কতটা অবাক হবে বা দুঃখ পাবে বা ভালোই ভাববে কিচ্ছু মাথায় আসেনি আমার। আমিও ঐ লং স্কার্ট আর হাই হিল পরেই কাজী অফিসে বসে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। অবশ্য সাক্ষী হিসাবে সানভী কাকে কাকে যেন ডেকে এনেছিলো।
ওর করিৎকর্মা আচরণ ও অবাক করা এসব কর্মকান্ড আমাকে এতটাই আছন্ন করে ফেলেছিলো যে আমার সে সব কান্ডগুলিকে ওর এই এখনকার মত ধূর্তামী বা শঠতা মনে হয়নি। আসলে আমি তখন ওর মাঝে হাবুডুবু। যা বলতো তাই ভালো লাগতো। আনন্দে ভেসে যেতাম আমি। যদিও সানভীর সকল ভালোবাসা বা প্রেম প্রকাশের এক আশ্চর্য্য নেগেটিভ ওয়ে ছিলো। যার মাঝেই বুঝতে পারতাম সে আমাকে দেখে মুগ্ধ! মানে ওর মুগ্ধতা প্রকাশের ঐ নেগেটিভ স্টাইলটাই যে তার এই ক্ষুদ্র জীবনে এতগুলি মেয়েকে ঘায়েল করার অস্ত্র তা আমি বুঝেছিলাম অনেক পরে। যদিও সানভী বিয়ের জন্য আমাকে ছাড়া আর কাউকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কিনা আজও জানতে পারিনি আমি। আমি আজও জানি জীবনে শত শত মেয়েকে পটানো এই সানভী বিয়ের জন্য শুধু আমাকেই বেছে নিয়েছিলো। এই হয়তবা মিথ্যে কথাটা ভেবে এখনও আমার কিছু গর্ব হচ্ছে যে সানভীর চোখে আমি ছিলাম সেই যোগ্য মেয়েটি। হাস্যকর হলেও সত্য ওর এই সব মেয়ে পটানো বিদ্যাকেই আমি ওর সত্যিকারের নিখাঁদ খাঁটি ভালোবাসা ভেবেছিলাম। আজও ভাবছি।
ওর হৃদয়ের ভেতরের অন্তরের অন্তঃস্থলে আমি শুধু দেখতে পাই একটাই নাম। সে আমার নাম। ওর শত শত বদ গুন আর হাজারও দোষ বা ভুল থাকা স্বত্তেও ওর ভালোবাসার কাছে আমি পরাজিত হয়েছি বার বার। কখনও মনে হয়নি এটা ওর নিছক অভিনয় বা মিথ্যে ভালোবাসা। তাই হাজারও দোষের পর যখনই সে ক্ষমা চেয়েছে, নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে, প্রতিজ্ঞা করেছে আর এমনটা হবে না, আমি মেনে নিয়েছি, ক্ষমা করে দিয়েছি। সানভী আমার পা ধরে বসে থেকেছে। নিজের হাতও কেটে ফেলেছে ওর ভুলগুলো মাফ করে দিতে তার এই প্রায়েশ্চিত্ত ছিলো। বার বার প্রতিজ্ঞা করেছে আর এমন হবে না। কিন্তু এখন আমি জানি এসব যতই বলুক আর যতই প্রতিজ্ঞা করুক, সানভী পারবে না। সানভীর পক্ষে এটা আর সম্ভব না। সে আবার ভুলে যাবে আবার অমানুষ হয়ে উঠবে। হ্যাঁ মন থেকেই বলে সে কিন্তু ও শেষ রক্ষা করতে পারবেনা। কারণ ঐ ভয়ংকর ড্রাগের এডিকশন তাকে রোজ রাতেই অমানুষ করে তুলবে। তখন আর তার মনে থাকবে না সে কাকে কোন জনমে কি প্রতিজ্ঞা করেছিলো বা কে তার ভীষন ভালোবাসার মানুষটি। এই