এফবিআইর নির্যাতনে অবশেষে নিউরো সায়েন্টিস্ট ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে খবর পাওয়া গেছে। খবরের সূত্র ও সত্যাসত্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অবলা এই নারীর কপালে মৃত্যুসুধা আদৌ নসিব হয়েছে কি না তা জানতে বিশ্ববাসীকে হয়তো খুব বেশি অপো করতে হবে না। কারণ বিশ্বগ্রামের আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ তথ্যপ্রবাহ এখন পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ সেটি নয়; বরং স্নায়ুবিজ্ঞানী এই বিদূষী মহিলার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর অমানুষিক নির্যাতন যে পুরো মানবতার চেহারায় কলঙ্কের কালি মেখে দিয়েছে, সেটাই সমধিক গুরুত্ববহ। তবে আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে কিংবা এর আগেও বাগরাম বিমানঘাঁটি কিংবা অন্য কোথাও ধর্ষিতা ড. আফিয়া সিদ্দিকীর আকাশফাটা চিৎকার শোনার ফুরসত আমাদের নেই এবং ছিল না। অথচ আমরা আরেক পাকিস্তানি নারী, মালালার নামে তোলপাড় করছি। ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’খ্যাত পাকিস্তানের বিপত্নীক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি (সম্প্রতি এক পাকিস্তানি আমেরিকান মেয়ের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ের গল্প বাজারে এসেছে) মালালাকে নিজের কন্যাতুল্য আখ্যায়িত করে তার চিকিৎসাব্যয় থেকে শুরু করে সারা জীবনের পড়াশোনা ইত্যাদির দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। রাজনৈতিক জুয়াড়িদের এমন ভণ্ডামি দেখে অবশিষ্ট বিশ্বের প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, নীতিহীন রাজনীতির এই উপমহাদেশে এটা ডাল-ভাত।
মালালার প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি, তার আশু আরোগ্য কামনা এবং হামলাকারীদের তীব্র নিন্দা জানানোর প্রশ্নে আমরা এক শ’ ভাগ একমত। কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায়। একজন নিরীহ, নির্দোষ, জ্ঞানপিপাসু সর্বোপরি কোমলমতি মেয়ের ওপর হামলা যেকোনো বিচারেই যে জঘন্য অপরাধ।এই বিচারবোধকে মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করিয়ে বলতে চাই, স্রেফ একতরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট অপবাদকে পুঁজি করে নিরস্ত্র, নিরপরাধ, তিন সন্তানের জননী অসহায় অপর দিকে উচ্চশিতি এক মহিলা, যিনি বিরল প্রতিভাবান স্নায়ুবিজ্ঞানী হিসেবে দেশটির সম্পদ। তাকে প্রথমে অপহরণ, পরে নির্যাতন, ধর্ষণ, মনগড়া দলিল-প্রমাণ ও শুনানির পর ৮৬ বছর জেল দেয়া হলো। তার ব্যাপারে বিশ্বে তোলপাড় তো দূরে থাক, সামান্য উচ্চবাচ্যও কি হয়েছে?
