somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রঙন ফুলের সংসার

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"হুমাই এর বউ বাইত আছোনি?ও যমুনা..."

মজিবর মিস্ত্রীর ডাক শুইনা যমুনা রান্নাঘর থেইকা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজায় আইসা দাঁড়ায়।মিস্ত্রীর বিরক্তিভরা চেহারার দিকে তাকাইয়া বোঝার চেষ্টা করে সাত সকালে কি এমন ঘটলো যে উনি বাড়িতে আইসা পড়লেন সরাসরি।

"বহেন চাচা।ফিড়া দেই একটা..."

"না গো মা বহুমনা।হুমাই কো?অরে দেখতাছি না!ডাকোছে একবার অরে।"

"চাচা,ও তো ভোর বেলায়ই বাইরইয়া গেছে কয়ডা পান্তা খাইয়া।উত্তর পাড়ার মতি কাজীর বাইত কাম নিছে।আইতে তো রাইত অইবো।"

"দ্যাহো দেহি কান্ডডা!আমি কয়ডা ট্যাহা পাইতাম,চৈত্র গেল,বোশেখ গেল,এহনও দেয়ার নাম গন্ধ নাই।ট্যাহা তো আর আমার গাছে ধরেনাই যে নিলে আর শোধান লাগবোনা।পয়সা কামাই করতে তো শইল্লের ঘাম ঝরানি লাগে নাকি কও?"

"চাচা আমনে বহেন,কয়ডা মুড়ি আর মিডাই দেই,খান।সকাল সকাল তো মনে কয় নাস্তা করেন নাই।"

"না রে মা,আর বহুম না।হুমাই ফিরলে আমার লগে দ্যাহা করবার কইয়ো।আইজকা যাইগা,ম্যালা কাম পইড়া রইছে বাইত।"

মজিবর মিস্ত্রী চইলা যাওয়ার পরও যমুনা কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়ায় থাকে।পোড়া পোড়া গন্ধটা যখন নাকে আইসা লাগে,তখন মনে হয় চুলায় রাইখা আসা আলু কড়াইয়ে আটকায় ধরছে।তাড়াতাড়ি কইরা সে রান্নাঘরে দৌড়ায়।

হুমায়ন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।সে পেশায় দিনমজুর,বাধাধরা কোন রোজগার নাই।কাজ করলে ট্যাকা পায় আর যেদিন কাজ থাকেনা সেদিন ঘরে কেবল ভাত আর মাসকলাইয়ের ডাল রান্না হয়।

দুজনের টানাটানির সংসার।ওদের কোন সন্তানাদি নাই।বিয়ার তিন বছর পরেও যখন কোন বাচ্চা-কাচ্চা হইলো না,তখন বাড়ির সবাই বুইঝা গেছিলো যমুনা বন্ধ্যা।পাড়ার খালা চাচীরা আঁড়ালে হাসাহাসি করতো এই নিয়া।কোন কোনদিন ঝগড়ার সময় খোটাও দিতো।তখন যমুনা চুপ হইয়া যাইতো।যমুনার শাশুড়ি বাঁইচা থাককালীন অরে নিয়া কয়েকবার কবিরাজের কাছেও গেছিলো।শেষবার নিয়া গেছিলো হেমনগরের কাছে সোনামুই গ্রামের হামেদ কবিরাজের কাছে।তার দেয়া ওষুধে নাকি অনেকেই ভালো ফল পাইছে।অনেক দূর দূরান্ত থেইকা লোক আসে তার কাছে।অবশ্য সবই মুখে মুখে শোনা কথা।হামেদ কবিরাজ যমুনারে লতা পাতা দিয়া ওষুধ বানায় দিছিলো,আর দিছিলো একটা গাছের শিকড়।জামাইয়ের সাথে সহবাসের আগে ওইটা চিবাইয়া রস বানাইয়া খাইতে হইতো।একটা সন্তানের আশায় যমুনা কত কিই না করছে!শেষ পর্যন্ত কোন লাভ হয় নাই।গরীবের ঘরে আশার বাতি নিভু নিভু কইরা জ্বলতে জ্বলতে একসময় আইসা নিভা যায়।যমুনা এখন আর সন্তানের স্বপ্ন দ্যাখেনা।

