(মূল পোস্ট ব্লগার টেকনলজীর, একজনকে মন্তব্যে দিয়েছিলো , ও ওয়াচে থাকায় আমি তার অনুরোধে পোস্টটি করলাম)
এই ব্লগেরই একজন ব্লগার যিনি শিবির করেন। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কয়েকদিন আগে, কথায় কথায় এলো ছাগু ডাকা, রাজাকার ডাকা নিয়ে তার আক্ষেপ। এরপর তর্কের এক পর্যায়ে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আমাকে। তার আগে বলে নিচ্ছি, তিনি স্বীকার করেছেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার জন্য তার বড় ভাইরা তাকে যে কয়েকটা বই পড়ার নির্দেশ দিয়েছিল তার মধ্যে মতিউর রহমান রেন্টুর আমার ফাসি চাই নামের একটা নিষিদ্ধ বই রয়েছে। সেই বইয়ের আলোকে তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছেন। আমি সেগুলোর যখন তথ্যপ্রমাণ সহ তাকে উত্তর দেখালাম, তিনি স্বীকার করেছেন যে এসব প্রমাণ আসলেই সত্যি, তিনি ভুল জানতেন, তার মত অনেককেই ভুল শিখানো হয়েছে। প্রশ্নোত্তর গুলো নীচে তুলে দিলাম-
১। শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি হওয়ার দাবি করেছিলেন কেন? ঐ ভাষনেই মুখ্য ও গুরত্ব পুর্ন বিষয়ই ছিল শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি করা
উত্তর : এটা ভুল কথা। শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ '৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জেতার কারণে অবশ্যই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার ছিলেন। ইয়াহিয়া নিজে এসে বলে গেছেন মুজিবই হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু যখন ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত রাখা হলো, সারা দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেলো। গুলি চললো, মানুষ মরলো। ৭ মার্চের ভাষণে মুজিব এই কথাগুলো বলেছিলেন : ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখ এসেমব্লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে এসে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে (রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স : গোল টেবিল বৈঠক) মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেমব্লি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম সামরিক আইন, মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাষণটা শুনেছেন কিনা। বললেন রাস্তায় বাজাতে শুনেছেন। আমি সিডি ছেড়ে তাকে মন দিয়ে শুনতে বললাম। তিনি মেনে নিলেন যে আসলেই রেন্টু ভুল লিখেছেন।
২। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে শেখ মজিবরের ধানমন্ডির বাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকার পরিবর্তে পাকিস্তানের পতাকা উত্তলন করেছিলেন কেন? শেখ হাসিনার ঐক্যমতের সরকারের মন্ত্রি আ,স,ম রব দাবি করেছেন রাষ্টিয় ভাবে ২রা মার্চ কে স্বাধিনতার পতাকা উত্তোলন দিবস পালন করতে হবে। ২রা মার্চ কে যদি পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে পালন করা হ্য় তাহলে শেখ মজিবোর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষনের গুরত্ব কতটুকো থাকে ?
উত্তর : তাকে একটা ভিডিও ফুটেজ দেখালাম সেদিনের। ২৩ মার্চ শেখ মুজিবের ধানমন্ডী ৩২ নম্বর বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিজের হাতে উড়িয়েছিলেন এবং হ্যান্ড মাইকে দেওয়া ভাষণে বলেছেন সবাইকে প্রস্তুত থাকতে। ফুটেজটি দেখার পর তিনি স্বীকার করলেন তাকে ভুল শেখানো হয়েছে। রেন্টু মিথ্যা লিখেছেন। তিনি এও স্বীকার করেছেন যে পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা বাতুলতা।
৩। যেখানে ৭ই মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনির অবাঙ্গালী দুর্বল হাজার পাচেক সৈন্য কে বন্দি করে প্রায় বিনা যুদ্বে বিনা রক্ত পাতে বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব ছিল। তা না করে পুর্ব পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ করার পূর্ণ সুযোগ দিয়ে ২৫শে মার্চ বা ২৬মার্চ আমাদের উপর আক্রমন করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দেওয়া হয়েছিল কেন?