এডিকশন তার বোধ বুদ্ধি, বিবেচনা এবং সংযম সবই তখন বৃথা করে দেবে। এই এডিকশনের প্রতিক্রিয়ায় সানভীর কিচ্ছু করার থাকেনা তখন আর। ওর ভেতরে জাগ্রত হয় তখন এক সাক্ষাৎ শয়তান। সেই সানভীকে আমি চিনতেই পারি না। অনেক চেষ্টা করেছি ওকে ড্রাগ থেকে ফেরাতে। পারিনি আমি। ব্যর্থ হয়েছি। যেমনই ব্যর্থ হয়েছিলাম বার বার ওর ভালোবাসার কাছে।
বার বার মনে পড়ে সেই প্রথম দিনটির কথা। প্রথম দেখা, খানিক সময়ের মাঝেই বিয়ে। তারপর বিয়ের শপিং, সানভীর নিজের হাতে সাজানো বাসর শয্যা। সব কিছু যেন এক সাজানো এপিসোড একটার পর একটা ঘটে চলেছিলো। সানভীর মাঝে এক আশ্চর্য্য মোহ লাগাবার ক্ষমতা আছে। ওর ঝকঝকে তকতকে গাড়ি, নিজে হাতে ডেকোরেটেড রুম, নিজের ডিজাইনের আসবাব। সব কিছুই একটা মুগ্ধতার রেশ কাটাতেই না কাটাতেই আরেকটায় নিয়ে ফেলতো আমাকে। কাজী অফিস থেকে বের করে সানভী নিয়ে গেলো আমাকে শাড়ী আর গয়নার দোকানে। মনে আছে ও আমাকে নিজের জন্য শাড়ি পছন্দ করতে বলছিলো। আমার এতই লজ্জা লাগছিলো আসলে একটু ইগো বা কিছু একটা কাজ করছিলো হয়তো ভাবছিলাম ছি ছি হ্যাংলাপনা দেখাবো নাকি। কিছুতেই বলতে পারবোনা কি শাড়ি কি চুড়ি চাই আমি। শেষে জোরাজুরিতে না পেরে সানভী নিজেই বেঁছে কিনেছিলো একটা রাণী গোলাপী বেনারসী আর এক সেট ডায়ামন্ড জ্যুয়েলারী।
আমি খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে ছিলাম। বাবার একার আয়ে সংসার চলতো না। আমার মায়ের উপার্জন বাবার চাইতে বেশি হওয়ায় আমরা কিছুটা মেয়েপ্রধান পরিবারেই বড় হয়েছিলাম। মা ছিলেন সংসারের কর্তৃত্তে। কিন্তু সানভী সব সময় ভীষন ডমিনেটিং হওয়ায় আমি আমার আজীবন দেখা পরিবারের সাথে সব কিছু মিলিয়ে উঠতে পারতাম না। সানভী তার এই সব নাটকীয় কর্মকান্ডে আমাকে মুগ্ধ করেছিলো বটে তবে আসল নাটকটাই তখন ছিলো যখন দেখলাম ড্রাগের নেশা তার সকল রোমান্টিক নাটকীয় প্রেমিকস্বত্তাকে বদলে দিয়ে এক রাক্ষসে পরিনত করে। সেটাই আসলে সবচাইতে বড় নাটকীয়তা ছিলো আমার আর সানভীর এক সাথে পথ চলার সময়টুকুতে। তাই শেষ পর্যন্ত সব কিছুই ভেস্তে গেলো। আমি অনমনীয় হয়ে উঠলাম।