সূর্য আইজকা ভালোই ক্ষেপছে।তেজী চোখ নিয়া তাকায় আছে পৃথিবীর ওপরে।হুমাই,রমিজ,শামসু আর মতি কাজী চালার নিচে বইসা আছে।কাজী বাদে ওরা খেড় বিছাইয়া বইছে,মতি কাজী বইছে চেয়ারে।মুড়ি গুড় খাওন চলতাছে।

"শামসু কি হুইয়া পড়লি নাকি রে?ওঠ ওঠ...তাত্তারি খাওন শ্যাষ কর।আইজকার মইধ্যে পৈঠা আর কলপাড় বান্ধন শ্যাষ করন লাগবো।ওঠ..."

মতি কাজীর তাড়াতে শামসু উইঠা বসে,বলে-"শইলডা টানেনা কাজী সাব।দুপুরের খাওনের পর একটু জিরাইবার মনে কয়।"

"অইছে...ম্যালা জিরাইছস।এহন কামে হাত লাগা।কাম না করলে কি খাওন জোটে আর?"

হুমাইয়ের মন এতক্ষণ এইখানে ছিল না।সে ভাবতাছিল যমুনার কথা।আইজকা ঘরে কোন বাজার নাই।ভোরে সে পিঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়া পান্তা খাইয়া আইছে।এখন দুপুর গড়ায়।যমুনা কি না খাইয়া আছে?ভাইবা হুমাইয়ের ভিতর খানিকটা হাহাকার খেইলা যায়।অভাবের সংসারে বউরে সে দারুণ ভালবাসে এখনো।

যমুনাকে যখন হুমায়ন বিয়া কইরা নিয়া আইছিলো তখন যমুনার বয়স বিশ কি একুশ।চোখে মুখে যৌবনের ছটা।কথায় কথায় খিলখিল কইরা হাইসা উঠতো।বড় ঘর থেইকা সেই হাসি শুইনা হুমাইয়ের দাদী চিল্লায় উঠতো-"ওই মাগি...তর মনে এত রঙ ক্যা?মাইয়া মানুষ এত জোরে হাসন লাগেনা..."
যমুনা দাদীর কথা শুইনা আরও জোরে হাইসা উঠতো।দাদী রাগে গজগজ করতো আর কইতো-"বেশি খুশি নেওন বালা না।দেহিস একদিন কাইন্দা কূল পাবিনা।"
যমুনার কান্দন লাগছিলো পরে।অনেক তপস্যার পরেও যখন মা হইতে পারে নাই,তখন যমুনা আঁড়াল পাইলেই কাইন্দা বুক ভাসাইতো।হুমাইয়ের একটা ফুটফুটা মেয়ের সাধ আছিলো।বাবা না হইতে পারার দুঃখ নিয়া হুমাই বউরে ভালবাইসাই গেছে।হুমাইয়ের মা বাঁইচা থাকতে একদিন কইছিলো আরেকটা বিয়া করতে।ধমক দিয়া মায়ের কথারে থামায় দিছিলো হুমাই।

"এই রাইত বিরাইতে কি শুরু করলি যমুনা!থাম তাত্তাড়ি...নইলে কইলাম একটা মাইরও আইজকা মাডিত পড়বোনা..."

কথাগুলান বলার সময় হুমাইয়ের চোখ দিয়া আগুন ঝরতাছিলো।যমুনা খানিকটা দূরে দাঁড়াইয়া সকালের ঘটনা কইতাছিলো।

"আমনের কি!কথা তো বেবাক হোনন লাগে আমার।হারাদিন তো আমনে আর বাড়িত থাহেন না।মিস্ত্রী আইজকা সকালে আইছিলো।যা মনডায় কইছিলো সব ওগড়ায় গেলো।"

হুমায়নের রোজগারে এখন খড়া যায়।হাতে তেমন কাজ থাকেনা।দিন আনে দিন খায়।বাংলাবাজারে মহাজনের কাছে কিছু ট্যাকা পাওনা আছে ওর।সেইটা হাতে পাইলেই মজিবর মিস্ত্রীরে দিয়া দিবো ভাবছিলো।কিন্তু যমুনা আইজকা নতুন নাটক শুরু করছে।সে তার গলার সোনার চেইনটা খুইলা বিছনার উপর রাখছে।অলংকার বলতে বিয়ের পর কেবল এই চেইনটাই যমুনারে দিতে পারছিলো হুমাই।

"আমনে যদি এইডা বেইচ্চা কাইলকার মইধ্যে মিস্ত্রীর ট্যাকা না শোধান তয় কাইলকা আমি নিজেই যামু ব্যাপারীর কা..."