উত্তর : আমি তাকে মুক্তিযুদ্ধ কোষ খুলে দেখালাম যে ৭ মার্চ শুধু ঢাকাতেই পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা ছিলো ২৫ হাজার। তারা সেদিন আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েই তৈরী ছিলো। বিপরীতে ঢাকায় বাঙালী সেনা সদস্য ছিলেন না তেমন। ইপিআর আর পুলিশের অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক কামানের বিরুদ্ধে লড়াই করা যেত না।
তিনি আমার যুক্তি মেনে নিয়েছেন। স্বীকার করেছেন রেন্টু ভুল লিখেছেন।
৪। ২৫শে মার্চ রাতে ঘরে ডঃ কামাল হোসেন থাকতে এবং হাতের কাছে তাজুদ্দিন আহমেদ সহ অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ উপস্তিত থাকতেও শেখ মজিবুর রহমান কেন তাদের কছে স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন না?
উত্তর : তাদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা কেন দেবেন মুজিব। কারণ তখনও পাকিস্তানী বাহিনী গণহত্যা শুরু করেনি। তারা শুরু করা মাত্র মুজিব ওয়ারলেসে ঘোষণা পাঠিয়েছেন। আসল ঘোষণা ৭ মার্চই দিয়ে রেখেছেন যেখানে বলেছেন: আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি ....
শিবির সদস্য স্বীকার করেছেন যে রেন্টু এই কথাটা ফালতু লিখেছেন।
৫। ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরীহ নিরস্র বাঙালির উপর পাকিস্তানি বর্বর বাহিনি যখন পৈচাশিক আক্রমন করলো এবং নির্বিভচারে বাঙালি হত্যা করতে লাগলো এবং বাঙালী সৈনিক, ই,পি,আর, পুলিস আনসার পাকিস্তানী হানাদারের মোকামেলায় যুদ্ব করতে লাগলো তখন শেখ মুজিবর রহমান দিশেহারা বাঙালীর নেতৃত্ব না দিয়ে কেন পাকিস্তানিদের কাছে ধরা দিলেন?
উত্তর : কারণ এক প্লাটুন কমান্ডো বাড়ি ঘেরাও করে তাকে গ্রেপ্তার করেছেন। তারা গুলি করছিলো। ঘরে নারী ও শিশুরা ছিলো যাদের জীবন নাশের আশঙ্কা ছিলো। আর শেখ মুজিব তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও পলায়ন করেন নাই। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ও তিনি বুক চিতিয়ে ঘাতকদের মুখোমুখি হয়েছেন। বুকে গুলি খেয়েছেন, পিঠে খান নাই।
১৯৭৬ সালে মুসা সাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে টিক্কা বলেছিলেন : “I knew very well that a leader of his stature would never go away leaving behind his countrymen. I would have made a thorough search in every house and road in Dhaka to find out Sheikh Mujib. I had no intention to arrest leaders like Tajuddin and others. That is why they could leave Dhaka so easily.” Then Tikka Khan said more in a very firm voice, “in case we failed to arrest Sheik Mujib on that very night, my force would have inflicted a mortal blow at each home in Dhaka and elsewhere in Bangladesh. We probably would have killed crores of Bangalees in revenge on that night alone.”
তার মানে তাকে কেন্দ্র করে নির্বিচার গণহত্যা ঠেকাতেই নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
শিবিরের সদস্য ব্লগারটি স্বীকার করলেন যে রেন্টু ভুল লিখেছেন। ওই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।
৬। তাহলে কি শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা যে বলেন ২৬শে মার্চ দুপুর আরাইটা তিনটায় পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খান আমাদের বাসায় এসে আব্বাকে(শেখ মজিবকে) সেলুট দিল, মাকে (বেগম মুজিব) সেলুট দিল, দিয়ে আব্বাকে বললো স্যার, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আপনার সাথে আলোচনা করার জন্য আমাকে একটি স্পেশাল বিমান সহ পাঠিয়েছে, আপনাকে রওয়ালপিন্ডি(পাকিস্তানের তখনকার রাজধানী) নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি ম্যাডামকে (বেগম মজিব) সাথে নিতে পারেন। চাইলে অন্য কাউকে নিতে পারেন। আব্বাকে সসম্মানে জেনারেল টিক্কা খান নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় মাকে জেনারেল টিক্কা খান সেলুট দিয়ে গেল। তাহলে এটাই কি সত্যি?