একজন ব্লগার আপে করে প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন মদদপুষ্ট তেহরিকে তালেবান নামক বিতর্কিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গুলিতে আহত মালালার ব্যাপারে যে মানবতাবোধ ও বিবেক মুহুর্মুহু গর্জে ওঠে, ড. আফিয়া সিদ্দিকীর বেলায় সেটা কি '‘বাংলা সিনেমা' দেখতে যায়?’ মানবাধিকারের দোকান সাজিয়ে যারা বসে আছেন, তারা যদি ড. আফিয়া সিদ্দিকীর ওপর চালানো নির্যাতনের প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে বসে না থাকতেন, তাহলে এত স্থূল শব্দের ধারালো ব্যবহার শোভন না-ও মনে হতে পারত।
যে নির্যাতিতার প্রসঙ্গে একটু লম্বা ভূমিকা পাড়তে হলো, তার সম্পর্কে দু-একটা জরুরি তথ্য জানিয়ে রাখি। একাধিক সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো মেলালে ঘটনাপ্রবাহের চেহারা প্রায় অভিন্ন রূপেই ধরা দেয়।
তিনি দীর্ঘ দিন ধরে আফগানিস্তানের বাগরাম জেল এবং ইউ এস প্রিজন সেলে বন্দী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি আমেরিকান সৈন্যদের হত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং আল-কায়েদার সহযোগী। আর এই কারণে ইউএস কোর্ট তাকে ৮৬ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
বাগরাম জেলে তার ওপর চলছিল অমানবিক নির্যাতন। আফিয়া সিদ্দিকী গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন Massachusetts Institute of Technology, UK থেকে এবং PhD করেছিলেন Brandis Unversity, US থেকে। ২০০৩ সালে এফবিআই তাকে কিডন্যাপ করেছিল এবং তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আফগানিস্তানের বাগরাম জেলে। জেলে তাকে রাখা হয়েছিল পুরুষদের সাথে, যেখানে ছিল না আলাদা কোনো বাথরুমের ব্যবস্থা। অভিযোগে প্রকাশ, আমেরিকান বর্বর সৈন্যরা তাকে যত রকম উপায়ে সম্ভব নির্যাতন করে। দিনে তাকে কয়েকবার ধর্ষণ করা হতো। তাকে উলঙ্গ থাকতে বাধ্য করা হতো। তার কাপড় ফিরে পেতে তাকে পবিত্র কুরআনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য বলা হতো (নাউজুবিল্লাহ)।
২০১০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে তাকে একপেশে বিচারের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়েছে ৮৬ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, যা ছিল মানবতার ওপর চরম অন্যায়, গায়ের জোরে একতরফা সিদ্ধান্ত। পাঁচ বছর পর তার তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে, ১১ বছর বয়সী আহমাদ সিদ্দিকীকে মুক্তি দেয়া হয় ২০০৮ সালে। তার মায়ের সাথে ২০০৩ সালে তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার ছোট দুই সন্তানের কথা কেউ জানে না। ধারণা করা হয়, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। আফিয়া তখনও এফবিআইর কাস্টডিতে। যখন তার বিচার চলছিল তখন তার স্টেটমেন্ট জাজের উদ্দেশে '‘আপনি তাদেরকে ক্ষমতা দিয়েছেন আমাকে রেপ করার, আমাকে উলঙ্গ করে সার্চ করার। আমি তো সেদিনই মরে গেছি যেদিন আমাকে প্রথম ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং উলঙ্গ করে সার্চ করা হয়েছিল। আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে আমার দেশে যেতে দিন।’'
এই পাকিস্তানি বিজ্ঞানী যখন ইউএস প্রিজন সেলে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং একই সময়ে তার বন্দী জীবদ্দশায় যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে প্রেগন্যান্ট করার মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করার আগে এফবিআই তার বিরুদ্ধে কিছু সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। তার ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাত্রা ছিল খুবই নগণ্য। তাবৎ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ছিল ম্রিয়মাণ এবং অবিবেচক গণমাধ্যম ছিল প্রায় বোবার ভূমিকায়। খোদ পাকিস্তানি সরকার তাকে কিডন্যাপ করতে এফবিআইকে সহায়তা করেছিল।
ড. আফিয়ার ওপর নির্যাতন-ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের লজ্জাজনক নীরবতা, মুসলমানদের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। ড. আফিয়া সিদ্দিকীর বন্দিজীবন মৃত্যুর চেয়ে কোনো অংশে কম যন্ত্রণাদায়ক ছিল না। যদি তিনি সত্যিই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে প্রিয় স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলেও যান, তবুও এতে তার মৃত্যু ঘটেনি বরং প্রকৃত মৃত্যু হয়েছে মানবতার ও বিশ্ববিবেকের।
সংগৃহীতঃ খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
[email protected]
মূল পোস্ট দেখুন এখানে
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৭:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