কথাডা শেষ হওয়ার আগেই হুমায়ন আহত বাঘের মতন যমুনার ওপরে ঝাঁপায় পড়ে।

"মাগি...তরে কয়দিন কইছি এই মালা বেচনের কথা কবিনা...কান দিয়া হান্দায় না কথা?"

কথার তালে তালে হুমায়ন যমুনার পিঠে কিল মারতে থাকে।বদরাগী লোকটার এই একটা সময়েই কোন হুঁশজ্ঞান থাকেনা।বউ পিটানের সময় সে এক অন্য মানুষ।

হুমায়ন তখনো বিয়া করে নাই।হুমাইয়ের দাদা বয়তুল্লা কইতো-"বুঝলিরে হুমাই!পাডা জব্দ হিলে আর বউ জব্দ কিলে।মাগি মাইনষেরে খাওন পিন্দনের লগে কিল গুতাও দেওন লাগে,নইলে জীবনডা অরা জ্বালাইয়া খায়।"
হুমায়ন তখন বুড়ার কথা ঠিকঠাক বুঝতোনা।এখন মনে হয়,জীবন থেইকা অভিজ্ঞতা নেয়া বুড়ার চুল দাঁড়ি হুদাই পাকছিলো না।

রাগ পইড়া যাওয়ার পর মানুষ অনুশোচনায় ভোগে।রাগের মাথায় কইরা ফেলা বেশিরভাগ কাজই তখন ভুল মনে হয়।সময় গড়ানের সাথে সাথে তাতে যোগ হয় আফসোস।

মাইর খাওনের পর যমুনা মেঝেতেই শুইয়া শুইয়া কানতেছিলো।অপরাধীর মতন মাথা নিচা কইরা হুমায়ন অর পাশে গিয়া বসে,মাথায় হাত রাখে,পিঠে হাত বুলায়।

"যমুনা...ও যমুনা ওঠ..."

যমুনা ঝামটা মাইরা হাত সরায় দেয়।ফোঁপায় ফোঁপায় কান্দে।ওর কান্দনের শব্দ অদূরে গিয়া অন্ধকারে মিলায় যায়।হুমায়ন আবারও ডাকে...আবার ...আবার...

যমুনা তারও অনেকক্ষণ পর উইঠা বসে।হুমাই অনেকদিন খেয়াল করছে,কান্দনের পর যমুনার চেহারায় একটা অন্যরকম মায়া আইসা ভর করে কোথাও থেইকা।ওর দিকে তাকাইলে তখন বৃষ্টিতে ভিজা যাওয়া রঙন ফুলের কথা মনে হয়।

পরিবেশ হালকা করার জন্যে হুমাই যমুনার কান্ধে হাত রাখে,বলে-"আমার মাথা ঠিকাছিলোনা বউ।তরে কয়দিন কইছি মালা বেচনের কথা কবিনা।ওই একটা জিনিসই তো এহন পন্ত তরে বানায় দিবার পারছি।তারপরেও তুই আমার কথায় কান দ্যাস না।"

যমুনা ইনাইয়া বিনাইয়া গলা খাদে নামায়,বলে-"মাইনষের কথা হুনতে আমার বালা লাগেনা।হেইডা আমনে বোঝেন না?"

"ব্যাপারী ট্যাহাডা দিলেই দেনা শোধ কইরা দিমু তো!"

"কি অয় মালাডা বেইচা দেনা শোধ করলে!পরে নয় আরেকটা নতুন দেইহা বানায় দিবেন ট্যাহা অইলে।"

হুমায়ন চোখ তুইলা চায়।রাগচড়া গলায় বলে-"মাইরে তর পর্তায় পড়ে নাই ন্যা?আবার তরে মাইরে টানতাছে..."
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:১৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×