উত্তর : টিক্কা খান শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে যাননি। গিয়েছিলেন মেজর জহির আলম খান একদল কমান্ডো নিয়ে। জহির আলম এ নিয়ে তার স্মৃতিকথায় যা লিখেছেন তার মধ্যে মুজিব ওয়ারলেসে কিছু ট্রান্সমিট করেছেন এই কথা আছে। আর মুজিবকে সেলুট দেওয়া দূরে থাক তার বদলে তার গায়ে হাত তোলার কথা লিখেছেন জহির।
যিনি গ্রেপ্তারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার কথাকেই রেন্টুর মিথ্যাচারের বদলে গুরুত্ব দিয়েছেন শিবির সদস্যটি। তিনি স্বীকার করেছেন রেন্টু বানিয়ে বলেছেন এসব কথা যা হাসিনা কোনোদিনও কোনো গণমাধ্যমে বলেননি।
৭। শেখ মুজিবর রহমান কি মনে করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি বানানোর জন্য রাওয়ালপিন্ডি যাচ্ছেন? আর তাই কি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির আক্রমনের মুখে গোটা বাঙালি জাতিকে অসহায় অরক্ষিত রেখে তিনি জেনারেল টিক্কা খানের সাথে পাকিস্তান চলে গেলেন?
উত্তর : টিক্কা খান মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশেই ছিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনি পাকিস্তান জাননি। আর শেখ মুজিবকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেশদ্রোহিতার জন্য বিচার করতে। প্রধানমন্ত্রী বানাতে নয়।
শিবির সদস্যটি স্বীকার করেছেন রেন্টু মিথ্যে কথা লিখেছেন। তাকে ভুল শেখানো হয়েছে।
৮। পাকিস্তানী নরপিচাশ হায়নাদের আক্রমনের মুখে আপোষকামি
নেতার আপোষের ফলে, দিশেহারা নাবিকের মতো কিংকর্তব্যবিমুর
বাঙালি জাতি।ঠিক সেই সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনির কঠোর শৃংখলার মধ্যে থাকা বাঙালী সৈনিক, পাকিস্তানী সেনা আইনে ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে
মৃত্যুদন্ডের সম্পুর্ণ ঝুকি নিয়ে নেতৃত্বশূন্য দিশেহারা বাঙালিকে নেতৃত্ব ও পথের দিশা দিতে এগিয়ে এলেন এক তরুন বাঙালি সৈনিক ।
মুক্তি পাগল স্বাধীনতাকামী মানুষকে তিনি শোনালেন স্বাধীনতার অমর বাণী চট্রগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি ঘোষনা করলেন,আমি মেজর জিয়া বলছি, আমি স্বাধীনতা ঘোষনা করলাম। ২৭শে মার্চ
প্রতুষে ইথারে ভেসে এলো এই অমর স্বাধীনতার বাণী। সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মুক্তি পাগল দামাল ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো মুক্তিযু্দ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে ঘোষনা করলেন, "আই অ্যাম মেজর জিয়া, পেসিডেন্ট অফ পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ, আই ডিকলেয়ারর্ড ইনডিপেনডেন্ট অব বাংলাদেশ।" পরে কৌশলগত কারণে তিনি বল্লেন, আই অ্যাম মেজর জিয়া, আই ডিকলেয়ারর্ড ইনডিপেনডেন্স অফ বাংলাদেশ অন বিহাব অফ আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান।"
মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণাই কি পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আপোষের ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা গ্রহনের পথে অন্তরায় হলো?
উত্তর : এই বিষয়ে নুরুজ্জামান মানিকের একটি লেখা পড়ালাম শিবির সদস্যটিকে। তিনি স্বীকার করলেন যে বেলাল মোহাম্মদ ডেকে না আনলে জিয়ার পক্ষে সেই ঘোষণা পাঠের কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। তা ছাড়া ঘোষণার আগেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তা ছাড়া ২৭ মার্চ প্রত্যুষে নয়, সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন জিয়া। তার আগে লোকজন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেনি।
শিবির সদস্যটি স্বীকার করলেন রেন্টু বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আসলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছেন। তার আসলেই ফাসি হওয়া দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৮:০৮