শেষ পর্যন্ত আমার জিদের কাছে সানভী তার পরাজয় মেনে নিলো। মেনে নিলো আমার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটাও । কিন্তু সানভীর একটা শেষ অনুরোধ ছিলো আর সেটা রাখতে আমি বাধ্য হলাম। আসলে কেউ আমাকে বাধ্য করেনি। আমি নিজেই মানলাম। সানভীর ঐ পৈচাশিক ক্রুর চেহারার সাথে ওর অবোধ অবুঝ ভালোবাসার আরেক রুপটাকে আমি ভীষন ভালোবাসি। এই ভালোবাসার নাম হয়ত মায়া। সেই মায়াটার কারণেই এতকিছুর পরেও হয়ত সেই অনুরোধটাকে মেনে নিলাম আমি। কিন্তু এতগুলো দিন ধরে আসলে এই ভালোবাসা, মায়া, মান, সন্মান অপমানের দোলাচলে আমিও হয়ে উঠেছি কঠোর এক মানবী। তবুও মন ভেসে যায় বার বার ওর ভালোবাসার বানে।
যদিও শেষ পর্যন্ত সানভী বুঝলো যে আমাকে আর ফেরানো যাবেনা। সে মেনেও নিলো শেষ মেষ। ওর মুখে বিষাদের ছায়া। চোখ ভরা ব্যর্থতার জল। সে সব দেখেও আর ভুল করলাম না। জানিয়ে দিলাম এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আমাকে আর কোনোভাবেই ফেরানো যাবেনা এই সিদ্ধান্ত থেকে। সানভী বললো,
-ওকে ইটস ওভার বুঝতে পারছি। আমার জন্য তোমার মনে শুধু একরাশ ঘৃনা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ঠ নেই আর। সে আমি বুঝতে পারছি। শুধু একটা শেষ অনুরোধ রাখবে?
- কি?
এতকিছুর পরেও কৌতুহল ফুরোয় না আমার। জানতে চেয়ে বসলাম। সানভী এক অদ্ভুৎ অনুরোধ করলো।
- আমি চাই আমাদের এই অসমাপ্ত ভালোবাসার পথ চলার শেষ সময়টুকু স্মরনীয় হয়ে থাক।
-কিভাবে?
- বিয়ের পর আমরা হানিমুনে গিয়েছিলাম। মনে আছে?
- হুম আছে।
- ঠিক সেখানেই এক সাথে কাটাতে চাই। শুধু একটা মাস। এটাই আমার শেষ অনুরোধ। তারপর আর কোনোদিন কিছু চাইবোনা। তুমি চলে যেও।
চোখে জল এসে যাচ্ছিলো আমার। এই পৃথিবীতে মায়া বড়ই কঠিন এক বাঁধন। যাইহোক মনকে শক্ত করে বললাম।
- আবারও ভুল করলে। এই একটা মাসে তুমি কি ফেরেস্তা হয়ে যাবে?
সানভী নত মুখে বসে রইলো। বললো একটু চেষ্টা করে দেখি কষ্ট করে একটা মাস ফেরেস্তা হয়ে থাকা যায় কিনা। তারপর তো আর যা ইচ্ছে তাই হয়ে যেতে কোনো বাঁধা নেই তাইনা?
আমি হাসলাম। ওর বলার স্টাইলে। কিন্তু এত রাগ ক্রোধ আর ক্ষোভের পরেও আমি রাজী হলাম .....
( ইদানিং ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। এতটাই ব্যস্ত যে একটু ঢু মারতেও সময় নেই। তবুও মাথায় ঘোরে কত্ত কিছু কতই না লেখাঝোকা। ভাবি একলব্য পুচকি আমার লেখার জন্য পথ চেয়ে আছে। মিররমনিও জানতে চায় আমার মনের গহন বনের কথাগুলি, চুয়াত্তরভাইয়া তো লাঠি নিয়ে বসে থাকে কেমনে বাড়িটা মারবে কোনদিক দিয়ে। আর ঢুকিচেপা ভাইয়া তবলায় তাল দেবে। এইসব ভেবে ভেবে মাঝে মাঝে একটু লিখেই ফেলি। যাইহোক এই লেখার নেক্সট পর্ব তিনদিন পর মঙ্গলবারে দেবো ইনশাল্লাহ।)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:১২